আজকের পত্রিকা ডেস্ক
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তাঁর টেবিলে সাজানো বইয়ের মধ্যে একটির প্রচ্ছদে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নেতা ও আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রার্থী বইটি চলতি বছর বেইজিং সফরের সময় উপহার পান। পাঁচ খণ্ডের বইটিতে রয়েছে মূলত চীনা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও নিজের লেখা।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিককে বলেন, সফরটি খুবই চমৎকার ছিল। চীন তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো চীন জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তাহেরের এই সফর শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের চারপাশের অন্য দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও কাছে টানতে চীনের বৃহত্তর কৌশলের অংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে চীন শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নিতে চাইছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ মাসে অন্তত সাতবার চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ পাঁচ বছরের মেয়াদে এমন বৈঠক হয়েছিল মাত্র আটবার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে বেইজিং। চলতি বছরই পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে অন্তত ২২ বার উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে চীন। গত বছরের ৩০টি বৈঠকের রেকর্ড ছিল। এ বছরও সে পথেই হাঁটছে তারা। ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোতেও সক্রিয় চীন। চলতি বছর নেপালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তত ছয়বার এবং শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে অন্তত পাঁচবার বৈঠক করেছে বেইজিং।
এ কূটনৈতিক তৎপরতার পেছনে রয়েছে গভীর কৌশল। বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চীন ও ভারত দুই দেশই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে। চীনের এ ধরনের ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপে একদিকে ভারতকে ব্যস্ত করে তুলছে, অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করছে বেইজিং।
চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের চীন ও দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ‘ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের ঘেরাটোপে পড়ার আশঙ্কা ভারতের জন্য কখনো এত বাস্তব ও কঠোর মনে হয়নি। বহুদিন ধরেই নয়াদিল্লির এই ভীতি রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতের সেই নীতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। গত মাসে তিনি নতুন করে ঘোষণা করেন, বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য বহুল ব্যবহৃত এইচ-১বি ভিসার ফি হবে এক লাখ ডলার। এই কর্মীদের অধিকাংশই ভারতীয়।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন জানে, ভারত এখন ব্যস্ত ও দুর্বল। তাই তারা মনে করতে পারে, এটাই সুযোগ ভারতের বিপরীতে সুবিধা নেওয়ার।’ রঞ্জনের মতে, বর্তমানে চারপাশের দেশগুলোর মধ্যে নয়াদিল্লির ভালো সম্পর্ক আছে মাত্র তিনটির সঙ্গে—শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাবও আছে, আর ভুটানের সীমান্তেও চীন ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।
আঞ্চলিক জোটের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গত মে মাসে। চীনের দেওয়া যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোয়েন্দা তথ্য সহায়তায় সীমান্ত সংঘাতে ভারতের ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, বরং অনেক সময় ভারতের প্রতি উদাসীন বা বিরূপ আচরণ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় মিত্রদের চোখে ভারতের একঘরে হয়ে পড়া শুধু চীনের জন্যই সুযোগ তৈরি করবে। এতে ভারত মহাসাগরে বেইজিং আরও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই যায় ভারত মহাসাগর দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সুশান্ত সিং বলেন, ‘এখানে অবশ্যই একটা আশঙ্কা আছে যে ভারতের চারপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো একজোট হচ্ছে। আর ভারতের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, দিল্লির অবস্থান হলো—এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখা এবং প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, ‘নিরাপদ’ ও ‘সমৃদ্ধ’ এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। তাদের দাবি, কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশকে টার্গেট করার ব্যাপার নেই।
বাংলাদেশে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে। ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয় গত বছর। এর পর থেকেই বেইজিং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরও ছিল বেইজিংয়ে, যেখানে তিনি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো বৈঠক হয়নি। এপ্রিলে ব্যাংককে এক আঞ্চলিক বৈঠকের ফাঁকে তাঁদের সামান্য কথোপকথন হয়েছিল। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। গত ডিসেম্বরে বেইজিং সফর চূড়ান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নয়াদিল্লির কাছে দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
বাংলাদেশে কূটনৈতিক তৎপরতায় চীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের সাবেক প্রধান লিউ সিয়ানচাওয়ের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। লিউ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া, গত জুনে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিল ২৫০ জনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল।
তবে চীনের দৃষ্টি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। গত জুনে বেইজিং কুনমিং শহরে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়। তিন দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণাও দেয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগস্টে সাংবাদিকদের জানান, শ্রীলঙ্কাও এ উদ্যোগে যোগ দিতে পারে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে গত জুনে চীনা গবেষক লিউ জোংই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস চলছে।’ তিনি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
চীন-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরোনো। ১৯৬২ সালে হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ২০২০ সালে সীমান্তে মারামারিতে উভয় পক্ষের সেনারা হতাহত হয়। এ বছরের মে মাসেও উত্তেজনা বাড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে চীনা অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায়। পারমাণবিক শক্তিধর চীন ও ভারত সম্প্রতি সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কৌশলগত পদক্ষেপ। কারণ, দুই দেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে কাছে টানার প্রচেষ্টা শুধু অস্ত্র বিক্রিতে সীমাবদ্ধ নয়; তারা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। এ প্রচেষ্টার মূল হাতিয়ার হচ্ছে বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (বিআরআই) অবকাঠামো কর্মসূচি।
চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে লিউ জোংই লিখেছেন, ‘ভারতের এমন নিজস্ব সামর্থ্য নেই যে তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু অন্য কোনো দেশ যদি প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে চায়, সেখানেও ভারত অনীহা দেখায়। কারণ, ভারত চায় তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্য অটুট থাকুক।’
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, চীন ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার বা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে না, বরং ভারতই সক্রিয়ভাবে চীনকে আটকে রাখতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দিয়ে। এর মধ্যে আছে ‘কোয়াড’, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে।
লিনের ভাষায়, ‘ভারতের মানসিকতা হলো—দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের উঠান হিসেবে রাখা, এটিকে নিজের প্রভাববলয় হিসেবে ধরে রাখা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু চীনের উত্থান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। তাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে।’
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গভীর কিন্তু ভারতের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের হলো—বাংলাদেশে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার। ভারতের ধারণা, ড. ইউনূসের সরকার ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে নরম অবস্থান নিয়েছে। আবার সরকারের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ, এতে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্তে (সেভেন সিস্টার্স) উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডর (চিকেনস নেক) নিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং সফরে ড. ইউনূস ভারতের এসব আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ওই অঞ্চলকে সমুদ্রপথে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। ড. ইউনূস আরও বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের একটি অংশ’ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ আবারও চীনের সহায়তায় তিস্তা নদী ঘিরে সীমান্তবর্তী কৌশলগত এলাকা উন্নয়নের প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের সুযোগও দিয়েছে চীনকে।
বাংলাদেশ চীনের তৈরি জে-১০ ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই একই যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বিমানবাহিনী ব্যবহার করে গত মে মাসে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। পাশাপাশি ভারত ভিত্তিক মিসইনফরমেশন মোকাবিলায়ও চীনের সহায়তা চেয়েছে ঢাকা—এমনটাই জানিয়েছেন ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠরা।
বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হবে।’ তাঁর মতে, এতে ভারতের ওপর চাপ তৈরি হবে। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল।
বাংলাদেশি থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানির বড় অংশই আসে চীন থেকে। চীন নরম শর্তে ও বাণিজ্যিক ঋণ দিয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে বিষয়টি বদলাচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক সম্পর্ক। অর্থাৎ ভারত থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে এগোনো।’
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতিও চীনের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে বেইজিং, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে সুযোগ তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।’ অবশ্য পরে যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে।
চীনের আরেকটি বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনর্গঠন। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
চলতি বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান-চীন যৌথভাবে নির্মিত জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর সরাসরি বাণিজ্য সংযোগ পুনরায় চালু করেছে। আগস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকা সফর করেন। এটি গত দশ বছরে ঢাকায় এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত বিষয়াবলি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে সকলেই মনে করছে, ১৯৭১ সালের বিষয়কে এড়িয়ে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়।’
এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগস্টের শুরুতে পাকিস্তান চীনের জেড-১০ এমই অ্যাটাক হেলিকপ্টার ফ্লিটে যুক্ত করেছে। চীনের এই হেলিকপ্টার প্রথম কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো।
একই মাসে চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পিত আটটি হাঙর-ক্লাস ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তৃতীয়টি কমিশন করেছে। এই সাবমেরিনগুলো পাকিস্তানকে আরব সাগরে ভারতকে মোকাবিলায় বাড়তি সক্ষমতা দেবে।
পাকিস্তানের বিমানবাহিনী চীনের সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে তিন ডজনেরও বেশি জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, ‘চীনের অস্ত্র পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পুনর্মিলনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি পাকিস্তান ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্কেও মধ্যস্থতা করছে চীন। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি এবং চীনা কর্মীদের হত্যা, প্রায় ১০ লাখ আফগান শরণার্থীর পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের কারণে এই সম্পর্ক নাজুক হয়ে উঠেছে। চীন তালেবানকে আফগান মাটিতে থাকা উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
মে মাসের শেষ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসলামাবাদ ও কাবুলের কাছে রাষ্ট্রদূত বিনিময় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সহযোগিতা গভীর করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। কার্যত বেইজিং কূটনীতিতে নয়াদিল্লিকে একঘরে করতে কাজ করছে, যদিও দুই দেশ প্রকাশ্যে তিক্ত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
ওয়াং ই গত আগস্টে দিল্লি সফর করেন, আর এর ১০ দিন পরই মোদি সাত বছরের মধ্যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবার চীন সফর করেন। সেখানে মোদিকে সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে দেখা যায়। সি তাঁকে বলেন, চীন ও ভারত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, অংশীদার’ এবং দুই দেশ এ মাস থেকে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০২০ থেকে স্থগিত ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সম্পর্কের উন্নতি ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই শুরু হয়েছিল এবং মূলত দুই পক্ষের বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে ভূমিকা রেখেছে। যেমন—ভারতের লক্ষ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মান উন্নত করা, অ্যাপলের মতো কোম্পানির সরবরাহকারীদের আকর্ষণ করা, কিন্তু এর জন্য চীনা উপাদান ও দক্ষতার প্রয়োজন। এটি এমন সময় হচ্ছে যখন চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
স্টিমসন সেন্টারের মার্কি বলেন, ‘এটি একটি কৌশলগত, হিসাব-নিকাশ করে দেখানো আগ্রহ। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সম্পর্কিত কার্যক্রমে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্য দুই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ভারতের চীনের প্রতি অবস্থান বা উদ্বেগ পুনর্বিবেচনার বিষয় নয়।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্যাভেকালের বিশ্লেষক টম মিলার এক প্রতিবেদনে বলেন, ভারত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ঐতিহাসিক ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’ নীতি অনুসরণ করছে। যার মাধ্যমে দেশটি ‘অনেক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে, কিন্তু কোনো একটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জুড়ে যাবে না’। তিনি বলেন, ‘চীন এখনো (ভারতের) শত্রু, তবে এরপরও এই যোগাযোগ অর্থনৈতিকভাবে (উভয় পক্ষের জন্য) সহায়ক হতে পারে।’
পুরোনো মিত্র চীনের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে ভারতের দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, সেসবের একটি ধারণা দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম। গত আগস্টে বেইজিং সফরকালে নাহিদও সেই বইটি স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছেন, যেটি জামায়াত নেতা তাহেরের ডেস্কে রয়েছে। নাহিদ বলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ ‘নতুন রাজনৈতিক অভিমুখের’ অংশ। বেইজিং অনেক দূরদৃষ্টি নিয়ে ভাবছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চীন আমাদের অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে আমরা একটি তরুণ রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি এবং তারা মনে করে, আমরা বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারি।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে পুনর্লিখন করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তাঁর টেবিলে সাজানো বইয়ের মধ্যে একটির প্রচ্ছদে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নেতা ও আসন্ন নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রার্থী বইটি চলতি বছর বেইজিং সফরের সময় উপহার পান। পাঁচ খণ্ডের বইটিতে রয়েছে মূলত চীনা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও নিজের লেখা।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিককে বলেন, সফরটি খুবই চমৎকার ছিল। চীন তাঁদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো চীন জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তাহেরের এই সফর শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের চারপাশের অন্য দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও কাছে টানতে চীনের বৃহত্তর কৌশলের অংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরে চীন শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নিতে চাইছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ মাসে অন্তত সাতবার চীনা কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ পাঁচ বছরের মেয়াদে এমন বৈঠক হয়েছিল মাত্র আটবার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে বেইজিং। চলতি বছরই পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে অন্তত ২২ বার উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে চীন। গত বছরের ৩০টি বৈঠকের রেকর্ড ছিল। এ বছরও সে পথেই হাঁটছে তারা। ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোতেও সক্রিয় চীন। চলতি বছর নেপালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তত ছয়বার এবং শ্রীলঙ্কার নেতাদের সঙ্গে অন্তত পাঁচবার বৈঠক করেছে বেইজিং।
এ কূটনৈতিক তৎপরতার পেছনে রয়েছে গভীর কৌশল। বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চীন ও ভারত দুই দেশই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে। চীনের এ ধরনের ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপে একদিকে ভারতকে ব্যস্ত করে তুলছে, অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করছে বেইজিং।
চীন ভারতের আশপাশের অঞ্চলকে নিজেদের কার্যক্রম ও প্রভাব বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের চীন ও দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ‘ভারত যেটিকে নিজের এলাকা বা প্রতিবেশ মনে করে, সেটিকে চীনও নিজেদের প্রভাবের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটি যেমন চীনের পেছনের উঠান, ভারতেরও তেমন।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের ঘেরাটোপে পড়ার আশঙ্কা ভারতের জন্য কখনো এত বাস্তব ও কঠোর মনে হয়নি। বহুদিন ধরেই নয়াদিল্লির এই ভীতি রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ভারতের সেই নীতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। গত মাসে তিনি নতুন করে ঘোষণা করেন, বিদেশি দক্ষ কর্মীদের জন্য বহুল ব্যবহৃত এইচ-১বি ভিসার ফি হবে এক লাখ ডলার। এই কর্মীদের অধিকাংশই ভারতীয়।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন জানে, ভারত এখন ব্যস্ত ও দুর্বল। তাই তারা মনে করতে পারে, এটাই সুযোগ ভারতের বিপরীতে সুবিধা নেওয়ার।’ রঞ্জনের মতে, বর্তমানে চারপাশের দেশগুলোর মধ্যে নয়াদিল্লির ভালো সম্পর্ক আছে মাত্র তিনটির সঙ্গে—শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাবও আছে, আর ভুটানের সীমান্তেও চীন ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে।
আঞ্চলিক জোটের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেটি স্পষ্ট হয়েছে গত মে মাসে। চীনের দেওয়া যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোয়েন্দা তথ্য সহায়তায় সীমান্ত সংঘাতে ভারতের ছয়টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, বরং অনেক সময় ভারতের প্রতি উদাসীন বা বিরূপ আচরণ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় মিত্রদের চোখে ভারতের একঘরে হয়ে পড়া শুধু চীনের জন্যই সুযোগ তৈরি করবে। এতে ভারত মহাসাগরে বেইজিং আরও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। বিশ্বে সমুদ্রপথে পরিবাহিত মোট জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশই যায় ভারত মহাসাগর দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সুশান্ত সিং বলেন, ‘এখানে অবশ্যই একটা আশঙ্কা আছে যে ভারতের চারপাশে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো একজোট হচ্ছে। আর ভারতের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, দিল্লির অবস্থান হলো—এসব পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখা এবং প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। বেইজিংয়ের লক্ষ্য হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, ‘নিরাপদ’ ও ‘সমৃদ্ধ’ এক অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। তাদের দাবি, কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে তৃতীয় কোনো দেশকে টার্গেট করার ব্যাপার নেই।
বাংলাদেশে চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে। ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয় গত বছর। এর পর থেকেই বেইজিং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরও ছিল বেইজিংয়ে, যেখানে তিনি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো বৈঠক হয়নি। এপ্রিলে ব্যাংককে এক আঞ্চলিক বৈঠকের ফাঁকে তাঁদের সামান্য কথোপকথন হয়েছিল। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। গত ডিসেম্বরে বেইজিং সফর চূড়ান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে নয়াদিল্লির কাছে দ্বিপক্ষীয় সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’
বাংলাদেশে কূটনৈতিক তৎপরতায় চীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের সাবেক প্রধান লিউ সিয়ানচাওয়ের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। লিউ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিতই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ ছাড়া, গত জুনে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিল ২৫০ জনের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল।
তবে চীনের দৃষ্টি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। গত জুনে বেইজিং কুনমিং শহরে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়। তিন দেশ যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণাও দেয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগস্টে সাংবাদিকদের জানান, শ্রীলঙ্কাও এ উদ্যোগে যোগ দিতে পারে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে গত জুনে চীনা গবেষক লিউ জোংই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বজুড়ে বড় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস চলছে।’ তিনি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
চীন-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহু পুরোনো। ১৯৬২ সালে হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্ক আরও খারাপ হয়। ২০২০ সালে সীমান্তে মারামারিতে উভয় পক্ষের সেনারা হতাহত হয়। এ বছরের মে মাসেও উত্তেজনা বাড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে চীনা অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায়। পারমাণবিক শক্তিধর চীন ও ভারত সম্প্রতি সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি কৌশলগত পদক্ষেপ। কারণ, দুই দেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে কাছে টানার প্রচেষ্টা শুধু অস্ত্র বিক্রিতে সীমাবদ্ধ নয়; তারা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। এ প্রচেষ্টার মূল হাতিয়ার হচ্ছে বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ (বিআরআই) অবকাঠামো কর্মসূচি।
চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে লিউ জোংই লিখেছেন, ‘ভারতের এমন নিজস্ব সামর্থ্য নেই যে তারা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু অন্য কোনো দেশ যদি প্রতিবেশীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে চায়, সেখানেও ভারত অনীহা দেখায়। কারণ, ভারত চায় তার ভূরাজনৈতিক আধিপত্য অটুট থাকুক।’
চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, চীন ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার বা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে না, বরং ভারতই সক্রিয়ভাবে চীনকে আটকে রাখতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দিয়ে। এর মধ্যে আছে ‘কোয়াড’, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে।
লিনের ভাষায়, ‘ভারতের মানসিকতা হলো—দক্ষিণ এশিয়াকে নিজের উঠান হিসেবে রাখা, এটিকে নিজের প্রভাববলয় হিসেবে ধরে রাখা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু চীনের উত্থান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর নেপালের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। তাই এখন দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে।’
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গভীর কিন্তু ভারতের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের হলো—বাংলাদেশে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তার। ভারতের ধারণা, ড. ইউনূসের সরকার ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে নরম অবস্থান নিয়েছে। আবার সরকারের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ, এতে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্তে (সেভেন সিস্টার্স) উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই রাজ্যগুলো সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডর (চিকেনস নেক) নিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
চলতি বছরের মার্চে বেইজিং সফরে ড. ইউনূস ভারতের এসব আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেন। তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ওই অঞ্চলকে সমুদ্রপথে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। ড. ইউনূস আরও বলেন, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ‘চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণের একটি অংশ’ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ আবারও চীনের সহায়তায় তিস্তা নদী ঘিরে সীমান্তবর্তী কৌশলগত এলাকা উন্নয়নের প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছে। পাশাপাশি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের সুযোগও দিয়েছে চীনকে।
বাংলাদেশ চীনের তৈরি জে-১০ ‘ভিগোরাস ড্রাগন’ যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই একই যুদ্ধবিমান পাকিস্তান বিমানবাহিনী ব্যবহার করে গত মে মাসে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। পাশাপাশি ভারত ভিত্তিক মিসইনফরমেশন মোকাবিলায়ও চীনের সহায়তা চেয়েছে ঢাকা—এমনটাই জানিয়েছেন ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠরা।
বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হবে।’ তাঁর মতে, এতে ভারতের ওপর চাপ তৈরি হবে। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল।
বাংলাদেশি থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানির বড় অংশই আসে চীন থেকে। চীন নরম শর্তে ও বাণিজ্যিক ঋণ দিয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে বিষয়টি বদলাচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক সম্পর্ক। অর্থাৎ ভারত থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে এগোনো।’
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতিও চীনের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিয়েছে বেইজিং, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে সুযোগ তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।’ অবশ্য পরে যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে।
চীনের আরেকটি বড় কূটনৈতিক উদ্যোগ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক পুনর্গঠন। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
চলতি বছরের শুরু থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান-চীন যৌথভাবে নির্মিত জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর সরাসরি বাণিজ্য সংযোগ পুনরায় চালু করেছে। আগস্টে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকা সফর করেন। এটি গত দশ বছরে ঢাকায় এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
যদিও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত বিষয়াবলি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে সকলেই মনে করছে, ১৯৭১ সালের বিষয়কে এড়িয়ে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব নয়।’
এদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগস্টের শুরুতে পাকিস্তান চীনের জেড-১০ এমই অ্যাটাক হেলিকপ্টার ফ্লিটে যুক্ত করেছে। চীনের এই হেলিকপ্টার প্রথম কোনো বিদেশি সেনাবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো।
একই মাসে চায়না শিপবিল্ডিং অ্যান্ড অফশোর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পিত আটটি হাঙর-ক্লাস ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তৃতীয়টি কমিশন করেছে। এই সাবমেরিনগুলো পাকিস্তানকে আরব সাগরে ভারতকে মোকাবিলায় বাড়তি সক্ষমতা দেবে।
পাকিস্তানের বিমানবাহিনী চীনের সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে তিন ডজনেরও বেশি জে-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, ‘চীনের অস্ত্র পাকিস্তানের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।’
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পুনর্মিলনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি পাকিস্তান ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্কেও মধ্যস্থতা করছে চীন। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি এবং চীনা কর্মীদের হত্যা, প্রায় ১০ লাখ আফগান শরণার্থীর পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের কারণে এই সম্পর্ক নাজুক হয়ে উঠেছে। চীন তালেবানকে আফগান মাটিতে থাকা উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
মে মাসের শেষ দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসলামাবাদ ও কাবুলের কাছে রাষ্ট্রদূত বিনিময় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সহযোগিতা গভীর করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। কার্যত বেইজিং কূটনীতিতে নয়াদিল্লিকে একঘরে করতে কাজ করছে, যদিও দুই দেশ প্রকাশ্যে তিক্ত সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।
ওয়াং ই গত আগস্টে দিল্লি সফর করেন, আর এর ১০ দিন পরই মোদি সাত বছরের মধ্যে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রথমবার চীন সফর করেন। সেখানে মোদিকে সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে দেখা যায়। সি তাঁকে বলেন, চীন ও ভারত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, অংশীদার’ এবং দুই দেশ এ মাস থেকে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০২০ থেকে স্থগিত ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সম্পর্কের উন্নতি ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই শুরু হয়েছিল এবং মূলত দুই পক্ষের বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই এখানে ভূমিকা রেখেছে। যেমন—ভারতের লক্ষ্য উৎপাদন ব্যবস্থার মান উন্নত করা, অ্যাপলের মতো কোম্পানির সরবরাহকারীদের আকর্ষণ করা, কিন্তু এর জন্য চীনা উপাদান ও দক্ষতার প্রয়োজন। এটি এমন সময় হচ্ছে যখন চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
স্টিমসন সেন্টারের মার্কি বলেন, ‘এটি একটি কৌশলগত, হিসাব-নিকাশ করে দেখানো আগ্রহ। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সম্পর্কিত কার্যক্রমে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে বের করার জন্য দুই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি ভারতের চীনের প্রতি অবস্থান বা উদ্বেগ পুনর্বিবেচনার বিষয় নয়।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্যাভেকালের বিশ্লেষক টম মিলার এক প্রতিবেদনে বলেন, ভারত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার ঐতিহাসিক ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’ নীতি অনুসরণ করছে। যার মাধ্যমে দেশটি ‘অনেক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে, কিন্তু কোনো একটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জুড়ে যাবে না’। তিনি বলেন, ‘চীন এখনো (ভারতের) শত্রু, তবে এরপরও এই যোগাযোগ অর্থনৈতিকভাবে (উভয় পক্ষের জন্য) সহায়ক হতে পারে।’
পুরোনো মিত্র চীনের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে ভারতের দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে, সেসবের একটি ধারণা দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম। গত আগস্টে বেইজিং সফরকালে নাহিদও সেই বইটি স্মারক উপহার হিসেবে পেয়েছেন, যেটি জামায়াত নেতা তাহেরের ডেস্কে রয়েছে। নাহিদ বলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ ‘নতুন রাজনৈতিক অভিমুখের’ অংশ। বেইজিং অনেক দূরদৃষ্টি নিয়ে ভাবছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘চীন আমাদের অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ, তারা মনে করে আমরা একটি তরুণ রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি এবং তারা মনে করে, আমরা বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে পারি।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে পুনর্লিখন করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
দক্ষিণ আর্মেনিয়ার এক পরিত্যক্ত রেলস্টেশন, মরিচা ধরা কয়েকটি বগি আর কয়েক মিটার রেললাইন—এসবই এখন সোভিয়েত যুগের একটি রেলপথের শেষ চিহ্ন। তবে অবিশ্বাস্য শোনালেও দক্ষিণ ককেশাসের এই ভাঙাচোরা রেললাইনই এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় শান্তির প্রতীক হয়ে উঠতে যাচ্ছে। এই শান্তি প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে...
১ ঘণ্টা আগেবাস্তবতা হলো, ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। ফলে, বিজেপি ও কংগ্রেস—সব দলের ভেতরেই এই সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিপুলভাবে আছেন। তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-বিজেপি ‘হিন্দুত্ব’ নামের রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী। হিন্দু ধর্মের ব্যাপক বিস্তৃত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জগত থেকে তারা দূরে।
১ দিন আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯ সেপ্টেম্বর গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য ২০ দফার এক শান্তি প্রস্তাব দেন। এরপর থেকেই তিনি হামাসকে একাধিক আলটিমেটাম দিয়েছেন। শুরুতে তিনি ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে উত্তর দিতে বলেন।
২ দিন আগেজাপানের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় রচনা করতে চলেছেন সানায়ে তাকাইচি। ৬৪ বছর বয়সী এই নারী পুরুষপ্রধান লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) নেতৃত্বের দৌড়ে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছেন। এতে জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন তিনি।
২ দিন আগে