রেহানা পারভীন
একটি ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধের পর জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে শৈথিল্য আসতে পারে–সে সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা মানুষকে জাগিয়ে রাখেন, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মনে হয় আমাদের নেতৃস্থানীয়রা তাঁদের জায়গাটি ধরে রাখতে সক্ষম হননি। ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না’ গানটিতে যেন তারই প্রতিধ্বনি। অথচ যে চেতনায় আমরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়েছিলাম এবং ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম, তার সঙ্গে এ মনোভঙ্গি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কেন এমন হলো, তা নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে বিদ্যায়তনিক গবেষণা হবে। কিন্তু তার আগেই ইতিহাস থেকে লাখো মানুষ অন্যায়ভাবে হারিয়ে যাবেন, তাঁদের জীবনের সব বঞ্চনা ও যাতনা নিয়ে। এই লাখো মানুষের একজনের কথা বলি আজ। তিনি মজিদা বেওয়া, ১৯৭১ সাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে এখনো বেঁচে আছেন। এ দেশে আজও অগণিত ভিখারি রয়েছে, তবে মজিদা বেওয়ার কথা কেন? কারণ, তিনি বিধবা হয়েছিলেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য। জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার বুলুপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকালবেলা তাঁর স্বামী অইরউদ্দিনকে ডেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগীরা, মিছিল করার কথা বলে।
এর আগে আন্তাজ মণ্ডলের আহ্বানে আওয়ামী লীগের মিছিলে বারবার অংশ নিয়েছেন অইরউদ্দিন। সে কথা দালালরা জানত। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে জড়ো করে আন্তাজ মণ্ডলের বাড়ির সামনে। আন্তাজ মণ্ডল ছিলেন ছোট্ট গ্রামটির নেতৃস্থানীয় একজন। জয়পুরহাট বাজারে যাঁর একটি বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরি ছিল। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধি ড. মফিজ চৌধুরীর অনুসারী। গ্রামের লোকজন তাঁর কথায় মিছিল-মিটিংয়ে যেত, এমনকি ভোটদানেও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করত। আর এটাই ছিল একাত্তরের এপ্রিলের সেই সকালে মণ্ডল বাড়ির সামনে গ্রামের পুরুষদের জড়ো করার কারণ।
তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো এবং মুহূর্তে গুলিবর্ষণে লুটিয়ে পড়ল সবাই। আব্দুস সাত্তার মণ্ডল, আব্দুস সামাদ মণ্ডল, মোমেজ মণ্ডল, খয়ের মণ্ডল, আয়ের মণ্ডল, ভোলা মণ্ডল, আনতাজ মণ্ডল, মমতাজ মণ্ডলসহ আরও অনেকের সঙ্গে শহীদ হলেন দিনমজুর কৃষক অইরউদ্দিন। সেই থেকে মজিদা বেওয়া দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে পথে নামলেন। ভিক্ষাই হলো তার পথের পাথেয়।
দেশ স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল। গঙ্গা-যমুনায়ও অনেক জল গড়িয়ে গেল। বহু নদী শুকিয়ে গেল, বহু চর তলিয়ে গেল, নতুন করে চরও জাগল। কিন্তু মজিদা বেওয়ার ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে বহু অর্থ ও কর্মের সংস্থান হলো। কিন্তু মজিদা বেওয়া ও তাঁর দুই কন্যার কোনো স্থান হলো না। ভিখারি মায়ের মেয়েদের ভাগ্যেও জুটল একই পরিণতি। বিয়ে হলেও সংসার টিকল না। বহুদিন ভিক্ষা করে মেয়েদের মুখে অন্ন জুগিয়েছেন মজিদা। কিন্তু হেঁটে হেঁটে তাঁর বৃদ্ধ হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। কোমরের হাড়ের ক্ষয়ে আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন না মজিদা। এমন লাখো মজিদার দেশের নাম বাংলাদেশ!
মজিদার জীবনটা এমন হলো কেন? তিনি কি শহীদের স্ত্রী নন? তার কন্যারা কি শহীদসন্তান নন? আমরা যদি একটু পেছনে যাই, যদি মজিদার স্বামী সেদিন আন্তাজ মণ্ডলের কথায় মিছিল-মিটিংয়ে না গিয়ে আবদুল আলীম, আব্বাস খানদের (জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও পাকিস্তানিদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধী) কথামতো চলতেন, তবে পাকিস্তানিরা তাঁর স্বামীকে হত্যা করত না। আজ তাঁকে ও তাঁর কন্যাদের এমন দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হতো না। যদি মজিদা এমনটি বলেন, তবে কী জবাব দেবে বাংলাদেশ?
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে অগ্রসর মানুষের দীনতাই চোখে পড়ে শুধু। অথচ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ মানুষ সাধারণ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন অনায়াসেই। সেটা তাঁরা করেননি।
লেখক: গবেষক
একটি ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধের পর জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে শৈথিল্য আসতে পারে–সে সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা মানুষকে জাগিয়ে রাখেন, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর মনে হয় আমাদের নেতৃস্থানীয়রা তাঁদের জায়গাটি ধরে রাখতে সক্ষম হননি। ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না’ গানটিতে যেন তারই প্রতিধ্বনি। অথচ যে চেতনায় আমরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়েছিলাম এবং ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম, তার সঙ্গে এ মনোভঙ্গি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
কেন এমন হলো, তা নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে বিদ্যায়তনিক গবেষণা হবে। কিন্তু তার আগেই ইতিহাস থেকে লাখো মানুষ অন্যায়ভাবে হারিয়ে যাবেন, তাঁদের জীবনের সব বঞ্চনা ও যাতনা নিয়ে। এই লাখো মানুষের একজনের কথা বলি আজ। তিনি মজিদা বেওয়া, ১৯৭১ সাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে এখনো বেঁচে আছেন। এ দেশে আজও অগণিত ভিখারি রয়েছে, তবে মজিদা বেওয়ার কথা কেন? কারণ, তিনি বিধবা হয়েছিলেন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য। জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার বুলুপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকালবেলা তাঁর স্বামী অইরউদ্দিনকে ডেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগীরা, মিছিল করার কথা বলে।
এর আগে আন্তাজ মণ্ডলের আহ্বানে আওয়ামী লীগের মিছিলে বারবার অংশ নিয়েছেন অইরউদ্দিন। সে কথা দালালরা জানত। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে জড়ো করে আন্তাজ মণ্ডলের বাড়ির সামনে। আন্তাজ মণ্ডল ছিলেন ছোট্ট গ্রামটির নেতৃস্থানীয় একজন। জয়পুরহাট বাজারে যাঁর একটি বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরি ছিল। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধি ড. মফিজ চৌধুরীর অনুসারী। গ্রামের লোকজন তাঁর কথায় মিছিল-মিটিংয়ে যেত, এমনকি ভোটদানেও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করত। আর এটাই ছিল একাত্তরের এপ্রিলের সেই সকালে মণ্ডল বাড়ির সামনে গ্রামের পুরুষদের জড়ো করার কারণ।
তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো এবং মুহূর্তে গুলিবর্ষণে লুটিয়ে পড়ল সবাই। আব্দুস সাত্তার মণ্ডল, আব্দুস সামাদ মণ্ডল, মোমেজ মণ্ডল, খয়ের মণ্ডল, আয়ের মণ্ডল, ভোলা মণ্ডল, আনতাজ মণ্ডল, মমতাজ মণ্ডলসহ আরও অনেকের সঙ্গে শহীদ হলেন দিনমজুর কৃষক অইরউদ্দিন। সেই থেকে মজিদা বেওয়া দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে পথে নামলেন। ভিক্ষাই হলো তার পথের পাথেয়।
দেশ স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল। গঙ্গা-যমুনায়ও অনেক জল গড়িয়ে গেল। বহু নদী শুকিয়ে গেল, বহু চর তলিয়ে গেল, নতুন করে চরও জাগল। কিন্তু মজিদা বেওয়ার ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে বহু অর্থ ও কর্মের সংস্থান হলো। কিন্তু মজিদা বেওয়া ও তাঁর দুই কন্যার কোনো স্থান হলো না। ভিখারি মায়ের মেয়েদের ভাগ্যেও জুটল একই পরিণতি। বিয়ে হলেও সংসার টিকল না। বহুদিন ভিক্ষা করে মেয়েদের মুখে অন্ন জুগিয়েছেন মজিদা। কিন্তু হেঁটে হেঁটে তাঁর বৃদ্ধ হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। কোমরের হাড়ের ক্ষয়ে আর বিছানা থেকে উঠতে পারেন না মজিদা। এমন লাখো মজিদার দেশের নাম বাংলাদেশ!
মজিদার জীবনটা এমন হলো কেন? তিনি কি শহীদের স্ত্রী নন? তার কন্যারা কি শহীদসন্তান নন? আমরা যদি একটু পেছনে যাই, যদি মজিদার স্বামী সেদিন আন্তাজ মণ্ডলের কথায় মিছিল-মিটিংয়ে না গিয়ে আবদুল আলীম, আব্বাস খানদের (জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও পাকিস্তানিদের সহযোগী যুদ্ধাপরাধী) কথামতো চলতেন, তবে পাকিস্তানিরা তাঁর স্বামীকে হত্যা করত না। আজ তাঁকে ও তাঁর কন্যাদের এমন দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হতো না। যদি মজিদা এমনটি বলেন, তবে কী জবাব দেবে বাংলাদেশ?
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে অগ্রসর মানুষের দীনতাই চোখে পড়ে শুধু। অথচ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ মানুষ সাধারণ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন অনায়াসেই। সেটা তাঁরা করেননি।
লেখক: গবেষক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন এমন এক আবহে অনুষ্ঠিত হবে যে তা শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটা তাঁর নিজের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে
৯ ঘণ্টা আগেসোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। আস্থা আছে কি না, স্বপ্রণোদিত হয়ে যাচাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরু। সংসদে ১৯৪ জন সংসদ সদস্য তাঁর ওপর আস্থা জানিয়ে ভোট দিলেও ৩৬৪ জন তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের আইনপ্রণেতা হচ্ছেন মোট ৫৭৭ জন। ফলে মাত্র ৯ মাস ক্ষমতায়
৯ ঘণ্টা আগেসময় এখন অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মানুষ তার হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে—কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতিটি বিপ্লব আমাদের জীবনধারায় গভীর পরিবর্তন এনেছে, কেউ কেউ পেছনে পড়ে গেছে, কেউ সামনের সারিতে উঠে এসেছে। কিন্তু এইবার যা আসছে, তা হয়তো আর কাউকে কেবল পেছনেই ফেলবে না; বরং মানুষক
৯ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আজকের পত্রিকায় ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল’ (ক্যাবি) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
৯ ঘণ্টা আগে