শাইখ সিরাজ
নেদারল্যান্ডসের ডেন হেগ শহরে ভাতের রেস্তোরাঁ খুঁজে ফিরছিলাম। ভারতীয় রেস্তোরাঁ একটা পাওয়া গেল, নাম ‘রমনা’। নাম শুনেই বললাম, এটা বাংলাদেশিই হবে। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে ঢাকায় এই নামে একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ছিল। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার থেকে হাঁটা পথ দূরত্বে, সদলবলে চললাম রমনার উদ্দেশে। ‘রমনা’র কাছাকাছি যেতেই কানে এল সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। সঙ্গে সঙ্গেই সহকর্মী আদিত্য শাহীন বলে উঠল, ‘এ বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট না হয়ে যায় না!’ তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। শীতের কারণে নাকমুখ ছিল গরম কাপড়ে ঢাকা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেয়ালের ছবি ও কর্মীদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো ওরা ভারতীয়ই হবে, বড়জোর পশ্চিমবঙ্গের হতে পারে। আমি নাকমুখের কাপড় সরিয়ে টেবিলে বসলাম। আমাকে দেখে ক্যাশ থেকে দৌড়ে এলেন একজন, চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ভাই! আপনি শাইখ সিরাজ না? আমি নজরুল, পাবনা বাড়ি।’ বললাম, ‘সাবিনা ইয়াসমীনের গান শুনে আপনাদের বাংলাদেশি ভেবেছিলাম। কিন্তু রেস্তোরাঁর ভাবসাবে মনে হচ্ছিল ভারতীয়।’ শুনে নজরুল হেসে বললেন, ‘আমরাও পরিচয় দিই ভারতীয় রেস্টুরেন্ট হিসেবেই। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমীনের গানের আমি খুব ভক্ত। বিদেশবিভুঁইয়ে বসেও ওনার গান শুনে মনে হয় দেশেই আছি।’ আমিও খেয়াল করলাম, সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল দেশের কথা। তাঁর কণ্ঠে বাংলার শাশ্বত রাগ ছুঁয়ে আছে। সেখানে বসেই ভেবেছিলাম শিল্পীর জীবন, কর্ম ও গান নিয়ে একটি ডকুফিল্ম বানাব।
বাংলা গানের ইতিহাসে যেসব নাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে একটি নাম সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি আমাদের সময়ের আধুনিক বাংলা গানের এক অনন্য অধ্যায়। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ, আবেগময় পরিবেশনা এবং নিরলস শিল্পসাধনা তাঁকে এনে দিয়েছে কিংবদন্তির মর্যাদা। সাবিনা ইয়াসমীন স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বড় দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে গেছেন। সংগ্রামী বলে কঠিন অসুস্থতাকেও তিনি জয় করেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে আমি দেশে ফিরে এসে সাবিনা আপার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বসেছি। একটা দীর্ঘ সময় নিয়েছি তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানা-বোঝার। কিন্তু যে ঝড় তিনি সহ্য করেছেন স্বাস্থ্যের ওপর দিয়ে, সে ঝড় তাঁর গোছানো জীবনকেও এলোমেলো করে দিয়েছে অনেকখানি। ফলত জীবনীনির্ভর ডকুমেন্টারি নির্মাণের অনেক অনুষঙ্গই আমরা মেলাতে পারছিলাম না। অবশেষে একদিন ঠিক ঠিক শুরু করতে পারলাম, তাঁর জীবন, কর্ম ও সংগীত নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘জুঁইফুল: সাবিনা ইয়াসমীন’-এর কাজ।
