Ajker Patrika

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন

গণভোটে একমত দলগুলো

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে গতকাল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনের সদস্যরা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের দ্রুত সুপারিশ চূড়ান্ত করার তাগিদ দেন। ছবি: প্রেস উইং
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে গতকাল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনের সদস্যরা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের দ্রুত সুপারিশ চূড়ান্ত করার তাগিদ দেন। ছবি: প্রেস উইং

গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে মত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু সেই গণভোটের প্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে মতভিন্নতা।

জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোটের কথা বলেছে বিএনপি। তবে সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

অন্যদিকে বিশেষ সংবিধান আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে নির্বাচনের আগেই গণভোট করার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, গণভোটের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল রোববার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে চতুর্থ দিনের মতো আলোচনায় বসে দলগুলো। সেখানে দলগুলো এ বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরে।

বেলা সাড়ে ১১টার পর কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হয়। দুপুরে ১ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫টার পর সভা মুলতবি করা হয়। মুলতবি বৈঠক আগামী ৮ অক্টোবর বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে।

এদিনের আলোচনার শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর সামনে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করেনি কমিশন; বরং দলগুলোর নেতারা দলীয় অবস্থান ব্যক্ত করেন। সেখানে অধিকাংশ দলই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পক্ষে মত দেয়। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালটে গণভোটের কথা বলে। একই সঙ্গে তারা গণভোটে তাদের আপত্তির (নোট অব ডিসেন্ট) কথা রাখার পক্ষে মত দেয়।

জামায়াতের পক্ষ থেকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য প্রথমে সংবিধান আদেশ এবং পরে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার কথা বলা হয়। তবে তারা আপত্তির কথা উল্লেখের পক্ষে নয়।

গণভোটের আগে জুলাই সনদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের দাবি করে এনসিপি। একই সঙ্গে নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে সংবিধান সংস্কারসহ দ্বৈত ভূমিকা দেওয়ার পক্ষে মত দেয় দলটি। বিষয়টিতে গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলোরও সমর্থন রয়েছে।

বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। আমরা এটিকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি।’

গত ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জুলাই সনদ-সংক্রান্ত জট খুলতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল বিএনপি। একই সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সমাধানের পর গণভোট করার কথাও বলেছিল দলটি। গতকালের বৈঠকে গণভোট নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করে বিএনপি। এতে সংবিধান আদেশ এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে মত দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করতে হলে সংবিধান আদেশ বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ জনগণ হচ্ছে সুপ্রিম। সংবিধান আদেশ জারি করার এখতিয়ার এই সরকারের নেই। সেটা থাকলে তারা আলোচনা ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করতে পারত।’

জাতীয় নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালটে জুলাই সনদের বিষয়ে গণভোট নেওয়ার কথা বলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। সে ক্ষেত্রে জনরায় পক্ষে এলে বাস্তবায়ন করাটা বাধ্যতামূলক হবে বলে মনে করেন তিনি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সার্বভৌম ক্ষমতার একটা রায় সেখানে প্রতিফলিত হবে।’ যার ভিত্তিতে পরবর্তী জাতীয় সংসদ সংবিধান সংস্কারে জনরায় পাবে বলে মনে করেন বিএনপির এই নেতা। নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সনদের সংবিধানসম্পর্কিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পক্ষে দলটি।

দেশের বিদ্যমান সংবিধানে গণভোটের ক্ষমতা নেই জানিয়ে এ বিষয়ে গতকালের সকালের অধিবেশনে সালাহউদ্দিন বলেন, গণভোট করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে না। শুধু আরপিও সংশোধন করে ইসিকে গণভোট আয়োজনের ক্ষমতা দিলেই হবে।

এর আগে আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘যেহেতু সবাই একমত হতে পারছেন না, তাই এগুলো গণভোটে দেওয়া যায়। জনগণ যে রায় দেবে, সেটা তাঁরা মানবেন। সংবিধান আদেশের মাধ্যমে যাই। শক্তিশালী হবে। গণভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে। আরপিও সংশোধন করা খুব সহজ, এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের প্রস্তাবের সঙ্গে তিনি একমত।

হামিদুর রহমান বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সনদের ভেতরই থাকবে। জুলাই সনদ গ্রহণ করা হবে কি না, এটা নিয়ে হবে গণভোট। সেটার ভিত্তিতে হবে জাতীয় নির্বাচন। আগে গণভোট হয়ে যাক।’

ফেব্রুয়ারিতে ভোটের আগে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে বলে মনে করেন আযাদ। তিনি বলেন, গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই।

নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ভিন্নমত বা ডিসেনডিং ফোর্স বাইন্ডিং নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলায় বিচারপতিরা ৪:৩ রায় দিয়েছিলেন। সেখানে চারজনের সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।

আলোচনায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, গণভোটের আগে অবশ্যই জুলাই সনদকে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনতে হবে। সুনির্দিষ্ট করতে হবে, কত দিনের মধ্যে কী হবে। আগামী নির্বাচন অন্যান্য জাতীয় নির্বাচনের মতো হবে না, এটা হবে আলাদা। তাদের মৌলিক কাজ হবে মৌলিক পরিবর্তন আনা। তিনি বলেন, প্রথমে সংবিধান আদেশ বা এলএফও যে নামেই হোক, ঘোষণা দিতে হবে। সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিরা দ্বৈত ভূমিকা পালন করবেন। সংবিধান সংস্কার তাঁদের এখতিয়ারে থাকবে।

সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন আইনসভার কাঠামো সম্পর্কেও আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে, সেটিকে এমন বৈশিষ্ট্য দিতে হবে, যাতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংশোধনগুলো সহজে সম্পন্ন করা যায়। এ বিষয়েও কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো একমত।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশন সদস্যদের বৈঠক

কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে গতকাল সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশন সদস্যরা। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ জানান, কমিশনের অগ্রগতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে অবহিত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা দ্রুততার সঙ্গে সুপারিশ চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়েছেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে দিতে কমিশন আশাবাদী। এরই মধ্যে আলোচনায় যুক্ত ৩০টি দলের তিন-চতুর্থাংশ দলের পক্ষ থেকে সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রতিনিধিদের নামও কমিশনের হাতে পৌঁছেছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জুলাই সনদ কেন্দ্র করে সরকারঘোষিত ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কমিশনকে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্যদিকে, কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে বাস্তবায়নের উপায় প্রধান উপদেষ্টাকে ঠিক করতে বলা হয়েছে। বিষয়টিতে প্রধান উপদেষ্টাকে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মাকে ৩৬ কোটি টাকার শেয়ার উপহার দিচ্ছেন মির্জা আব্বাসের ছেলে

বিশ্বের প্রথম ‘বিটকয়েন জাতি’ এল সালভাদরের ভাগ্যে কী আছে

গাজায় ক্ষমতা না ছাড়লে হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার হুমকি ট্রাম্পের

সংসদ নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালটে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোটের প্রস্তাব বিএনপির

হাসনাত-হাসিবউদ্দীনের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ৭১ সদস্যের কমিটি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত