Ajker Patrika

চিকিৎসক হওয়ার আগেই শীর্ষ সবার শীর্ষে

 রিমন রহমান, রাজশাহী
শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ান। আজ বুধবার দুপুরে রামেক হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ান। আজ বুধবার দুপুরে রামেক হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা

এমবিবিএস শেষে ইন্টার্নশিপ করছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। অথচ যে উদ্যোগ ও উদ্যম তিনি দেখিয়েছেন, তা স্বাভাবিকভাবে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। শীর্ষ শ্রেয়ান নামের এ তরুণ চিকিৎসক দাতা সংস্থার সহায়তায় স্ট্রোক ও হৃদ্‌রোগীদের জন্য সংগ্রহ করেছেন ১৭ কোটি টাকার ওষুধ।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিমত, ইন্টার্ন চিকিৎসক হয়েও উদ্যোগের দিক দিয়ে শীর্ষ সবার শীর্ষে। এ হাসপাতালের আর কোনো ইন্টার্ন চিকিৎসক কখনো এটি করে দেখাতে পারেননি। ইন্টার্ন চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ানের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। বাবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাই তাঁর বেড়ে ওঠা সাভারে। শীর্ষ রামেকে ভর্তি হন ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে। জুলাইয়ে এমবিবিএস শেষ করে এখন ইন্টার্নশিপ করছেন।

শীর্ষের কারণে রামেক হাসপাতাল গত সোমবার (২৫ আগস্ট) আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে আড়াই হাজার ভায়াল অ্যাল্টেপ্লেস পেয়েছে। অ্যাল্টেপ্লেস হলো একটি থ্রোমবোলাইটিক ওষুধ, যা সাধারণত স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ফলে রক্তনালিতে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত মুক্ত করতে ইনজেকশন আকারে ব্যবহার করা হয়। এটি রক্তের মধ্যে জমে থাকা থ্রম্বাস বা ব্লক দূর করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতেও সাহায্য করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আড়াই হাজার ভায়াল অ্যাল্টেপ্লেস বিনা মূল্যে পেয়েছে; যার দাম প্রায় ১৭ কোটি টাকা।

চিকিৎসকেরা জানান, বাংলাদেশে শুধু একটি কোম্পানি এই ওষুধ বাজারজাত করে। ৫০ মিলিগ্রামের ইনজেকশন ও ইনফিউশনের প্রতি ভায়ালের দাম পড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। রোগীর ওজন ৬০ কেজির বেশি হলে প্রয়োজন পড়ে দুই ভায়াল। স্ট্রোকের রোগীদের রক্ত জমাট বেঁধে গেলে সাড়ে ৪ ঘণ্টা ও হৃদ্‌রোগীদের সাড়ে ১২ ঘণ্টার মধ্যে এটি প্রয়োগ করতে হয়। দরিদ্র অনেক রোগীরই দামি এই ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই।

কীভাবে পাওয়া গেল: স্ট্রোক প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও তা নিয়ে গবেষণা করে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএসও)। এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শীর্ষ শ্রেয়ান তাদের একটি গবেষণা দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ওই গবেষণা প্রকল্পে গবেষণা সহকারী ছিলেন শীর্ষ। পরে গবেষণাপত্রটি জার্নালে প্রকাশিত হয়। এটি ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেরা গবেষণা নির্বাচিত হয়।

এটি দেখে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ডিরেক্ট রিলিফের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক গর্ডন উইলকক অস্ট্রেলিয়া থেকে গত মার্চে শীর্ষকে ই-মেইল করেন। এতে জানানো হয়, তারা রামেক হাসপাতালকে অ্যাল্টেপ্লেস অনুদান দিতে চান। সেটি নেওয়া, সংরক্ষণ করা ও রোগীদের প্রয়োগের মতো সক্ষমতা এ হাসপাতালের আছে কি না। ইন্টার্ন চিকিৎসক শীর্ষ তখন বিষয়টি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আজিজুল হক আযাদের সঙ্গে আলাপ করেন। পরে গর্ডন উইলককের সঙ্গে তাঁরা ভার্চুয়াল বৈঠক করেন।

অধ্যাপক আজিজুল হক আযাদ আলাপকালে গর্ডন উইলকককে জানান, এই ওষুধ শুধু স্ট্রোকের রোগীদের জন্য দেওয়া হলে তাঁদের নিয়ে লাভ হবে না। কারণ, অধিকাংশ স্ট্রোকের রোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে আসেন। তাঁদের ক্ষেত্রে ওষুধটা ব্যবহার করা যাবে না। হৃদ্‌রোগীদের ক্ষেত্রে সাড়ে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। যদি স্ট্রোক ও হৃদ্‌রোগী—উভয়কে ওষুধটি প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা সেগুলো নেবেন। কয়েক দিন পর গর্ডন উইলকক এতে রাজি হয়ে ওষুধগুলো সরবরাহ করতে চান। এরপর ডিরেক্ট রিলিফের সঙ্গে রামেক হাসপাতালের চুক্তি হয়। গর্ডন উইলকক প্রথমে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ই-মেইলে, সেটি রামেক হাসপাতালে পাঠান। সেটি প্রিন্ট করে হাসপাতালের পক্ষে স্বাক্ষর করেন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ। এরপর আবার চুক্তিপত্রটি স্ক্যান করে গর্ডন উইলককের কাছে পাঠানো হয়।

জটিলতা দেখা দেয় বিমানবন্দরের শুল্কছাড় ও ঢাকা থেকে রাজশাহীতে ওষুধ আনা নিয়ে। আজিজুল হক আযাদ অনুরোধ করেন, সবকিছুই যেন করা হয় ডিরেক্ট রিলিফের পক্ষ থেকে। গর্ডন উইলকক তাতে সাড়া দেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই ২০ আগস্ট এই ওষুধ ঢাকায় আসে। এরপর একটি ফ্রোজেন ভ্যানে করে ২৫ আগস্ট ওষুধ আসে রাজশাহী। আজ বুধবার (২৭ আগস্ট) থেকে বিনা মূল্যে রোগীদের এই ইনজেকশন প্রয়োগ করা হচ্ছে।

শীর্ষকে নিয়ে গর্বিত সবাই: রোগীদের জন্য শীর্ষ শ্রেয়ানের এমন ভূমিকায় খুশি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফয়সাল আলম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি অত্যন্ত খুশি। এর আগে শিক্ষকেরা অনেক ফান্ড বাইরে থেকে এনেছেন, কিন্তু আমার জানামতে কোনো শিক্ষার্থী পারেনি। এটা শীর্ষ করে দেখিয়েছে। এটা অভাবনীয়। আমি তাকে নিয়ে গর্বিত। আমি আশা করব, এভাবেই যেন ছাত্ররা ভালো কাজে উৎসাহিত হয়। রোগীদের জন্য, মানুষের জন্য অবদান রাখে।’

শীর্ষ শ্রেয়ানের মেন্টর অধ্যাপক আজিজুল হক আযাদ বলেন, ‘শীর্ষ যখন আমাকে বিষয়টা জানাল, তখন থেকে আমিও বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম। আমরা রোগীদের জন্য এটা করতে চেয়েছিলাম। এটা যে রোগীরা একেবারে বিনা মূল্যে পাচ্ছেন। অথচ অনেক দামি বলে অনেকেই কিনতে পারেন না। তারপরও এই ওষুধ একেবারেই অরিজিনাল। অনেক ভালো। আমরা সত্যিই শীর্ষকে নিয়ে গর্বিত। এটা অন্যদের উৎসাহিত করবে।’

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ জানালেন, আজ থেকে এই ওষুধ রোগীদের বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। খবর নিয়ে জেনেছেন, বিকেল পর্যন্ত ৭০টি ভায়াল ব্যবহার হয়েছে। তিনি বলেন, এ কৃতিত্ব শীর্ষর। সে অত্যন্ত মেধাবী।

ওষুধগুলো আনতে পেরে খুশি শীর্ষও। সময়মতো এই ওষুধ রোগীদের প্রয়োগ করতে চান তিনি। তাই স্ট্রোক কিংবা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে আসার তাগিদ দিলেন। বললেন, ‘এখন ভালো লাগা কাজ করছে। সবচেয়ে ভালো লাগবে, যদি রোগীরা দ্রুত হাসপাতালে আসেন। কারণ, রোগীদের মাঝে দ্রুত হাসপাতালে আসার প্রবণতা কম। যদি কেউ দেখেন, এক পাশের হাত-পা অবশ হয়ে গেছে, মুখ বেঁকে গেছে, চোখের পাতা পড়ে গেছে কিংবা কথা অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে আসুন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাইপলাইনে জ্বালানি পরিবহন: ৩৪ হাজার লিটার ঘাটতি যমুনার প্রথম পার্সেলে

১টা বাজলেই আর স্কুলে থাকে না শিক্ষার্থীরা, ফটকে তালা দিয়েও ঠেকানো গেল না

চিকিৎসক হওয়ার আগেই শীর্ষ সবার শীর্ষে

আসামে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বহাল থাকবে দুর্গাপূজা পর্যন্ত

ভিকারুননিসায় হিজাব বিতর্ক: বরখাস্ত শিক্ষককে পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত