Ajker Patrika

ন্যাটোকে ভাঙতে ধূসর খেলায় নেমেছেন পুতিন, দরকার তিন ব্যর্থতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৩৬
ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
ভ্লাদিমির পুতিন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

পোল্যান্ডের আকাশে রুশ ড্রোন; এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় মিগ যুদ্ধবিমান; বাল্টিক সাগরের গভীরে টেলিকম কেব্‌ল বিনষ্টীকরণ; সাইবার ও ড্রোন হামলায় বিমানবন্দরগুলোতে অচলাবস্থা; রহস্যজনক বিস্ফোরণ ও হত্যাকাণ্ড; নির্বাচন বিঘ্ন ঘটাতে বটসেনাদের প্রোপাগান্ডা—এসবের কোনোটিই এককভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো কারণ নয়, কিন্তু সবগুলো একত্র করলে এক নতুন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোর বিরুদ্ধে একধরনের ‘গ্রে জোন বা ধূসর’ অভিযান চালাচ্ছেন। সহজে বললে, পুতিন কঠিন হিসাব কষে ইউরোপকে অস্থির করে তোলার চেষ্টা করছেন, যা সরাসরি সংঘাতের ঠিক আগমুহূর্তের মতো।

তাই তো এ সপ্তাহে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধাবস্থায় নেই। কিন্তু আমরা আর শান্তিতেও নেই।’

ক্ষয়ক্ষতি কখনো গুরুতর হয়নি, তবে এর উদ্দেশ্য কী? পুতিন জানেন, তিনি ন্যাটোকে সরাসরি যুদ্ধে হারাতে পারবেন না, তবে তাঁর লক্ষ্য কেবল বিরক্তি সৃষ্টি নয়। তাঁর তিনটি মূল উদ্দেশ্য রয়েছে—তাঁকে সবকটিতেই ব্যর্থ হতে হবে।

প্রথমত, পুতিন ন্যাটোর ঐক্য ভাঙতে চান। তাঁর লক্ষ্য ইউরোপীয়দের মধ্যে সন্দেহ ছড়ানো এবং বিশেষত আমেরিকার জোটের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তিনি সন্দেহ তৈরি করতে চান যে, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাটোর মূল চুক্তি ‘আর্টিকেল ৫’-এর ওপর থেকে সবার বিশ্বাস উঠিয়ে নেওয়া। যেখানে বলা হয়েছে, এক দেশের ওপর হামলা মানে সবার ওপর হামলা। শেষপর্যন্ত আমেরিকা-ইউরোপের বিচ্ছেদ ঘটানো। পুতিন বারবার বলেছেন, ন্যাটো রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চায়, তাই এটিকে ভেতর থেকেই ধ্বংস করতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সব শত্রু-মিত্র মিলিয়েও সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেন টুইন টাওয়ারে হামলা করলে আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রবল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এতে ঘরে-বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। চীনের নেতারা একইভাবে স্বপ্ন দেখেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব এশিয়া থেকেও সরে যাবে। এ জন্যই সি জিন পিংও তাইওয়ানকে দুর্বল ও অসহায় প্রমাণ করতে সেই ‘ধূসর’ কৌশল ব্যবহার করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় মিত্রদের প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ ছড়াচ্ছেন। ১৯৪৫ সালের পর থেকে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা বিশ্বকে ধরে রেখেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবহেলা সে ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করছে।

ইউরোপেও একই চিত্র। পোল্যান্ডের আকাশে রুশ ড্রোন অনুপ্রবেশের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘এটা ভুলবশত হতে পারে।’ যদিও তখন ট্রাম্পের কথায় ঐক্যের প্রতি জোরারোপের প্রয়োজন ছিল। এ বক্তব্যের ১০ দিন পরে তিনটি মিগ-৩১ এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। ট্রাম্পের উচিত ছিল ইউরোপে প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপে তাঁর অঙ্গীকার জোর দিয়ে বলা। যদি নাশকতা বা আকাশসীমা লঙ্ঘনকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তবে প্রতিরোধক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর একবার বিতর্কিত হলে ধীরে ধীরে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

পুতিনের দ্বিতীয় লক্ষ্য ইউক্রেন। তাঁর গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে, তাই এখন তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোকে চাপ দিতে চান, যারা ইউক্রেনকে সমর্থন করছে। পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও ডেনমার্কে ড্রোন আক্রমণ, জিপিএস বিভ্রাট ও নাশকতা হয়েছে। জার্মানির প্রতিরক্ষা ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলো সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। মলদোভা ও রোমানিয়ার নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা হয়েছে—যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর বার্তা স্পষ্ট—ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার চেয়ে নিজেদের রক্ষা করো বা রাশিয়াকে তুষ্ট করো।

তৃতীয় কারণটি আরও গভীর ও পুরোনো। পুতিন উদার গণতন্ত্রকে ঘৃণা করেন, কারণ, তাদের সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা তাঁর ব্যর্থতা ও দমননীতিকে উদোম করে দেয়। অর্থনৈতিকভাবে তারা তাঁকে ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়ার জিডিপি ইতালির চেয়েও ছোট, অথচ তার জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। পশ্চিমা বিশ্বে বিভেদ ও বিভ্রান্তি যত বেশি ছড়ানো যাবে, তিনি তত শক্তিশালী দেখাবেন। আর কেন্দ্রীয় সরকারগুলোকে দুর্বল করলে এর লাভ পাবে ইউরোপের ভেতরের জাতীয়তাবাদী পপুলিস্টরা।

তাহলে মিত্রদের কী করা উচিত?

প্রথমত, সবকিছু প্রকাশ করতে হবে। ছোটখাটো উসকানি উপেক্ষা করা বা প্রমাণের অভাবে নীরব থাকা মানে গ্রে জোনকে ছেড়ে দেওয়া। আর একবার ছেড়ে দিলে, তা বাড়তেই থাকে। সাইবার হামলা, নাশকতা, নির্বাচনে হস্তক্ষেপ—সবকিছুকেই দ্রুত চিহ্নিত করে প্রমাণসহ প্রকাশ করতে হবে। এতে রাশিয়ার ‘অস্বীকার করার সুযোগ’ আর থাকবে না এবং পশ্চিমা ভোটারেরা বুঝতে পারবেন, পুতিনের লক্ষ্যবস্তু আসলে তাঁরা।

ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্থিতিশীলতা বাড়াতে হবে। এর মধ্যে কেবল সামরিক ব্যবস্থা নয়, বরং সমুদ্রতলের কেব্‌ল ও পাইপলাইনের জন্য অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ ও মেরামতকারী মজুত রাখা, দ্রুত সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধকারী দল করা ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে হবে। বাল্টিক সাগরে টহল অব্যাহত রাখতে হবে; আরও সেন্সর প্রয়োজন। রাশিয়া হাজার হাজার ড্রোন তৈরি করছে, ইউরোপের প্রয়োজন সেগুলো ধ্বংস করার জন্য সস্তা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। কোটি টাকার মিসাইল দিয়ে কয়েক হাজার টাকার ড্রোন নামিয়ে অর্থনীতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, এতে ইউরোপের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।

সবশেষে, ন্যাটো জোটকে নিজেদের খরচের খাতা স্পষ্ট করতে হবে। সীমান্ত অতিক্রমকারী ড্রোনের জবাবে সরবরাহকারী কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। সাইবার হামলার জবাবে পাল্টা সাইবার হামলা করতে হবে। এখন সময় এসেছে রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় ব্যবহার করার—যা আসলে ইউরোপের প্রতিরক্ষাই। প্রয়োজনে কোনো যুদ্ধবিমান গুলি করে নামাতে হবে, যদি তা জীবন বা সম্পদের জন্য হুমকি হয়। কেউ কেউ ভয় পান যে, এতে উত্তেজনা বাড়বে, কিন্তু কিছু না করা মানে ভিন্ন ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করা। যদি রাশিয়া সীমিত আগ্রাসন চালিয়ে যেতে পারে, তবে একদিন সত্যিকারের আক্রমণও করে বসতে পারে—যেমন এস্তোনিয়ার নারভা শহরের কিছু অংশ দখল করা, যেখানে রুশভাষী মানুষেরা বাস করে, তাদের অধিকার রক্ষা করার ভান রাশিয়া করে।

এসব করা কঠিন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার দৃঢ় হলেও। কিন্তু আরও কঠিন যখন ট্রাম্প জোটের অবিশ্বস্ত সদস্য হয়ে দাঁড়ান। এ বছর তিনি ন্যাটোকে সমর্থন করছেন, কিন্তু গত বছর বলেছিলেন, যারা ন্যাটোতে যথেষ্ট অর্থ দিচ্ছে না, তাদের ওপর তিনি ‘রাশিয়াকে লেলিয়ে দেবেন’। এ ধরনের কথা আসলে রাশিয়াকে আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো। পুতিনকে ন্যাটো নিয়ে অনুসন্ধান ও বিভাজন বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া। আর পুতিন মনোযোগ দিয়ে তা শুনছেন এবং করছেনও বটে।
দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে লিখেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাজধানীর মিরপুরে যাত্রী নামিয়ে গুলি ছুড়ে বাসে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা

দিল্লির সংকটকালে ভারতীয়-আমেরিকানদের বিস্ময়কর নীরবতা

মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে মুছে ফেলার হুমকি দিলেন ভারতের সেনাপ্রধান

শুধু ডিজিএফআইয়ের লোগোর সঙ্গে মিল থাকায় শাপলা না দেওয়া বৈষম্যমূলক: এনসিপি

জনসংখ্যার সংকট, তারপরও বিদেশিদের প্রতি ঘৃণা এখন তীব্র জাপানে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত