Ajker Patrika

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সাংবাদিকতার জন্য হুমকি

শাহারিয়া নয়ন
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ০২
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সাংবাদিকতার জন্য হুমকি

প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দ্রুত বেড়ে চলেছে। সাংবাদিকতাও এর বাইরে নয়। আজকের দিনে সংবাদ সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, শিরোনাম তৈরি, এমনকি পুরো প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এ প্রযুক্তি সাংবাদিকতার জন্য শুধু সুযোগ নয়, নতুন ধরনের হুমকিও সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বের বড় সংবাদমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে এআই ব্যবহার শুরু করেছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অটোমেটেড ইনসাইট, রয়টার্সের রয়টার্স নিউজ ট্রেসার, ফোর্বসের বার্টি এবং ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি সাংবাদিকদের বিপুল তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করছে। এ প্রযুক্তি পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ; যেমন খেলাধুলা, ব্যবসা বা দৈনন্দিন সংবাদ তৈরি করার সময় কমিয়ে দিচ্ছে এবং তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে দ্রুত করছে। বিশ্বের স্বনামধন্য মিডিয়া হাউসগুলো; যেমন ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স, ব্লুমবার্গ, নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদ প্রক্রিয়ায় এআই ব্যবহার করছে।

এআই নিউজরুমে শুধু সংবাদ তৈরি করতে নয়, পাঠকের শ্রেণি অনুযায়ী পছন্দসই কনটেন্ট, ট্রান্সক্রাইবিং, ছবি, ভিডিও ও অডিও কনটেন্ট তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে। একাধিক তথ্য মিশ্রণ করে প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদকাঠামো অনুসারে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করা এবং দর্শকদের রুচি অনুযায়ী উপস্থাপন করা সহজ হয়ে গেছে এ প্রযুক্তির কল্যাণে। এআইচালিত অ্যালগরিদম পাঠকের আগ্রহ ও পছন্দ অনুসরণ করে সংবাদ পৌঁছে দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, ‘দ্য টাইমস’-এর জেমস প্রোগ্রাম পাঠকের অভ্যাস অনুযায়ী নোটিফিকেশন পাঠায়। এতে পছন্দের সংবাদে পাঠকের সংযোগ বাড়ছে এবং মিডিয়া হাউসগুলোকে আরও প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট সরবরাহের সুযোগ দিচ্ছে।

এআইচালিত স্বয়ংক্রিয় ফ্যাক্ট চেকিং টুলও সংবাদমাধ্যমে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ভেরিফাই, রয়টার্সের রয়টার্স ফ্যাক্ট চেক, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর হিলিওগ্রাফ, ‘টাইমস অব লন্ডন’-এর ফ্যাক্টমেটা, ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ও ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ফ্যাক্টচেকিং টুলগুলো ভুয়া সংবাদ প্রতিহত করতে অনেক বেশি সক্ষম এখন।

বর্তমানে বাংলাদেশেও স্বনামধন্য গণমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য অনলাইন মিডিয়া ও অনলাইন সংবাদ পোর্টাল সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সংবাদমাধ্যমের এই ভিড়ে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলছে—কে কত দ্রুত সংবাদ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের এই দৌড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ছোট ছোট তথ্য একত্র করে মুহূর্তের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবাদ তৈরি করা সম্ভব। এতে শুধু আকর্ষণীয় শিরোনামই থাকে না, সংবাদের মূল কাঠামোও মানদণ্ড মেনে উপস্থাপিত হয়।

তবে এআই সাংবাদিকতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, অনেক সংবাদকর্মীর চাকরি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। ‘মিডিয়া মেটামরফোসিস: এআই অ্যান্ড বাংলাদেশি নিউজরুমস ২০২৪’ শিরোনামের এক জরিপে দেখা গেছে, সাংবাদিকদের মধ্যে চাকরি হারানোর উদ্বেগও রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা প্রেসঅ্যাটের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ২ শতাংশ সাংবাদিক ইতিমধ্যে এআই ব্যবহারের কারণে চাকরি হারিয়েছেন। প্রায় ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ সাংবাদিক আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে এআই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আরও ব্যাপক হারে চাকরিচ্যুতি ঘটাতে পারে।

দ্বিতীয়ত, সঠিক নির্দেশনা দিলে এআই সঠিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সংবাদ তৈরি করতে পারে। কিন্তু ভুল নির্দেশনা দিলে সংবাদে ভুল বা পক্ষপাতমূলক তথ্য স্থান পেতে পারে। এ ছাড়া বড় বা পূর্ণাঙ্গ লেখা সংক্ষেপিত করলে তথ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যা সংবাদের কাঠামোকে প্রভাবিত করে। এআই শিরোনাম পরিমার্জন করতে পারলেও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে শিরোনাম সাজাতে সক্ষম নয়।

মানুষের অনুসন্ধানী মনোভাব ও সংবেদনশীলতাকে এআই পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে অ্যাকটিভেট রাইটস ইনফরমেশন, রাইটস অ্যান্ড টেকনোলজির রিসার্চ লিড মিনহাজ আমান বলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে সেটা সম্ভব নয়। তবে একেবারেই পারবে না, এটাও এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।’

‘ডিজিটাল ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ, ডিজিটাল বিভাগ বৃদ্ধি এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ করার মাধ্যমে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো ডিজিটাল পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিউজরুমে এআই প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে। সংবাদ সোর্সিং, সংবাদ লেখা, উপস্থাপনা, বণ্টন, বিজ্ঞাপনসহ নানা ক্ষেত্রে ডিজিটাল রূপান্তর দৃশ্যমান।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সাংবাদিকতার সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করা হলে নিউজরুম আরও গতিশীল, তথ্যভিত্তিক এবং আধুনিক হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট নৈতিক মানদণ্ড, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষাক্রমে এআই ও ডিজিটাল লিটারেসি অন্তর্ভুক্তকরণ এবং তথ্য যাচাই-বাছাই, ফ্যাক্টচেকিং ও সাইবার সিকিউরিটির দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংবাদিকতার জন্য একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। এটি মানব সাংবাদিকদের কাজকে প্রতিস্থাপন না করে; বরং সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা গেলে সংবাদ জগৎ আরও সমৃদ্ধ ও আধুনিক হবে।

সূত্র: প্রেসঅ্যাট, এমআরডিআই, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ভার্জ, এপি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