Ajker Patrika

রপ্তানিতে দ্বিতীয় থেকে ১০ নম্বরে নামল চিংড়ি

  • অপদ্রব্য পুশ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মার খাচ্ছে এই খাত
  • ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫১ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছিল
কাজী শামিম আহমেদ, খুলনা
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ১৬
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় শীর্ষ খাত হিসেবে উঠে এসেছিল সাদা সোনাখ্যাত হিমায়িত চিংড়ি খাত। তৈরি পোশাক খাতের পরেই ছিল এই খাতের অবস্থান। কিন্তু নানা কারণে এ খাতের রপ্তানি আয় তলানিতে। খাতটির অবস্থান এখন ১০ নম্বরে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালা না মেনে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ, উৎপাদন কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পোনা সংকটসহ বিভিন্ন কারণে চিংড়ি খাত দিন দিন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের শীর্ষ ১০ রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই অর্থবছরে শুধু তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৮০ শতাংশ। অন্যান্য পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। এই অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এরপর রয়েছে কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কটন ও কটন পণ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ফুটওয়্যার (চামড়া ব্যতীত) পণ্য এবং সর্বশেষ ১০ নম্বরে রয়েছে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) সূত্র বলেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল; যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৫১ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি কমে ৪০ হাজার ৭২৬ টনে দাঁড়ায়। এভাবে গত ১০ বছরে রপ্তানির পরিমাণ কমেছেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। বিএফএফইএর তথ্যমতে, বর্তমানে ১০৯টি নিবন্ধিত চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে খুলনায় ২০টি ও চট্টগ্রামে ১৮টি চালু আছে।

চিংড়ি খাতে রপ্তানির এই দুরবস্থার কারণ জানতে চাইলে বিএফএফইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরিকুল ইসলাম জহীর বলেন, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওজন বাড়াতে চিংড়ির ভেতরে বিভিন্ন অপদ্রব্য ঢোকাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুশ’। এ ধরনের প্রবণতা রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত। তিনি বলেন, গত ১৪ এপ্রিল এ নিয়ে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বিএফএফইএর বৈঠক হয়। ওই সভায় রপ্তানিকারকেরা প্রতিটি প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিকে হেড লেস (মাথাবিহীন) গলদা ও বাগদা চিংড়ি না কেনার আহ্বান জানান। পাশাপাশি অসাধু কাজের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, মাঠপর্যায়ে কিছু ব্যবসায়ী চিংড়ির মাথা ছাড়িয়ে সেখানে ইনজেকশনের মাধ্যমে অপদ্রব্য পুশ করে ওজন বাড়ানোয় আর্ন্তজাতিকভাবে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এতে ক্রেতারা চিংড়ি কেনায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এ কারণে রপ্তানি দিন দিন কমছে।

জানতে চাইলে খুলনার মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ ঠেকাতে অভিযান চলমান রয়েছে। এই অসাধু কাজে জড়িত অভিযোগে ইন্টারন্যাশনাল সি ফুড কোম্পানিকে এক মাস এবং এডলাস সি ফুড ও শাহনেওয়াজ সি ফুডের সব কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো প্রক্রিয়াজাত কারখানা হেডলেস চিংড়ি কিনতে পারবে না। মাথাসহ কিনে তারপর নিজেরা হেডলেস করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করবে। যারা এ নির্দেশনা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

চিংড়িসহ মৎস্য রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে শুধু অপদ্রব্য পুশই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ার-ভাটায় জমি উঁচু হয়ে যাচ্ছে। মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, ‘চিংড়ি উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি আমাদের নেই। তা ছাড়া একজন চিংড়িচাষি একবার মার খেলে তাঁর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। কৃষকদের শস্যবিমা থাকলেও মৎস্যজীবীদের তা নেই। তাঁরা বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভর্তুকি পান না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় চিংড়ি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনা অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি নদ-নদীতে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির অসাধু জেলে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের জলজ জীববৈচিত্র্য। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনসংলগ্ন বৃহত্তর খুলনা জেলার নদ-নদীর মাছের ওপরেও।

মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল মামুন বলেন, মাছের প্রধান বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বৃহত্তর খুলনা জেলার নদ-নদীতেও মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন কমে গেছে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সুন্দরবন বন বিভাগ যৌথভাবে কাজ করলে মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বাড়ানো হয়তো সম্ভব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত