রাজিউল হাসান, ঢাকা
২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:
২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:
সাহারা মরুভূমির প্রান্তবর্তী ইউরেনিয়ামে সমৃদ্ধ দেশ নাইজারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে চায় রাশিয়া। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরইমধ্যে এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় জ্বালানি সংস্থা রোসাটম এবং নাইজার কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি অনুযায়ী...
১৪ ঘণ্টা আগেকিন্তু আরাকান আর্মি এখনো সেই অর্থে সিতওয়ে ও কায়াকফিউতে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালায়নি। কিন্তু কেন? এর পেছনে রয়েছে তিনটি কৌশলগত কারণ—কায়াকফিউতে চীনের বড় বিনিয়োগ, সিতওয়েতে ভারতের বিনিয়োগ এবং স্থানীয় জনগণের কাছে রাজনৈতিক বৈধতা ও শাসন কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এএ–এর অগ্রাধিকার।
২ দিন আগেআগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের আগেই নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামোতে নীরবে বড়সড় পরিবর্তন এনেছেন। আগের তুলনায় বিজেপির নির্বাচনী রণনীতি এবার অনেকটাই ভিন্ন।
৩ দিন আগেআন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বে লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে বিশ্বের অন্য দেশগুলো নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে প্রায়ই লবিং ফার্ম নিয়োগ দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে খবর এসেছে, বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টায় বিপুল...
৩ দিন আগে