Ajker Patrika

প্রেম আর রাজনীতি এক নয়

মইনুল হাসান
ফ্রাঁসোয়া বাইরুর (ডানে) মতো ফ্রান্সের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এমন ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। ছবি: সংগৃহীত
ফ্রাঁসোয়া বাইরুর (ডানে) মতো ফ্রান্সের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এমন ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। আস্থা আছে কি না, স্বপ্রণোদিত হয়ে যাচাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরু। সংসদে ১৯৪ জন সংসদ সদস্য তাঁর ওপর আস্থা জানিয়ে ভোট দিলেও ৩৬৪ জন তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের আইনপ্রণেতা হচ্ছেন মোট ৫৭৭ জন। ফলে মাত্র ৯ মাস ক্ষমতায় থাকার পরই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বাইরু। ১৯৫৮ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ফ্রান্সের পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর, আস্থা যাচাই করতে গিয়ে ইতিপূর্বে কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এমন ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। বিরোধী সদস্যরা অনেকেই গলা চড়িয়ে হর্ষধ্বনি দিয়ে বলছেন, ‘বাই বাই বাইরু’।

বাইরুকে ‘বাই বাই’ জানানোর কারণ হচ্ছে, ২০২৬ সালের বাজেটে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ইউরোর সাশ্রয় পরিকল্পনা পাসের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এতে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা ও বাৎসরিক মোট সরকারি ছুটি থেকে দুটি ছুটির দিন বাতিলের মতো প্রস্তাব ছিল। আর তাতেই বেঁকে বসেছেন বিরোধী জনপ্রতিনিধিরা। সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হচ্ছে যে ৫১ বছর ধরে ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় ব্যয়, দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্থাৎ আয়ের থেকে বেশি হচ্ছে। দেশটি চলছে ঋণের ওপর ভর করে। ইতিমধ্যে এই ঋণ ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি ইউরো ছাড়িয়ে গেছে। ফরাসি ঋণ জিডিপির প্রায় ১১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তাই যেমন ব্যয় সংকোচন একান্ত প্রয়োজন, তেমনই সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করাও এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। অথচ বিরোধীরা তা শুনতে নারাজ। এদিকে রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে কট্টরপন্থীরা জনতুষ্টির রাজনীতিতে রাজনীতির মঞ্চ দখলে ক্লান্তিহীন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা, প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিলে ইমানুয়েল মাখোঁ দ্বিতীয় মেয়াদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরে ইতিমধ্যে চারজন প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় নিতে হয়েছে।

ফ্রাঁসোয়া বাইরুর আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে পুনরায় ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর পদ খালি হলে রাজনৈতিক মহলে বেশ শোরগোল পড়ে যায়। ইউরোপের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে বেশ ফলাও করে এ খবর প্রচারিত হয়। সংবাদমাধ্যমে ইমানুয়েল মাখোঁর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ যখন সবে তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই অর্থাৎ পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর ইমানুয়েল মাখোঁ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাইরু সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ৩৯ বছর বয়স্ক সেবাস্তিয়া লেকর্নুকে মনোনীত করেন। সরকার পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেবাস্তিয়া লেকর্নুর মাত্র চার দশকের জীবনে দুই দশকই কেটেছে ক্ষমতার কাছাকাছি। অভিজ্ঞতায় এবং দক্ষতায় তিনি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের থেকে মোটেই কম যান না।

তবে যে দিনটিতে সেবাস্তিয়া লেকর্নু প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন, সেই ১০ সেপ্টেম্বর, অধিকাংশ বিরোধী দল এবং পেশাজীবী-শ্রমিক, ছাত্রসংগঠনগুলোর পূর্বঘোষিত হরতাল, দেশকে অচল করে দেওয়ার কর্মসূচি চলছিল। বিরোধীরা ১৮ সেপ্টেম্বর আবারও একই কর্মসূচির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে বলে আগাম জানিয়ে দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রান্সের জনরোষ স্তিমিত হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং দিনদিনই তা সহিংস রূপ ধারণ করছে। ২০৩০ সাল থেকে অবসর গ্রহণের বয়স ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করার সরকারের পেনশনসংক্রান্ত সংস্কার আজও অনেকে মেনে নিতে পারছে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মাখোঁ এবং মাখোঁর দলের প্রতি ফরাসি জনগণের সমর্থন কমতে শুরু করেছে। বিরোধী শিবিরের পালে বাতাস লেগেছে। আর সে কারণেই উগ্রপন্থীদের সঙ্গে অনেকেই গলা মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর পদত্যাগের দাবি তুলছে। বিরোধীদের এমন দাবির মুখে মাখোঁ জানিয়েছেন, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগেও তিনি পদত্যাগের কথা ভাবছেন না।

ফ্রান্সে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের শুরু গত বছর জুন থেকে। জুনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশীয় সংসদ, ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর দল উগ্র ডানপন্থীদের কাছে হেরে যায়। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইমানুয়েল মাখোঁর জন্য এমন শোচনীয় পরাজয় ছিল চরম অস্বস্তির। উগ্রপন্থীদের এমন উত্থান ঠেকানোর জন্য মাখোঁ নিজ দেশের পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করে গত বছর জুলাইয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন (২৮৯) না পাওয়ায় মাখোঁ এবং মাখোঁর দল কোণঠাসা

হয়ে পড়ে। সেই থেকে ফরাসি পার্লামেন্ট ভাঙাচোরা ও বিভক্ত হয়ে আছে এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে।

ইউরোপের দোরগোড়ায় ইউক্রেনে এবং মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পুরো পৃথিবী এক বিপজ্জনক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি ফ্রান্সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতা গোটা ইউরোপের জন্য কাল হতে পারে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তিনি মনেপ্রাণে চেষ্টা করেছেন দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে, জনগণের মন জয় করতে। কিন্তু তিনি তা পারছেন না, অন্তত সাম্প্রতিক জনমত জরিপের ফলগুলো তা-ই বলে।

নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ফরাসিদের তেমন মাথাব্যথা নেই, তারপরেও এ কথা সত্য যে সমাজের চোখরাঙানি, আইনি জটিলতা আর বাস্তব সমস্যা—সব বাধা একে একে পেরিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইমানুয়েল তাঁর থেকে ২৪ বছরের বড়, বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জননী ব্রিজিতের মন জয় করতে পেরেছিলেন। ২০০৬ সালে ব্রিজিত এবং তাঁর স্বামীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এর এক বছর পর ২০০৭ সালে ব্রিজিত মাখোঁকে বিয়ে করেন। ইমানুয়েল মাখোঁর বয়স তখন ৩০ আর ব্রিজিতের বয়স ৫৪। ভালোবাসার জোরে নির্ঝঞ্ঝাট ও গোছানো জীবনের বলয় থেকে বের করে ব্রিজিতকে নিজের জীবনসঙ্গী করতে পেরেছিলেন মাখোঁ। তিনি তাঁর নিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক দৃঢ়তার কারণে ভালোবাসাকে জয় করতে পেরেছিলেন। অথচ দুই মেয়াদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও ফরাসিদের মন জয় করতে পারছেন না। সুতরাং, প্রেম আর রাজনীতি এক নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত