আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আমেরিকায় অভিবাসীদের সাফল্যের কাহিনির ভান্ডারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের গল্প আলাদা করে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় পারিবারিক আয় তাঁদের। ফরচুন-৫০০ কোম্পানির শীর্ষ পদে রয়েছেন একাধিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও। মার্কিন কংগ্রেসে আছেন ছয়জন সদস্য, আছেন দুই সাবেক গভর্নর। এমনকি, এফবিআই ও সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতো (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদেও রয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে ভারতীয়-আমেরিকানদের প্রভাব, সাফল্য আর মূলধারার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষার ধারণা বারবার সামনে উঠে এসেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এ প্রভাবশালী প্রবাসী গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদন ফি ১ লাখ ডলার করেছে, যে ভিসার ৭০ শতাংশই পান ভারতীয়রা। ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারতের কৌশলগত উন্নয়ন প্রকল্পে দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষার্থী ভিসা ও অভিবাসনের পথও করেছে কঠিন। এমনকি নানাভাবে ভারতকে অপমানও করা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতিবাদ শোনা যায়নি।
এই নীরবতা বিস্ময়কর! ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো বাধা নেই। ভারতীয়-আমেরিকানরা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বোর্ড, থিঙ্কট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ অনুদান দেন, সিনেটরদের পরামর্শ দেন, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে কংগ্রেস সদস্যদের এক বৈঠকে এক মার্কিন প্রতিনিধি ভারতীয় এমপিদের জানিয়েছিলেন—তাঁর অফিসে ভারতের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো ফোনকলই আসেনি। অথচ ইসরায়েল ইস্যুতে তাঁর অফিসে অসংখ্য কল আসে নিয়মিত। তাহলে কেন ভারতের বিরুদ্ধে এমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সময় প্রবাসীরা মুখ খোলেন না?
এর এক কারণ হয়তো দ্বৈত পরিচয়ের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন। ভারতীয়-আমেরিকানরা, বিশেষ করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, প্রায়ই হাঁটেন এক অদৃশ্য দড়ির ওপর। তাঁদের সাফল্য নির্ভর করছে একধরনের ভারসাম্যের ওপর—তাঁরা দীপাবলি উদ্যাপন করবেন, তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন থ্যাঙ্কসগিভিং আড়ালে না পড়ে যায়। গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানাবেন, তবে জেফারসনের ভাবমূর্তিকে আঘাত করবেন না। ভারতের পক্ষ নিয়ে জোরালোভাবে মুখ খোলা মানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেই প্রকাশ্যে সমালোচনা করা। এতে প্রশ্ন উঠতে পারে—আপনার আনুগত্য আসলে কোথায়?
এই শঙ্কা অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব গত কয়েক বছরে ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে মুসলিম নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে সীমান্তে ‘আক্রমণের’ কথিত আশঙ্কা—সব মিলিয়ে পরিবেশ আরও বৈরী হয়েছে বিদেশি হিসেবে দেখা হয়, এমন সব গোষ্ঠীর জন্য। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও ভারতীয়-আমেরিকানরা এর বাইরে নন। তাঁরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু। দক্ষিণ এশীয়দের ওপর ঘৃণামূলক হামলা বেড়েছে। গায়ের রংকে বিদেশি হিসেবে দেখার প্রবণতা এখনো আছে। এমন পরিস্থিতিতে নীরবতা তাঁদের কাছে আত্মরক্ষার উপায় বলেই মনে হচ্ছে।
আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয়দের আতঙ্কের একটি বাস্তব দিকও রয়েছে। মার্কিন ভারতীয় বন্ধুদের অনেকে বলেন, যারা এক প্রজন্ম আগে সেখানে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন, তাঁরা এখন মনে করেন এইচ-১বি ভিসা তাঁদের সন্তানদের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। নতুন করে পড়াশোনা শেষ করা অনেক স্টেম (বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়) গ্র্যাজুয়েট—এমনকি কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রিধারীরাও—বেকার হয়ে বসে আছেন। তাঁদের অনেকেই ভারতীয়-আমেরিকান। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বেশি বেতনের মার্কিন কর্মীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক সুলভে পাওয়া এইচ-১বি ভিসাধারীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছে। এ কারণে এসব পরিবারের কাছে নীরব থাকা মানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিকে নীরব সমর্থন দেওয়া।
এই নীরবতার পেছনে প্রজন্মগত পার্থক্যও আছে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয়-আমেরিকানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেকটাই ঢিলা। তাঁদের পরিচয় এখন দ্বৈত, আনুগত্যও বহুমুখী। তাঁদের কাছে ভারত মূলত পূর্বপুরুষের স্মৃতির জায়গা, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নয়। তাঁরা হোলি উদ্যাপন করেন, ক্রিকেটের স্কোর অনুসরণ করেন বটে, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি মার্কিন দেশীয় বিষয় নিয়ে—পুলিশি নির্যাতন, বন্দুক-সহিংসতা বা জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি তাঁদের আলোচনার কেন্দ্র হয় না।
এটা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একধরনের পরিবর্তন। প্রবাসী পরিচয় এক জায়গায় থেমে থাকে না, সময়ের সঙ্গে বদলায়। তবে এর মানে দাঁড়ায়, যখন ভারত আঘাতের মুখে পড়ে, তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ার তাগিদও দুর্বল হয়। আবেগের টান কমে যায়, দায়িত্ববোধ হালকা হয়ে পড়ে। ইলন মাস্ক যেখানে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, তিনি এইচ-১বি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে লড়াই করবেন, তারপরও ভারতীয়-আমেরিকান সিইওরা মুখ খোলেননি।
কিন্তু এই নীরবতারও মূল্য আছে। প্রবাসীরা যদি ভারতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক নীতি প্রয়োগের সময় প্রতিরোধ না গড়ে তোলেন, তবে তাঁরা নিজেদের নৈতিক অবস্থান হারান। এতে ভারতের বিষয়ে বিশ্বে ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে, ভারত যেন এক ‘বাণিজ্য প্রতারক’, এক ‘কৌশলগত ঝামেলার দেশ’ এবং এক ‘অবিশ্বস্ত অংশীদার।’ একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই প্রবাসী গৌরবের গল্প, যা এত যত্নে তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রবাসীদের বলেছেন ‘রাষ্ট্রের দূত’, কিন্তু যদি সেই প্রতিনিধিত্ব বাস্তবে কোনো সমর্থনে না দাঁড়ায়, তবে তার মূল্য কোথায়?
তবুও নীরবতা একেবারে সর্বজনীন নয়। কিছু কণ্ঠস্বর শোনা গেছে—অ্যাকটিভিস্ট, শিক্ষাবিদ, কমিউনিটি নেতা আর কিছু রাজনীতিক, যেমন—নিকি হ্যালি ও রো খানা। কেউ ভিসা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কেউ আবার শুল্ক নীতির সমালোচনা করেছেন। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, অন্য প্রবাসী গোষ্ঠীর মতো সংগঠিত শক্তি হয়ে ওঠেনি। যেমন ইহুদি-আমেরিকানরা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের পক্ষে শক্তিশালী লবিং করেন। কিউবান-আমেরিকানরা দশকের পর দশক ধরে হাভানার বিরুদ্ধে মার্কিন নীতি গড়ে তুলেছেন। এর তুলনায় ভারতীয়-আমেরিকান সমাজ এখনো খণ্ডিত—অঞ্চল, ধর্ম আর রাজনৈতিক মতভেদের কারণে তাঁরা বিভক্ত হয়ে আছেন।
প্রবাসে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনীহা রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো—অনেক ভারতীয়-আমেরিকান সর্বশেষ নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। ব্যবসাবান্ধব নীতি, চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি ট্রাম্পের আশীর্বাদসূচক মনোভাব তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল।
‘হাউডি মোদি’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে যে বিশাল সমাবেশ হয়েছিল, সেখানে ট্রাম্প ও মোদি এক মঞ্চে ছিলেন। এটি দুই নেতার ঘনিষ্ঠতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। অনেক প্রবাসী ভারতীয় এখনো ট্রাম্পকে ভারতের ‘বন্ধু’ ভাবেন। কিন্তু বন্ধুত্ব মানেই তো অন্ধ আনুগত্য নয়। বন্ধুত্বেরও পরীক্ষা থাকে।
যদি ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতীয় রপ্তানিকারকদের ক্ষতি করে, যদি ভিসা ফি বাড়িয়ে দেওয়া ভারতীয় পেশাজীবীদের ওপর বোঝা চাপায়, যদি নিষেধাজ্ঞা ভারতের কৌশলগত স্বকীয়তাকে ব্যাহত করে—তাহলে চুপ করে থাকাটা আর বন্ধুত্ব নয়, বরং অপরাধে অংশগ্রহণের মতো। প্রবাসী সমাজকে বুঝতে হবে—প্রতীকী করমর্দনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তব নীতিগত সিদ্ধান্ত। হিউস্টনে একটি করমর্দন দিল্লির ওপর জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞা মুছে দেয় না।
এই প্রসঙ্গে আরও গভীর একটি প্রশ্ন উঠে আসে—প্রবাসী হওয়া মানে কী? এটা কি শুধু নস্টালজিয়া—বলিউড সিনেমা, বিরিয়ানি আর ভরতনাট্যম প্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি এর মানে রাজনৈতিক দায়িত্বও রয়েছে? যখন দেশের ক্ষতি হয়, তখন প্রতিবাদ করা, ক্ষমতাধরদের সামনে সত্য বলা—এই দায়িত্ব কি তাঁদের নেওয়া উচিত নয়? প্রবাসী হয়ে কি শুধু দর্শক হয়ে থাকা যায়, নাকি সেতুবন্ধ গড়া উচিত?
ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের হাতে রয়েছে প্রচুর অর্থ, প্রভাব ও মর্যাদা। তাঁরা চাইলে মার্কিন কংগ্রেসে লবিং করতে পারেন, মিডিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন, জনগণকে সংগঠিত করতে পারেন। কিন্তু তার আগে দরকার—নিজস্ব অবস্থান থেকে স্পষ্ট ও নীতিভিত্তিক বক্তব্য দেওয়া। এমন বক্তব্য নয়, যা শুধু দিল্লির সরকারকে অনুসরণ করে, বরং এমন শব্দ যার প্রভাব পড়ে ওয়াশিংটনে।
ভারতেরও উচিত তার প্রবাসীদের সঙ্গে আরও গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। শুধু রেমিট্যান্স পাঠানো কিংবা সফট পাওয়ার হিসেবে তাঁদের তুলে ধরলেই হবে না, তাঁদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাঁদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, তাঁদের সীমাবদ্ধতাও বুঝতে হবে এবং তাঁদের সক্রিয়ভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।
বর্তমানে আমরা ওয়াশিংটনে কোটি কোটি টাকা খরচ করি পেশাদার লবিস্টদের পেছনে। কিন্তু যারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, সেই ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিকদের সংগঠিত করে ভারতের স্বার্থে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা খুব কমই উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রবাসী ভারতীয়দের নীরবতা মূলত একটি দ্বিধা থেকে আসে—তাঁদের সাফল্য ও সংহতি, আত্তীকরণ ও আনুগত্যের মাঝামাঝি টানাপোড়েন থেকেই এই নীরবতা জন্ম নেয়। আর ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটা মনে রাখা জরুরি—কোনো প্রবাসী সমাজের কণ্ঠস্বর বিবেচিত হয়, তারা কতটা ধনী বা প্রভাবশালী, তা দিয়ে নয়, বরং দেশ মুশকিলে পড়লে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ কতটা জোরালো হয়, সেটির ভিত্তিতেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
আমেরিকায় অভিবাসীদের সাফল্যের কাহিনির ভান্ডারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের গল্প আলাদা করে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় পারিবারিক আয় তাঁদের। ফরচুন-৫০০ কোম্পানির শীর্ষ পদে রয়েছেন একাধিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও। মার্কিন কংগ্রেসে আছেন ছয়জন সদস্য, আছেন দুই সাবেক গভর্নর। এমনকি, এফবিআই ও সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতো (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদেও রয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে ভারতীয়-আমেরিকানদের প্রভাব, সাফল্য আর মূলধারার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষার ধারণা বারবার সামনে উঠে এসেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এ প্রভাবশালী প্রবাসী গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদন ফি ১ লাখ ডলার করেছে, যে ভিসার ৭০ শতাংশই পান ভারতীয়রা। ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারতের কৌশলগত উন্নয়ন প্রকল্পে দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষার্থী ভিসা ও অভিবাসনের পথও করেছে কঠিন। এমনকি নানাভাবে ভারতকে অপমানও করা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতিবাদ শোনা যায়নি।
এই নীরবতা বিস্ময়কর! ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো বাধা নেই। ভারতীয়-আমেরিকানরা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বোর্ড, থিঙ্কট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ অনুদান দেন, সিনেটরদের পরামর্শ দেন, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে কংগ্রেস সদস্যদের এক বৈঠকে এক মার্কিন প্রতিনিধি ভারতীয় এমপিদের জানিয়েছিলেন—তাঁর অফিসে ভারতের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো ফোনকলই আসেনি। অথচ ইসরায়েল ইস্যুতে তাঁর অফিসে অসংখ্য কল আসে নিয়মিত। তাহলে কেন ভারতের বিরুদ্ধে এমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সময় প্রবাসীরা মুখ খোলেন না?
এর এক কারণ হয়তো দ্বৈত পরিচয়ের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন। ভারতীয়-আমেরিকানরা, বিশেষ করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, প্রায়ই হাঁটেন এক অদৃশ্য দড়ির ওপর। তাঁদের সাফল্য নির্ভর করছে একধরনের ভারসাম্যের ওপর—তাঁরা দীপাবলি উদ্যাপন করবেন, তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন থ্যাঙ্কসগিভিং আড়ালে না পড়ে যায়। গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানাবেন, তবে জেফারসনের ভাবমূর্তিকে আঘাত করবেন না। ভারতের পক্ষ নিয়ে জোরালোভাবে মুখ খোলা মানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেই প্রকাশ্যে সমালোচনা করা। এতে প্রশ্ন উঠতে পারে—আপনার আনুগত্য আসলে কোথায়?
এই শঙ্কা অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব গত কয়েক বছরে ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে মুসলিম নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে সীমান্তে ‘আক্রমণের’ কথিত আশঙ্কা—সব মিলিয়ে পরিবেশ আরও বৈরী হয়েছে বিদেশি হিসেবে দেখা হয়, এমন সব গোষ্ঠীর জন্য। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও ভারতীয়-আমেরিকানরা এর বাইরে নন। তাঁরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু। দক্ষিণ এশীয়দের ওপর ঘৃণামূলক হামলা বেড়েছে। গায়ের রংকে বিদেশি হিসেবে দেখার প্রবণতা এখনো আছে। এমন পরিস্থিতিতে নীরবতা তাঁদের কাছে আত্মরক্ষার উপায় বলেই মনে হচ্ছে।
আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয়দের আতঙ্কের একটি বাস্তব দিকও রয়েছে। মার্কিন ভারতীয় বন্ধুদের অনেকে বলেন, যারা এক প্রজন্ম আগে সেখানে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন, তাঁরা এখন মনে করেন এইচ-১বি ভিসা তাঁদের সন্তানদের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। নতুন করে পড়াশোনা শেষ করা অনেক স্টেম (বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়) গ্র্যাজুয়েট—এমনকি কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রিধারীরাও—বেকার হয়ে বসে আছেন। তাঁদের অনেকেই ভারতীয়-আমেরিকান। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বেশি বেতনের মার্কিন কর্মীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক সুলভে পাওয়া এইচ-১বি ভিসাধারীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছে। এ কারণে এসব পরিবারের কাছে নীরব থাকা মানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিকে নীরব সমর্থন দেওয়া।
এই নীরবতার পেছনে প্রজন্মগত পার্থক্যও আছে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয়-আমেরিকানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেকটাই ঢিলা। তাঁদের পরিচয় এখন দ্বৈত, আনুগত্যও বহুমুখী। তাঁদের কাছে ভারত মূলত পূর্বপুরুষের স্মৃতির জায়গা, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নয়। তাঁরা হোলি উদ্যাপন করেন, ক্রিকেটের স্কোর অনুসরণ করেন বটে, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি মার্কিন দেশীয় বিষয় নিয়ে—পুলিশি নির্যাতন, বন্দুক-সহিংসতা বা জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি তাঁদের আলোচনার কেন্দ্র হয় না।
এটা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একধরনের পরিবর্তন। প্রবাসী পরিচয় এক জায়গায় থেমে থাকে না, সময়ের সঙ্গে বদলায়। তবে এর মানে দাঁড়ায়, যখন ভারত আঘাতের মুখে পড়ে, তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ার তাগিদও দুর্বল হয়। আবেগের টান কমে যায়, দায়িত্ববোধ হালকা হয়ে পড়ে। ইলন মাস্ক যেখানে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, তিনি এইচ-১বি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে লড়াই করবেন, তারপরও ভারতীয়-আমেরিকান সিইওরা মুখ খোলেননি।
কিন্তু এই নীরবতারও মূল্য আছে। প্রবাসীরা যদি ভারতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক নীতি প্রয়োগের সময় প্রতিরোধ না গড়ে তোলেন, তবে তাঁরা নিজেদের নৈতিক অবস্থান হারান। এতে ভারতের বিষয়ে বিশ্বে ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে, ভারত যেন এক ‘বাণিজ্য প্রতারক’, এক ‘কৌশলগত ঝামেলার দেশ’ এবং এক ‘অবিশ্বস্ত অংশীদার।’ একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই প্রবাসী গৌরবের গল্প, যা এত যত্নে তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রবাসীদের বলেছেন ‘রাষ্ট্রের দূত’, কিন্তু যদি সেই প্রতিনিধিত্ব বাস্তবে কোনো সমর্থনে না দাঁড়ায়, তবে তার মূল্য কোথায়?
তবুও নীরবতা একেবারে সর্বজনীন নয়। কিছু কণ্ঠস্বর শোনা গেছে—অ্যাকটিভিস্ট, শিক্ষাবিদ, কমিউনিটি নেতা আর কিছু রাজনীতিক, যেমন—নিকি হ্যালি ও রো খানা। কেউ ভিসা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কেউ আবার শুল্ক নীতির সমালোচনা করেছেন। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, অন্য প্রবাসী গোষ্ঠীর মতো সংগঠিত শক্তি হয়ে ওঠেনি। যেমন ইহুদি-আমেরিকানরা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের পক্ষে শক্তিশালী লবিং করেন। কিউবান-আমেরিকানরা দশকের পর দশক ধরে হাভানার বিরুদ্ধে মার্কিন নীতি গড়ে তুলেছেন। এর তুলনায় ভারতীয়-আমেরিকান সমাজ এখনো খণ্ডিত—অঞ্চল, ধর্ম আর রাজনৈতিক মতভেদের কারণে তাঁরা বিভক্ত হয়ে আছেন।
প্রবাসে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে একধরনের অনীহা রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো—অনেক ভারতীয়-আমেরিকান সর্বশেষ নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। ব্যবসাবান্ধব নীতি, চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি ট্রাম্পের আশীর্বাদসূচক মনোভাব তাঁদের আকৃষ্ট করেছিল।
‘হাউডি মোদি’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে যে বিশাল সমাবেশ হয়েছিল, সেখানে ট্রাম্প ও মোদি এক মঞ্চে ছিলেন। এটি দুই নেতার ঘনিষ্ঠতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। অনেক প্রবাসী ভারতীয় এখনো ট্রাম্পকে ভারতের ‘বন্ধু’ ভাবেন। কিন্তু বন্ধুত্ব মানেই তো অন্ধ আনুগত্য নয়। বন্ধুত্বেরও পরীক্ষা থাকে।
যদি ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতীয় রপ্তানিকারকদের ক্ষতি করে, যদি ভিসা ফি বাড়িয়ে দেওয়া ভারতীয় পেশাজীবীদের ওপর বোঝা চাপায়, যদি নিষেধাজ্ঞা ভারতের কৌশলগত স্বকীয়তাকে ব্যাহত করে—তাহলে চুপ করে থাকাটা আর বন্ধুত্ব নয়, বরং অপরাধে অংশগ্রহণের মতো। প্রবাসী সমাজকে বুঝতে হবে—প্রতীকী করমর্দনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তব নীতিগত সিদ্ধান্ত। হিউস্টনে একটি করমর্দন দিল্লির ওপর জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞা মুছে দেয় না।
এই প্রসঙ্গে আরও গভীর একটি প্রশ্ন উঠে আসে—প্রবাসী হওয়া মানে কী? এটা কি শুধু নস্টালজিয়া—বলিউড সিনেমা, বিরিয়ানি আর ভরতনাট্যম প্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি এর মানে রাজনৈতিক দায়িত্বও রয়েছে? যখন দেশের ক্ষতি হয়, তখন প্রতিবাদ করা, ক্ষমতাধরদের সামনে সত্য বলা—এই দায়িত্ব কি তাঁদের নেওয়া উচিত নয়? প্রবাসী হয়ে কি শুধু দর্শক হয়ে থাকা যায়, নাকি সেতুবন্ধ গড়া উচিত?
ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের হাতে রয়েছে প্রচুর অর্থ, প্রভাব ও মর্যাদা। তাঁরা চাইলে মার্কিন কংগ্রেসে লবিং করতে পারেন, মিডিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন, জনগণকে সংগঠিত করতে পারেন। কিন্তু তার আগে দরকার—নিজস্ব অবস্থান থেকে স্পষ্ট ও নীতিভিত্তিক বক্তব্য দেওয়া। এমন বক্তব্য নয়, যা শুধু দিল্লির সরকারকে অনুসরণ করে, বরং এমন শব্দ যার প্রভাব পড়ে ওয়াশিংটনে।
ভারতেরও উচিত তার প্রবাসীদের সঙ্গে আরও গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। শুধু রেমিট্যান্স পাঠানো কিংবা সফট পাওয়ার হিসেবে তাঁদের তুলে ধরলেই হবে না, তাঁদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাঁদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, তাঁদের সীমাবদ্ধতাও বুঝতে হবে এবং তাঁদের সক্রিয়ভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।
বর্তমানে আমরা ওয়াশিংটনে কোটি কোটি টাকা খরচ করি পেশাদার লবিস্টদের পেছনে। কিন্তু যারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, সেই ভারতীয়-আমেরিকান নাগরিকদের সংগঠিত করে ভারতের স্বার্থে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা খুব কমই উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রবাসী ভারতীয়দের নীরবতা মূলত একটি দ্বিধা থেকে আসে—তাঁদের সাফল্য ও সংহতি, আত্তীকরণ ও আনুগত্যের মাঝামাঝি টানাপোড়েন থেকেই এই নীরবতা জন্ম নেয়। আর ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটা মনে রাখা জরুরি—কোনো প্রবাসী সমাজের কণ্ঠস্বর বিবেচিত হয়, তারা কতটা ধনী বা প্রভাবশালী, তা দিয়ে নয়, বরং দেশ মুশকিলে পড়লে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ কতটা জোরালো হয়, সেটির ভিত্তিতেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
এরই মধ্যে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার একটি আলোচক কমিটি পাঠিয়েছে। বৃহস্পতিবার তারা আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে পৌঁছে জম্মু-কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটির (জেএএসি) সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর এই জোট স্থানীয়দের অসন্তোষের প্রতিনিধিত্ব করছে।
৯ ঘণ্টা আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন এবং যেটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন, তা হয়তো দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনিরা যা আশা করেছিলেন তা দিতে পারবে না। এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজা যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সমর্থন জানানোর পর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার হিব্রু ভাষায় ইসরায়েলি জনগণের উদ্দেশে
২ দিন আগেতবে লেবার পার্টির অনেক এমপি ও সমর্থক ইরাক যুদ্ধের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারছেন না। লেবার এমপি কিম জনসন রয়টার্সকে বলেন, ব্লেয়ারের সম্পৃক্ততা তাঁর কাছে ‘জঘন্য ও নিন্দনীয়’ বলে মনে হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি একেবারেই ভুল মানুষ।’
২ দিন আগে