নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। বহুল প্রতীক্ষিত এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার শেষটা ম্লান হলো অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জাল ভোটসহ নানা অভিযোগে। গতকাল দুপুরের পরই ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করে ছাত্রদলসমর্থিত প্যানেল।
কারচুপির অভিযোগ করে নির্বাচন বাতিল ও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে ‘অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রদল। রাত সোয়া ৯টার দিকে বের হওয়া মিছিলটি নতুন কলাভবন এলাকা থেকে শুরু হয়ে সিনেট ভবন ও পরিবহন এলাকা ঘুরে চৌরঙ্গীতে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে ‘প্রহসনের জাকসু, মানি না মানব না’, ‘বয়কট বয়কট, জাকসু বয়কট’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে রাতে ভোট গণনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক রশিদুল আলম জানিয়েছেন, ফলাফল পেতে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (হাতে) ভোট গণনা করা হবে। ফলাফল পেতে আগামীকাল (শুক্রবার) সকাল বা দুপুর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।’
নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে ছাত্রশিবির ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সমর্থিত প্যানেলও। অনিয়মের অভিযোগ করে নির্বাচন চলার সময় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনজন শিক্ষক। এদিকে নতুন তফসিল দিয়ে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে ছাত্রদল।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করেছে উৎসবের আমেজ। নির্বাচনে চারটি পূর্ণাঙ্গ ও চারটি আংশিক প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। পূর্ণাঙ্গ প্যানেলগুলো হলো শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, বাগছাস-সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম, ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেল। এ ছাড়া আংশিক প্যানেলের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট-সমর্থিত স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে স্বতন্ত্র ঐক্য সম্মিলন, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সমর্থিত সংশপ্তক পর্ষদ ও ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) সমর্থিত প্যানেল।
গত বুধবার রাত থেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বুধবার রাতেই জাকসু নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান অভি, শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন বাবর, সদস্যসচিব ওয়াসিম আহমেদ অনীকসহ ছাত্রদলের নেতাদের দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহিবুর রহমান নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে একটি কক্ষে বসে ফোনে কথা বলছেন—এমন ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে।
সকাল থেকেই ওঠে অভিযোগ
সকাল ৯টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে সকালে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। শুরুর দিকে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ চললেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নানা অভিযোগে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নির্বাচনের আবহ।
ভোট গ্রহণ শুরুর ২ ঘণ্টার মধ্যে হলগুলোতে ভোটারের চেয়ে বেশি ব্যালট পেপার সরবরাহ করার অভিযোগ করেন শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। নিজের ভোট দেওয়ার পর তিনি এই অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে বাড়তি ব্যালট সরাতে বলেছিলাম। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি হলেই অতিরিক্ত ব্যালট রাখা হয়েছে। এর কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা কমিশনের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।’
পরে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে দুটি কেন্দ্রে ভোট শুরু হতে ২ ঘণ্টা বিলম্ব, পোলিং এজেন্ট দেওয়া নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা, বহিরাগতদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন, দলবল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ করেন মাজহারুল ইসলাম।
অন্যদিকে সকালে প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলেন ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি মো. শেখ সাদী হাসান। তিনি নির্বাচন কমিশনে শিবির সভাপতির অবস্থান, বহিরাগতদের আনাগোনা এবং ভোট গণনার ওএমআর মেশিন নিয়ে অভিযোগ করেন। শেখ সাদী ভোট হাতে গণনার দাবি জানিয়ে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনা হয়েছে। ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব কোম্পানি থেকে আলাদাভাবে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
নানা অসংগতিসহ ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ তুলে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নির্বাচন বর্জন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। তাদের অভিযোগ ছিল, ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
ভোট বর্জনের কথা জানাতে ডাকা জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল, এটি সাজানো নির্বাচন হবে। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কিন্তু প্রশাসন আমাদের দাবি উপেক্ষা করেছে।’ বৈশাখী এ সময় বিভিন্ন হলে ভোট গ্রহণে অনিয়ম, জাল ভোট, নকল ব্যালট ব্যবহার, পোলিং এজেন্টদের কাজে বাধা দেওয়া এবং শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন।
‘ব্যাপক অনিয়মের’ অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের চারটি প্যানেলও। দ্রুত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে চারটি প্যানেলের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেন শরণ এহসান। এতে সংহতি জানায় ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) প্যানেল।
সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেলের জিএস প্রার্থী শরণ এহসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অব্যবস্থাপনা ও অথর্বতা সমগ্র নির্বাচনের ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা কিছুদিন ধরে লক্ষ করেছি, এই নির্বাচনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ অসহযোগিতা, পক্ষপাতদুষ্টতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার চূড়ান্ত অনিচ্ছা রয়েছে।’
শরণ এহসান বলেন, পোলিং এজেন্টদের কাজ করতে না দেওয়া, নারী হলে পুরুষ প্রার্থী প্রবেশ, ভোটার লিস্টে ছবি না থাকা, আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ না দেওয়া, ভোটার তালিকায় নাম না থাকা, ভোটারের তুলনায় ব্যালট বেশি ছাপানো, লাইন জ্যামিং, বহিরাগতদের আনাগোনা ইত্যাদি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে এই নির্বাচনকে ঘিরে অনেক সন্দেহ আর প্রশ্ন ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনেছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁরা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে (বর্তমানে ১০ নম্বর) সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পৌনে ১ ঘণ্টা পিছিয়ে পৌনে ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সাড়ে ১০টার দিকে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ২৫ মিনিট মোবাইল ফোনের আলো দিয়েই চলে ভোট গ্রহণ। এই কেন্দ্রে ব্যালট আসতে দেরি হয়েছে বলে জানান নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের সদস্য ফজলুল করিম পাটোয়ারী বলেন, ‘সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনকে। কেন বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হয়েছে, সে বিষয়ে অবগত নই।’ ভোট গ্রহণ শুরুর পরপরই বৃষ্টি শুরু হয়। এরপর মওলানা ভাসানী হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল, ফজিলাতুন নেছা হল, এ এফ এম কামালউদ্দিন হল, প্রীতিলতা হল এবং বীর প্রতীক তারামন বিবি হলেও বিদ্যুৎ চলে যায়।
বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে মোট ভোটারের চেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যালট পেপার নেওয়ার অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল ও শিবিরসহ কয়েকটি সংগঠনের প্রার্থীরা। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি প্রশাসন। ৫-৬টি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আঙুলে মার্কারের দাগ দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো কেন্দ্রে দাগ দেওয়া হলেও, দ্রুতই তা মুছে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম অভিযোগ করে বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রশাসন অদক্ষতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রদলের এজেন্ট জিসান বলেন, ‘নির্বাচনে কোনো পোলিং এজেন্টকে কার্ড দেওয়া হয়নি। এ ছাড়াও আমার হলে ভোট দেওয়ার পর মার্কার দিয়ে আঙুলে দাগ দেওয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন কেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশেও বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
যন্ত্রের বদলে হাতে ভোট গণনা
ওএমআর মেশিনের মাধ্যমে ভোট গণনার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ দিকে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে হাতে গোনার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য ড. সালেহ আহম্মদ খান বলেন, ডাকসু নির্বাচনে মেশিনে ভোট গণনা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জাকসুতে ভোট হাতে গণনা করা হচ্ছে।
কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যালট পেপারে ভুল থাকার কথাও জানিয়েছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে কার্যকরী সদস্যপদে ৩ জন প্রার্থী থাকলেও ব্যালটে দেওয়া নির্দেশনায় কেবল একজন প্রার্থীর পাশে টিকচিহ্ন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। হলের পোলিং কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা দ্রুত নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। শিক্ষার্থীদের করণীয় বুঝিয়ে বলা হয়েছে।’
দীর্ঘ সময় ভোটের লাইনে অপেক্ষা
কাজী নজরুল ইসলাম হল কেন্দ্রে সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটেও ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। লাইনে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ভোট দিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী বিশ্বাস মাধুর্য সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েক ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’ কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মীর ফেরদৌস হোসেন বলেন, একেকজন ভোটারের গোপন কক্ষে ঢুকে ভোটদান করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময় বিকেল ৫টার মধ্যে ভোট গ্রহণ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
দুই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ
অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা হলে (বর্তমান ১৫ নম্বর) দুবার করে বেশ কিছু সময় ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভোটের পর আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ না দেওয়া এবং কারচুপির অভিযোগে ছাত্রদল-সমর্থিত ভিপি প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা হলে প্রবেশ করলে হট্টগোল শুরু হয়। এ কারণে শেখ ফজিলাতুন নেছা হলে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। এর আগে দুপুর ১২টা থেকে ২০ মিনিটের মতো তাজউদ্দীন আহমদ হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কেন্দ্রে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলে ভোট গ্রহণ কিছু সময় বন্ধ রাখা হয়।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা আটক
নির্বাচন চলার সময় ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে অবস্থান করার অভিযোগে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হাফিজুর রহমান সোহানকে আটক করা হয়। সোহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের (প্রাক্তন) শিক্ষার্থী। বেলা ১১টার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের একটি কক্ষ থেকে তাঁকে আটক করা হয়। প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, সোহানের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ দাবি প্রশাসনের
নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশ সুষ্ঠু ছিল বলে দাবি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। গতকাল বিকেলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হল কেন্দ্র পরিদর্শনের পর তিনি বলেন, ‘পরিবেশটা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আছে। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সব জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই ভোট গ্রহণ চলছে। আশা করি, শেষ পর্যন্ত এভাবেই চলবে।’
ক্যাম্পাসের বাইরে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গেটের বাইরে দুপুর থেকে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া গেটের বাইরে বাজারে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই গেটে সকাল থেকে মোতায়েন ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা। রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ডেইরি গেটের বাইরেও শতাধিক লোককে ভিড় করতে দেখা যায়। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী।
পলাশবাড়ি এলাকার জামায়াতের কর্মী পরিচয় দেওয়া কামাল উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভোটের ফল জানার জন্য অপেক্ষায় আছি।’
রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রান্তিক গেটের বাইরে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত লোক অবস্থান করছেন। জানতে চাইলে তৌহিদুর রহমান নামের একজন বলেন, ‘আমরা ভোটের ফল জানার জন্য বসে আছি।’
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিভিন্ন গেটে লোকজন আছে, তা আমরা জানি। তবে সেসব গেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডধারী ও অনুমোদিত ব্যক্তি বা পরিবহন ছাড়া বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। বহুল প্রতীক্ষিত এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার শেষটা ম্লান হলো অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জাল ভোটসহ নানা অভিযোগে। গতকাল দুপুরের পরই ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করে ছাত্রদলসমর্থিত প্যানেল।
কারচুপির অভিযোগ করে নির্বাচন বাতিল ও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে ‘অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রদল। রাত সোয়া ৯টার দিকে বের হওয়া মিছিলটি নতুন কলাভবন এলাকা থেকে শুরু হয়ে সিনেট ভবন ও পরিবহন এলাকা ঘুরে চৌরঙ্গীতে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে ‘প্রহসনের জাকসু, মানি না মানব না’, ‘বয়কট বয়কট, জাকসু বয়কট’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।
জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে রাতে ভোট গণনা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক রশিদুল আলম জানিয়েছেন, ফলাফল পেতে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে (হাতে) ভোট গণনা করা হবে। ফলাফল পেতে আগামীকাল (শুক্রবার) সকাল বা দুপুর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।’
নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে ছাত্রশিবির ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সমর্থিত প্যানেলও। অনিয়মের অভিযোগ করে নির্বাচন চলার সময় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনজন শিক্ষক। এদিকে নতুন তফসিল দিয়ে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে রাত ৯টার দিকে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে ছাত্রদল।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক মাস ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করেছে উৎসবের আমেজ। নির্বাচনে চারটি পূর্ণাঙ্গ ও চারটি আংশিক প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। পূর্ণাঙ্গ প্যানেলগুলো হলো শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট, বাগছাস-সমর্থিত শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম, ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেল। এ ছাড়া আংশিক প্যানেলের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট-সমর্থিত স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে স্বতন্ত্র ঐক্য সম্মিলন, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সমর্থিত সংশপ্তক পর্ষদ ও ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) সমর্থিত প্যানেল।
গত বুধবার রাত থেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বুধবার রাতেই জাকসু নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান অভি, শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন বাবর, সদস্যসচিব ওয়াসিম আহমেদ অনীকসহ ছাত্রদলের নেতাদের দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মুহিবুর রহমান নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে একটি কক্ষে বসে ফোনে কথা বলছেন—এমন ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে।
সকাল থেকেই ওঠে অভিযোগ
সকাল ৯টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে সকালে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। শুরুর দিকে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ চললেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নানা অভিযোগে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নির্বাচনের আবহ।
ভোট গ্রহণ শুরুর ২ ঘণ্টার মধ্যে হলগুলোতে ভোটারের চেয়ে বেশি ব্যালট পেপার সরবরাহ করার অভিযোগ করেন শিবির-সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। নিজের ভোট দেওয়ার পর তিনি এই অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে বাড়তি ব্যালট সরাতে বলেছিলাম। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি হলেই অতিরিক্ত ব্যালট রাখা হয়েছে। এর কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা কমিশনের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।’
পরে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে দুটি কেন্দ্রে ভোট শুরু হতে ২ ঘণ্টা বিলম্ব, পোলিং এজেন্ট দেওয়া নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা, বহিরাগতদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন, দলবল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ করেন মাজহারুল ইসলাম।
অন্যদিকে সকালে প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলেন ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি মো. শেখ সাদী হাসান। তিনি নির্বাচন কমিশনে শিবির সভাপতির অবস্থান, বহিরাগতদের আনাগোনা এবং ভোট গণনার ওএমআর মেশিন নিয়ে অভিযোগ করেন। শেখ সাদী ভোট হাতে গণনার দাবি জানিয়ে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনা হয়েছে। ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব কোম্পানি থেকে আলাদাভাবে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
নানা অসংগতিসহ ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ অভিযোগ তুলে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নির্বাচন বর্জন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। তাদের অভিযোগ ছিল, ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপি ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কারণে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
ভোট বর্জনের কথা জানাতে ডাকা জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের আশঙ্কা ছিল, এটি সাজানো নির্বাচন হবে। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কিন্তু প্রশাসন আমাদের দাবি উপেক্ষা করেছে।’ বৈশাখী এ সময় বিভিন্ন হলে ভোট গ্রহণে অনিয়ম, জাল ভোট, নকল ব্যালট ব্যবহার, পোলিং এজেন্টদের কাজে বাধা দেওয়া এবং শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন।
‘ব্যাপক অনিয়মের’ অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের চারটি প্যানেলও। দ্রুত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে চারটি প্যানেলের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেন শরণ এহসান। এতে সংহতি জানায় ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল, ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) প্যানেল।
সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেলের জিএস প্রার্থী শরণ এহসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অব্যবস্থাপনা ও অথর্বতা সমগ্র নির্বাচনের ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা কিছুদিন ধরে লক্ষ করেছি, এই নির্বাচনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ অসহযোগিতা, পক্ষপাতদুষ্টতা ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার চূড়ান্ত অনিচ্ছা রয়েছে।’
শরণ এহসান বলেন, পোলিং এজেন্টদের কাজ করতে না দেওয়া, নারী হলে পুরুষ প্রার্থী প্রবেশ, ভোটার লিস্টে ছবি না থাকা, আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ না দেওয়া, ভোটার তালিকায় নাম না থাকা, ভোটারের তুলনায় ব্যালট বেশি ছাপানো, লাইন জ্যামিং, বহিরাগতদের আনাগোনা ইত্যাদি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে এই নির্বাচনকে ঘিরে অনেক সন্দেহ আর প্রশ্ন ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনেছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁরা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে (বর্তমানে ১০ নম্বর) সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পৌনে ১ ঘণ্টা পিছিয়ে পৌনে ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সাড়ে ১০টার দিকে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ২৫ মিনিট মোবাইল ফোনের আলো দিয়েই চলে ভোট গ্রহণ। এই কেন্দ্রে ব্যালট আসতে দেরি হয়েছে বলে জানান নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেলের সদস্য ফজলুল করিম পাটোয়ারী বলেন, ‘সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনকে। কেন বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হয়েছে, সে বিষয়ে অবগত নই।’ ভোট গ্রহণ শুরুর পরপরই বৃষ্টি শুরু হয়। এরপর মওলানা ভাসানী হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল, ফজিলাতুন নেছা হল, এ এফ এম কামালউদ্দিন হল, প্রীতিলতা হল এবং বীর প্রতীক তারামন বিবি হলেও বিদ্যুৎ চলে যায়।
বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে মোট ভোটারের চেয়ে বেশিসংখ্যক ব্যালট পেপার নেওয়ার অভিযোগ করেছেন ছাত্রদল ও শিবিরসহ কয়েকটি সংগঠনের প্রার্থীরা। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেনি প্রশাসন। ৫-৬টি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আঙুলে মার্কারের দাগ দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো কেন্দ্রে দাগ দেওয়া হলেও, দ্রুতই তা মুছে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম অভিযোগ করে বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রশাসন অদক্ষতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রদলের এজেন্ট জিসান বলেন, ‘নির্বাচনে কোনো পোলিং এজেন্টকে কার্ড দেওয়া হয়নি। এ ছাড়াও আমার হলে ভোট দেওয়ার পর মার্কার দিয়ে আঙুলে দাগ দেওয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন কেন্দ্রে সাংবাদিক প্রবেশেও বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
যন্ত্রের বদলে হাতে ভোট গণনা
ওএমআর মেশিনের মাধ্যমে ভোট গণনার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ দিকে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে হাতে গোনার সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য ড. সালেহ আহম্মদ খান বলেন, ডাকসু নির্বাচনে মেশিনে ভোট গণনা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জাকসুতে ভোট হাতে গণনা করা হচ্ছে।
কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যালট পেপারে ভুল থাকার কথাও জানিয়েছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে কার্যকরী সদস্যপদে ৩ জন প্রার্থী থাকলেও ব্যালটে দেওয়া নির্দেশনায় কেবল একজন প্রার্থীর পাশে টিকচিহ্ন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। হলের পোলিং কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা দ্রুত নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। শিক্ষার্থীদের করণীয় বুঝিয়ে বলা হয়েছে।’
দীর্ঘ সময় ভোটের লাইনে অপেক্ষা
কাজী নজরুল ইসলাম হল কেন্দ্রে সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটেও ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। লাইনে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ভোট দিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ৫২ ব্যাচের শিক্ষার্থী বিশ্বাস মাধুর্য সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েক ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’ কেন্দ্রের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মীর ফেরদৌস হোসেন বলেন, একেকজন ভোটারের গোপন কক্ষে ঢুকে ভোটদান করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময় বিকেল ৫টার মধ্যে ভোট গ্রহণ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
দুই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ
অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা হলে (বর্তমান ১৫ নম্বর) দুবার করে বেশ কিছু সময় ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভোটের পর আঙুলে অমোচনীয় কালির দাগ না দেওয়া এবং কারচুপির অভিযোগে ছাত্রদল-সমর্থিত ভিপি প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা হলে প্রবেশ করলে হট্টগোল শুরু হয়। এ কারণে শেখ ফজিলাতুন নেছা হলে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। এর আগে দুপুর ১২টা থেকে ২০ মিনিটের মতো তাজউদ্দীন আহমদ হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী বলেন, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কেন্দ্রে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলে ভোট গ্রহণ কিছু সময় বন্ধ রাখা হয়।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা আটক
নির্বাচন চলার সময় ক্যাম্পাসে অবৈধভাবে অবস্থান করার অভিযোগে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হাফিজুর রহমান সোহানকে আটক করা হয়। সোহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের (প্রাক্তন) শিক্ষার্থী। বেলা ১১টার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের একটি কক্ষ থেকে তাঁকে আটক করা হয়। প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, সোহানের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ দাবি প্রশাসনের
নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশ সুষ্ঠু ছিল বলে দাবি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। গতকাল বিকেলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হল কেন্দ্র পরিদর্শনের পর তিনি বলেন, ‘পরিবেশটা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আছে। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সব জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই ভোট গ্রহণ চলছে। আশা করি, শেষ পর্যন্ত এভাবেই চলবে।’
ক্যাম্পাসের বাইরে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি গেটের বাইরে দুপুর থেকে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া গেটের বাইরে বাজারে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই গেটে সকাল থেকে মোতায়েন ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা। রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ডেইরি গেটের বাইরেও শতাধিক লোককে ভিড় করতে দেখা যায়। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী।
পলাশবাড়ি এলাকার জামায়াতের কর্মী পরিচয় দেওয়া কামাল উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভোটের ফল জানার জন্য অপেক্ষায় আছি।’
রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রান্তিক গেটের বাইরে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত লোক অবস্থান করছেন। জানতে চাইলে তৌহিদুর রহমান নামের একজন বলেন, ‘আমরা ভোটের ফল জানার জন্য বসে আছি।’
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিভিন্ন গেটে লোকজন আছে, তা আমরা জানি। তবে সেসব গেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডধারী ও অনুমোদিত ব্যক্তি বা পরিবহন ছাড়া বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’
ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর ‘প্রতিরোধ পর্ষদের’ ৯ জন পোলিং এজেন্ট একটি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। এতে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ও ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে ওঠা অভিযোগগুলোর মধ্যে চারটি বিষয়ে দ্রুত সুরাহা করার দাবি জানানো হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগেজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পাঁচ ঘণ্টা পর শুরু হয়েছে ভোট গণনা। আজ বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টায় নির্বাচন কমিশনের অফিসে গিয়েও ভোট গণনার তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১০ ঘণ্টা আগেজাকসু নির্বাচন বর্জনের পর বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে ছাত্রদল। আজ বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ মিছিল বের হয়।
১১ ঘণ্টা আগেজাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। ভোট দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় বিকেল ৫টার পরে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ভোট দেন। কেন্দ্রটিতে সকাল ১০টা থেকেই ভোটারদের লাইন ছিল।
১২ ঘণ্টা আগে