Ajker Patrika

গাত্রমর্দনের সুখ

সম্পাদকীয়
গাত্রমর্দনের সুখ

দেশে মনে হয় সাহিত্যচর্চা ভালোই চলছে; বিশেষ করে রাজশাহীর বিভিন্ন জেলায়—অন্তত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লেখা বইগুলো তো তা-ই বলে। পুলিশের চাকরির সুবাদে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেই লেখা যায় তদন্ত, আইনকানুন, নিয়মনীতি ও প্রশিক্ষণবিষয়ক বই। তাঁরা দায়িত্বের ফাঁকে এসব বই লেখেন, আর সেসব নাকি শত শত ক্রেতা কিনে নেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এসব ক্রেতা আর কেউ নন বরং লেখকদের অধীন কর্মী, যাঁরা বেশির ভাগ সময় ঊর্ধ্বতনদের ‘খুশি’ রাখতে তাঁদের বই কিনতে বাধ্য হন। সেসব বই অনেকে খুলেও দেখেন না। হয়তো পড়ে থাকে কোনো বুকশেলফে, কাটে ইঁদুর কিংবা আরশোলায়!

স্বাভাবিকভাবে কোনো পুলিশ সদস্য ছাড়া এসব বই কেউ কিনবেন না। তাই বগুড়ার বিভিন্ন থানায় বড় কর্তাদের বই গছিয়ে দেওয়ার অভিযোগ যাঁরা করেছেন, তাঁরাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন এই ‘বই আছে, ক্রেতা আছে কিন্তু পাঠক নেই’ বাণিজ্য-রহস্যের। হতে পারে, এটি অর্থনীতির নতুন কোনো তত্ত্ব! একে ‘অফিসভিত্তিক সাহিত্য কর্মসূচি’ বললেও হয়তো ক্ষতি নেই।

লেখকেরা বই কিনতে বাধ্য করেননি দাবি করলেও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে অভিযোগ স্থানান্তর করে দিয়েছেন। পুলিশ বাহিনী ছাড়াও কোথাও কোথাও ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছে বইগুলো বিক্রি করেছেন ওসিরা। প্রশ্ন জাগে, ইউপি চেয়ারম্যানরা কি এখন পুলিশগিরি করবেন?

বইগুলোর দামও হাতের খুব নাগালে নেই। যেমন রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহানের ১০টি বইয়ের সেটের দাম ৫ হাজার ২০০ টাকা, ছাড়ে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। বগুড়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বই কেনার ঘোষণা দিয়ে দাম পরিশোধের সময়ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অনেকে টাকা দিয়েছেন, বই নেননি। রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি মোহাম্মদ গোলাম রউফ খানের একটি বইয়ের দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা। বড়দের ‘খুশি’ করতে হোক কিংবা প্রয়োজনে, বইয়ের দাম দিতে গিয়ে কারও কপাল ঘর্মাক্ত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

কেউ কেউ বলতে পারেন, এসব বই বিক্রির মাধ্যমে অধস্তন পুলিশের উপকার হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বই সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে পড়ানো হয়। এমনকি সেখানেও কোনো কোনো বই প্রশিক্ষণার্থীদের বাধ্য হয়ে কিনতে হয়।

তবে সব সময় বাধ্য হয়ে ঊর্ধ্বতনদের কেউ যে ‘খুশি’ করেন, তা কিন্তু নয়। সুবিধাবাদীর দল স্বেচ্ছায় শর্টকাট বেছে নেয়। এ ধারা যদি আরও বিস্তৃত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অধস্তনেরা বলতে পারেন, ‘স্যার, বইয়ের প্রথম মুদ্রণ তো শেষ, দ্বিতীয়টাও কি কিনতে হবে?’

পাঠক, ‘খুশি’ করার এ ধরনের চিত্র কি সব ক্ষেত্রে খুব সাধারণ মনে হচ্ছে না? সরকারি, বেসরকারি যেকোনো দপ্তরেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ রকম প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা যায়। এই প্রবণতার প্রক্রিয়ায় অনেক সময় যোগ্যদের প্রতিভা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সুবিধাভোগী হয় তারাই, যারা তৈলমর্দনে সিদ্ধহস্ত। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই অসুস্থ প্রবণতাকে একমাত্র ঊর্ধ্বতনেরাই বন্ধ করতে পারবেন। কিন্তু গাত্রমর্দনের সুখ কি তাঁরা বিসর্জন দিতে রাজি?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত