Ajker Patrika

মধুপুর শালবন: কৌশলে গজারিগাছ হত্যা

  • বনভূমির মধ্যে প্রাকৃতিক বন ৬ হাজার ৭৫৬ একর।
  • হত্যার কৌশল বনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানলেও রহস্যজনক কারণে নীরব।
  • অসাধু কর্মকর্তারা বনের জায়গা ফাঁকা করে বিঘাপ্রতি ভাড়া দেন।
  • জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: রেঞ্জ কর্মকর্তা
আনোয়ার সাদাৎ ইমরান, টাঙ্গাইল 
গাছের গোড়ার ছাল তুলে মাটিচাপা দিয়ে অংশটি ঢেকে রাখে দুর্বৃত্তরা। এতে দ্রুত গাছ মরে যায়। সম্প্রতি মধুপুর বনের আমলীতলা থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছের গোড়ার ছাল তুলে মাটিচাপা দিয়ে অংশটি ঢেকে রাখে দুর্বৃত্তরা। এতে দ্রুত গাছ মরে যায়। সম্প্রতি মধুপুর বনের আমলীতলা থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

৪৫ হাজার ৫৬৫ একর আয়তনের টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে একসময় শাল-গজারিসহ ৬৩ প্রজাতির গাছের পাশাপাশি ভেষজ গুল্ম-লতায় ভরা ছিল। বিচরণ ছিল চিতাবাঘ, হরিণ, বানর, হনুমানসহ অন্তত ২০ প্রকার প্রাণী ও বিষধর সাপের। তবে সেসব আজ অতীত। অভিনব কায়দায় হত্যা করা হচ্ছে এই বনের গজারিগাছ। দিন দিন কমছে বনের আয়তনও। বন বিভাগের হিসাব অনুসারে, ২৬ হাজার ৯৩৫ একর জমি বেহাত।

স্থানীয়দের দাবি, বন ধ্বংসের অভিনব এই কৌশল মধুপুর বনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাঁরা নীরব থাকেন। এই অপকর্মে সহযোগিতা করেন অসাধু কিছু বন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিএমসি সদস্যরা।

গজারিগাছ ধ্বংসের পুরো চিত্র ফুটে উঠেছে বন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগের অনুমোদিত সংগঠন কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটির (সিএমসি) দোখলা অঞ্চলের সভাপতি মো. মোতালেব হোসেনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘পরথমে গাছের গোড়া পরিষ্কার করে। তারপর গজারিগাছের ছাল এক দেড় ফুট তুইলা ফালায়। এরপর মাটি চাপা দিয়া গাছের গোড়া ঢাইকা দেয়। এক দেড় মাসের মধ্যে ওই গাছ মইরা যায়। এইডা হইল গজারিগাছ মাইরা ফালানোর প্রসেস। যারাই আনারস ও কলাবাগান করে, তারাই এই প্রসেসে বাগানের আগাছা পরিষ্কারের সাথে সাথে গজারিরগাছ পরিষ্কার করে।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, একসময়ের ঘন বন আজ বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দখলবাজি, তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় প্রশাসন ও বনদস্যুদের সম্মিলিত বৃক্ষ পাচার আর অপরিণামদর্শী সরকারি প্রকল্পের কারণে। সামাজিক ও অংশীদারত্বের বনায়নের নামে বন খেকোদের বৈধতা দেওয়ায় মধুপুর বন ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়েছে।

বন বিভাগ বলছে, ৪৫ হাজার ৫৬৫ একর বনভূমির মধ্যে প্রাকৃতিক বন ৬ হাজার ৭৫৬ একর। সামাজিক বন ৬ হাজার ১৭৯ একর। আর ৮ হাজার ৩৩২ জনের দখলে ১৯ হাজার ১৩৫ একর বনভূমি। ৭ হাজার ৮০০ একরজুড়ে রয়েছে রাবার বাগান। এই হিসাব অনুসারে ২৬ হাজার ৯৩৫ একর বনের জমি বেহাত রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, একসময়ের ঘন আরণ্যক অঞ্চল আমলীতলা কলা আর আনারস বাগানে পরিণত হয়েছে। দোখলা যাওয়ার পথে ওই গ্রামের বাইদের উজানে ডান পাশে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে আছে গজারিগাছ। প্রতিটি গাছের গোড়া মাটি চাপা দেওয়া। কিছু অংশে ঠিকাদারেরা পাথর ও পিচের ড্রাম রেখে দিয়েছে। মাস দেড়েক আগেও এই জায়গায় শাল-গজারিগাছের নিচে ছিল আনারসবাগান। আশপাশেও পাতাঝরা এই বনের পাতা মাটিতে পড়ে না। পড়ে আনারসগাছের ওপর। বন বিভাগের সহযোগিতায় সবই দখলদারদের হেফাজতে। দখলদারেরা গজারি বনের ভেতরে ফাঁকা জায়গাগুলোতে আনারস আবাদ করেছেন। ওই বাগান পরিষ্কারের সময় কৌশলে বড় বড় গাছও পরিষ্কার করেন তাঁরা। ঠিকাদারের ভাড়া নেওয়া জায়গার গজারিগাছগুলোর গোড়া মাটির ঢিবি দিয়ে ঢাকা। ওই ঢিবির মাটি সরানোর পর বেরিয়ে আসে গজারিগাছ হত্যার রহস্য। প্রতিটি গজারিগাছের গোড়া এক-দেড় ফুট ছাল তুলে ফেলা হয়েছে। যাতে করে দ্রুত গাছগুলো মরে যায়।

এভাবেই গাছের গোড়ার ছাল তুলে ফেলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ বিষয়ে বনকর্মীরা অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাঁরা নীরব থাকেন। বরং কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে সহযোগিতা করেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
এভাবেই গাছের গোড়ার ছাল তুলে ফেলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ বিষয়ে বনকর্মীরা অবগত থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাঁরা নীরব থাকেন। বরং কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে সহযোগিতা করেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঠিকাদারের প্রতিনিধি মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি ও মনির হোসেন দুজনে মিলে মধুপুর দোখলা সড়ক উন্নয়নের কাজটি সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়েছি। নির্মাণকাজের উপকরণ রাখার জায়গা না থাকায় আমলীতলায় মরে যাওয়া আনারসের বাগান ভাড়া নিয়েছি। ওই জমির আনারসচাষি শাহাজাহানকে গাছ পরিষ্কার করার জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। তারা গাছ পরিষ্কার করে দিয়েছে। আমরা বন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে নির্মাণের সময়ের জন্য জায়গাটুকু ব্যবহার করছি।’

স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গজারিগাছ নিধনে নতুন কৌশল নিয়েছে বন কর্মচারী, সিএমসি সদস্য ও দখলদারেরা। অসাধু এই ব্যক্তিরা বনের জায়গা ফাঁকা করে বিঘাপ্রতি ভাড়া দেন। তারা প্রতি বিঘা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এ জন্য তারা প্রথমে গজারিগাছের ছাল (চামড়া) গোড়া থেকে এক-দেড় ফুট পর্যন্ত চারদিকে তুলে ফেলে। তারপর গাছের কাণ্ডে হাতুড়ি বা কুঠার দিয়ে আঘাত করে থেঁতলে অ্যাসিড দিয়ে দেয়। পরে গাছের গোড়ায় মাটি ও আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দেয়। যাতে করে গ্যাস সৃষ্টি হয়ে দ্রুত গাছ মরে যায়। আর এই পদ্ধতিতে একটি গাছ দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে মরে যায়।

মধুপুর বনাঞ্চলের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে দখলদারেরা গাছের চামড়া ছিলে গজারিগাছ মেরে ফেলছে। আনারস-কলাচাষি, বনের অসাধু কর্মচারী ও দখলদার এবং সামাজিক বনায়নের প্লটধারীরা এভাবে বনের গজারিগাছ ধ্বংস করে থাকেন।’

এ ব্যাপারে দোখলা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল দেখে এসেছি। জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি স্থানীয়দের হামলার ভয়ে। আমরা বন বিভাগের কয়েক কর্মচারী অসহায়। কিছু বললেই স্থানীয়দের হামলার ভয় থাকে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘সি’ গ্রেডের গভর্নর খেতাব পেলেন ড. আহসান মনসুর

বাসে আগুন দেওয়ার সময় ‘বিশেষ জেলার’ একজন গ্রেপ্তার: ডিএমপি কমিশনার

গুলশান থেকে উদ্ধার রক্তাক্ত লাশটি পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতার

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির সুযোগ নেই, প্রজ্ঞাপন হতে পারে: সালাহউদ্দিন

সংবিধান মতেই সব হলে নির্বাচন হবে ২০২৯ সালে: হামিদুর রহমান আযাদ

এলাকার খবর
Loading...