১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার এক সংগীতপ্রেমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাবিনা ইয়াসমীন। আমার জন্ম ওই একই সালে ৭ সেপ্টেম্বর। সে হিসাবে তিনি আমার তিন দিনের বড়। এই সত্যটা যখন আমি আপার সামনে তুলে ধরলাম, তিনি শুনে ভীষণ আনন্দিত হলেন। আমার জন্যও বিষয়টা বেশ আনন্দের ছিল। যখন সাবিনা আপার কাছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের ঢাকার জীবনের কথা শুনছিলাম, আমিও তখন ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশব আর কৈশোর বেলায়। আমরা তো একই সময়ের সাক্ষী। ছোটবেলা থেকেই গান তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্কুলে পড়াকালীন তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন, আর সেই ছোট্ট বয়সেই প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর অসাধারণ কণ্ঠশক্তি। পরিবারের উৎসাহ ও স্নেহ তাঁকে গান শেখার পরিবেশ দেয়। প্রথাগত সংগীতচর্চার পাশাপাশি তাঁর ভেতরে ছিল আত্মবিশ্বাস—একদিন সংগীত হবে তাঁর জীবন। শৈশবের স্কুলে গান গাওয়ার স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন আরেক জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবালের কথা। স্কুলের অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমীনের গানে তবলা বাজাতেন সেই নায়ক। আবার সাবিনা আপার জীবন সম্পর্কে যখন জানতে চেয়েছি নায়িকা সুজাতার কাছে, তিনি বলছিলেন ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ গানের শুটিংয়ের গল্প। সেই শুটিং দেখতে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম রমনার লেকের ধারে। এই যে একই সময়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন অথচ একই ফ্রেমে সময়কে অতিবাহিত করে এসেছি, যেন সেটাকেই ধরতে চেয়েছি বারবার সাবিনা আপার জীবনের ওপর আলো ফেলে।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে সাবিনা ইয়াসমীন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর আসল খ্যাতির সূচনা হয় চলচ্চিত্রের গান দিয়ে। ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে প্লেব্যাক করার পর থেকেই তিনি চলচ্চিত্র জগতের এক অনন্য নাম হয়ে ওঠেন। তাঁর কণ্ঠে প্রাণ পায় অসংখ্য গান, যা আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
সত্তর ও আশির দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি সময়। এই সময়ে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন’, ‘এই পৃথিবীর পরে’—এসব গান শুধু চলচ্চিত্রকেই সফল করেনি, বরং কোটি মানুষের অনুভূতির সঙ্গে মিশে গেছে। বলা হয়, ওই সময়ের বাণিজ্যিক সিনেমার সাফল্যের অন্যতম বড় চালিকাশক্তি ছিল তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রের পর্দায় নায়িকাদের ঠোঁট মেলানো, আর সিনেমা হলে দর্শকের করতালি—দুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাবিনা ইয়াসমীন হয়ে ওঠেন এক জাদুকরি সেতুবন্ধ।
দীর্ঘ সংগীতজীবনে সাবিনা ইয়াসমীন অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সর্বাধিক ১৫ বার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল অর্জন। এ ছাড়া তিনি একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক অর্জন করেছেন—যা একজন শিল্পীর জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির মধ্যে অন্যতম। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রোতারা তাঁর গান শুনে আবেগে ভেসেছে, আনন্দ পেয়েছে, দুঃখে সান্ত্বনা পেয়েছে।
সাবিনা ইয়াসমীন যেমন শিল্পী, তেমনি একজন মা এবং পরিবারেরও মূল শক্তি। তাঁর কন্যা বাঁধন ও পুত্র শ্রাবণ। আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, মা সাবিনা ইয়াসমীনের গল্প। ছেলেকে বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রেখে দেশে ফেরার হৃদয়ভেজা কাহিনি। একজন সাবিনা ইয়াসমীন, মানুষ সাবিনা ইয়াসমীন, যাঁর কথা সাধারণ শ্রোতা শোনেনি। জানে না তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা চড়াই-উতরাই। তিনি বহু সংকট পার করেছেন, কিন্তু সংগীতচর্চা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে গানই ছিল তাঁর অবলম্বন। সাবিনা ইয়াসমীনের জীবনকথার অসংখ্য গল্প উঠে এসেছে তাঁর ও সংশ্লিষ্টদের বয়ানে।
বাংলাদেশে সংগীতের ধারা বদলেছে। নতুন প্রজন্মের গান, আধুনিক সুর, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম—সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ভিড়ে সাবিনা ইয়াসমীন আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর গান আজও রেডিও-টেলিভিশনে বাজে, আজও কনসার্টে দর্শক তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত হয়। সাবিনা ইয়াসমীনকে অনেকে বলেন সুরের পাখি। আসলেই তিনি এক অসাধারণ সুরের পাখি, যিনি সংগীতের মাধ্যমে জাতিকে আনন্দ, ভালোবাসা আর প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর গান কেবল আমাদের বিনোদিতই করেনি, তিনিই তো রেখেছেন সময়ের স্বাক্ষর, ইতিহাসের দলিল, অনুভূতির প্রতিচ্ছবি এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের আবেগের এক শাশ্বত প্রতীক।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
নেদারল্যান্ডসের ডেন হেগ শহরে ভাতের রেস্তোরাঁ খুঁজে ফিরছিলাম। ভারতীয় রেস্তোরাঁ একটা পাওয়া গেল, নাম ‘রমনা’। নাম শুনেই বললাম, এটা বাংলাদেশিই হবে। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে ঢাকায় এই নামে একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ছিল। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার থেকে হাঁটা পথ দূরত্বে, সদলবলে চললাম রমনার উদ্দেশে। ‘রমনা’র কাছাকাছি যেতেই কানে এল সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’। সঙ্গে সঙ্গেই সহকর্মী আদিত্য শাহীন বলে উঠল, ‘এ বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট না হয়ে যায় না!’ তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। শীতের কারণে নাকমুখ ছিল গরম কাপড়ে ঢাকা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেয়ালের ছবি ও কর্মীদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো ওরা ভারতীয়ই হবে, বড়জোর পশ্চিমবঙ্গের হতে পারে। আমি নাকমুখের কাপড় সরিয়ে টেবিলে বসলাম। আমাকে দেখে ক্যাশ থেকে দৌড়ে এলেন একজন, চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ভাই! আপনি শাইখ সিরাজ না? আমি নজরুল, পাবনা বাড়ি।’ বললাম, ‘সাবিনা ইয়াসমীনের গান শুনে আপনাদের বাংলাদেশি ভেবেছিলাম। কিন্তু রেস্তোরাঁর ভাবসাবে মনে হচ্ছিল ভারতীয়।’ শুনে নজরুল হেসে বললেন, ‘আমরাও পরিচয় দিই ভারতীয় রেস্টুরেন্ট হিসেবেই। কিন্তু সাবিনা ইয়াসমীনের গানের আমি খুব ভক্ত। বিদেশবিভুঁইয়ে বসেও ওনার গান শুনে মনে হয় দেশেই আছি।’ আমিও খেয়াল করলাম, সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল দেশের কথা। তাঁর কণ্ঠে বাংলার শাশ্বত রাগ ছুঁয়ে আছে। সেখানে বসেই ভেবেছিলাম শিল্পীর জীবন, কর্ম ও গান নিয়ে একটি ডকুফিল্ম বানাব।
বাংলা গানের ইতিহাসে যেসব নাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে একটি নাম সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি আমাদের সময়ের আধুনিক বাংলা গানের এক অনন্য অধ্যায়। তাঁর সুরেলা কণ্ঠ, আবেগময় পরিবেশনা এবং নিরলস শিল্পসাধনা তাঁকে এনে দিয়েছে কিংবদন্তির মর্যাদা। সাবিনা ইয়াসমীন স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বড় দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে গেছেন। সংগ্রামী বলে কঠিন অসুস্থতাকেও তিনি জয় করেছেন। নেদারল্যান্ডস থেকে আমি দেশে ফিরে এসে সাবিনা আপার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বসেছি। একটা দীর্ঘ সময় নিয়েছি তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানা-বোঝার। কিন্তু যে ঝড় তিনি সহ্য করেছেন স্বাস্থ্যের ওপর দিয়ে, সে ঝড় তাঁর গোছানো জীবনকেও এলোমেলো করে দিয়েছে অনেকখানি। ফলত জীবনীনির্ভর ডকুমেন্টারি নির্মাণের অনেক অনুষঙ্গই আমরা মেলাতে পারছিলাম না। অবশেষে একদিন ঠিক ঠিক শুরু করতে পারলাম, তাঁর জীবন, কর্ম ও সংগীত নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘জুঁইফুল: সাবিনা ইয়াসমীন’-এর কাজ।
১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার এক সংগীতপ্রেমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাবিনা ইয়াসমীন। আমার জন্ম ওই একই সালে ৭ সেপ্টেম্বর। সে হিসাবে তিনি আমার তিন দিনের বড়। এই সত্যটা যখন আমি আপার সামনে তুলে ধরলাম, তিনি শুনে ভীষণ আনন্দিত হলেন। আমার জন্যও বিষয়টা বেশ আনন্দের ছিল। যখন সাবিনা আপার কাছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের ঢাকার জীবনের কথা শুনছিলাম, আমিও তখন ফিরে গিয়েছিলাম আমার শৈশব আর কৈশোর বেলায়। আমরা তো একই সময়ের সাক্ষী। ছোটবেলা থেকেই গান তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্কুলে পড়াকালীন তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন, আর সেই ছোট্ট বয়সেই প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর অসাধারণ কণ্ঠশক্তি। পরিবারের উৎসাহ ও স্নেহ তাঁকে গান শেখার পরিবেশ দেয়। প্রথাগত সংগীতচর্চার পাশাপাশি তাঁর ভেতরে ছিল আত্মবিশ্বাস—একদিন সংগীত হবে তাঁর জীবন। শৈশবের স্কুলে গান গাওয়ার স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন আরেক জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবালের কথা। স্কুলের অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমীনের গানে তবলা বাজাতেন সেই নায়ক। আবার সাবিনা আপার জীবন সম্পর্কে যখন জানতে চেয়েছি নায়িকা সুজাতার কাছে, তিনি বলছিলেন ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ গানের শুটিংয়ের গল্প। সেই শুটিং দেখতে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম রমনার লেকের ধারে। এই যে একই সময়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন অথচ একই ফ্রেমে সময়কে অতিবাহিত করে এসেছি, যেন সেটাকেই ধরতে চেয়েছি বারবার সাবিনা আপার জীবনের ওপর আলো ফেলে।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে সাবিনা ইয়াসমীন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর আসল খ্যাতির সূচনা হয় চলচ্চিত্রের গান দিয়ে। ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে প্লেব্যাক করার পর থেকেই তিনি চলচ্চিত্র জগতের এক অনন্য নাম হয়ে ওঠেন। তাঁর কণ্ঠে প্রাণ পায় অসংখ্য গান, যা আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
সত্তর ও আশির দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি সময়। এই সময়ে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন’, ‘এই পৃথিবীর পরে’—এসব গান শুধু চলচ্চিত্রকেই সফল করেনি, বরং কোটি মানুষের অনুভূতির সঙ্গে মিশে গেছে। বলা হয়, ওই সময়ের বাণিজ্যিক সিনেমার সাফল্যের অন্যতম বড় চালিকাশক্তি ছিল তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রের পর্দায় নায়িকাদের ঠোঁট মেলানো, আর সিনেমা হলে দর্শকের করতালি—দুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাবিনা ইয়াসমীন হয়ে ওঠেন এক জাদুকরি সেতুবন্ধ।
দীর্ঘ সংগীতজীবনে সাবিনা ইয়াসমীন অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সর্বাধিক ১৫ বার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল অর্জন। এ ছাড়া তিনি একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক অর্জন করেছেন—যা একজন শিল্পীর জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির মধ্যে অন্যতম। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রোতারা তাঁর গান শুনে আবেগে ভেসেছে, আনন্দ পেয়েছে, দুঃখে সান্ত্বনা পেয়েছে।
সাবিনা ইয়াসমীন যেমন শিল্পী, তেমনি একজন মা এবং পরিবারেরও মূল শক্তি। তাঁর কন্যা বাঁধন ও পুত্র শ্রাবণ। আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, মা সাবিনা ইয়াসমীনের গল্প। ছেলেকে বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রেখে দেশে ফেরার হৃদয়ভেজা কাহিনি। একজন সাবিনা ইয়াসমীন, মানুষ সাবিনা ইয়াসমীন, যাঁর কথা সাধারণ শ্রোতা শোনেনি। জানে না তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা চড়াই-উতরাই। তিনি বহু সংকট পার করেছেন, কিন্তু সংগীতচর্চা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে গানই ছিল তাঁর অবলম্বন। সাবিনা ইয়াসমীনের জীবনকথার অসংখ্য গল্প উঠে এসেছে তাঁর ও সংশ্লিষ্টদের বয়ানে।
বাংলাদেশে সংগীতের ধারা বদলেছে। নতুন প্রজন্মের গান, আধুনিক সুর, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম—সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ভিড়ে সাবিনা ইয়াসমীন আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর গান আজও রেডিও-টেলিভিশনে বাজে, আজও কনসার্টে দর্শক তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত হয়। সাবিনা ইয়াসমীনকে অনেকে বলেন সুরের পাখি। আসলেই তিনি এক অসাধারণ সুরের পাখি, যিনি সংগীতের মাধ্যমে জাতিকে আনন্দ, ভালোবাসা আর প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর গান কেবল আমাদের বিনোদিতই করেনি, তিনিই তো রেখেছেন সময়ের স্বাক্ষর, ইতিহাসের দলিল, অনুভূতির প্রতিচ্ছবি এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের আবেগের এক শাশ্বত প্রতীক।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
দেশে মনে হয় সাহিত্যচর্চা ভালোই চলছে; বিশেষ করে রাজশাহীর বিভিন্ন জেলায়—অন্তত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লেখা বইগুলো তো তা-ই বলে। পুলিশের চাকরির সুবাদে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেই লেখা যায় তদন্ত, আইনকানুন, নিয়মনীতি ও প্রশিক্ষণবিষয়ক বই। তাঁরা দায়িত্বের ফাঁকে এসব বই লেখেন, আর সেসব নাকি শত শত ক্রেতা...
৯ ঘণ্টা আগেআর পাঁচজনের মতো গালিগালাজে আমার হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই। অন্য দশজনের মতো এ বিষয়ে আমার দীক্ষা বন্ধুদের কাছেই। কোনো কোনো বন্ধুর গালিগালাজের সম্ভার ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। তাদের মধ্যে একজনের গালিগালাজের সম্ভার শুধু আভিধানিক পর্যায়ের ছিল, তাই সেই সম্ভারের যথাসময়ে এবং যথাযথ প্রয়োগের শৈল্পিক প্রয়োগের...
৯ ঘণ্টা আগেফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান যখন ছড়িয়ে পড়া শুরু করল শহর থেকে নগরে, দেশের আনাচকানাচে; অভিযোগের তিরটাও ধেয়ে এল তাঁর দিকে। লালনের আখড়ায় গান করেন এমন অনেকে অভিযোগ তুললেন, ও তো ঠিকঠাক গাইতেই জানে না সাঁইজির গান। ফরিদা পারভীন বললেন, ‘অভিযোগ তো করতেই পারে, যেহেতু কোনো বাউলতান্ত্রিকতা...
৯ ঘণ্টা আগে১৯৩৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনের আগপর্যন্ত ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের দাবি ছিল মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে একটি ডোমিনিয়ন বা অঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে এর তিন মাস পর ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত...
১ দিন আগে