Ajker Patrika

রাখাইনে চীন-ভারতের স্বার্থ বাঁচিয়ে যে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করছে আরাকান আর্মি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ৫৭
রাখাইনে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করার পথে হাঁটছে আরাকান আর্মি। ছবি: দ্য ইরাবতীর সৌজন্যে
রাখাইনে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করার পথে হাঁটছে আরাকান আর্মি। ছবি: দ্য ইরাবতীর সৌজন্যে

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মুখপাত্র খাইন থুকা সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন যে, রাজ্যের কায়াকফিউ টাউনশিপে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। কারণ, মিয়ানমারের ‘সন্ত্রাসী’ সেনারা পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন ও বিমান হামলা।

খাইন থুকা জোর দিয়ে বলেন, এএ–এর রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরো রাখাইন রাজ্যকে জান্তাবাহিনীর হাত থেকে ‘মুক্ত’ করা। এ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, এখনো এএ–এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে তিনটি টাউনশিপ—রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে, কায়াকফিউ এবং মানাউং।

কিন্তু আরাকান আর্মি এখনো সেই অর্থে সিতওয়ে ও কায়াকফিউতে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালায়নি। কিন্তু কেন? এর পেছনে রয়েছে তিনটি কৌশলগত কারণ—কায়াকফিউতে চীনের বড় বিনিয়োগ, সিতওয়েতে ভারতের বিনিয়োগ এবং স্থানীয় জনগণের কাছে রাজনৈতিক বৈধতা ও শাসন কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এএ–এর অগ্রাধিকার।

কায়াকফিউ: চীনা ফ্যাক্টর

কায়াউকফিউতে চীনের একাধিক বড় প্রকল্প আছে। এর মধ্যে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি পাইপলাইন অবকাঠামো এবং ১৮০ মিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎকেন্দ্র।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো ইন্টারন্যাশনাল রাখাইনের শ্বে গ্যাস ফিল্ডের চতুর্থ ধাপের জন্য ৫২৩ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি দেয় চায়না অফ শোর অয়েল ইঞ্জিনিয়ারিংকে। এ কারণে হাজার হাজার চীনা শ্রমিক সেখানে কাজ করছে এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেয়েছে বেসরকারি চীনা নিরাপত্তা কোম্পানি। এ জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন, ইলেকট্রনিক জ্যামার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চারপাশে মাইন।

এমন পরিস্থিতিতে এএ যদি কায়াকফিউতে পূর্ণ আক্রমণ চালায়, তাহলে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি চীনা নাগরিক ও নিরাপত্তা কর্মীদের প্রাণহানি ঘটতে পারে। এতে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। এমনকি এএ শহরটি দখল করতে পারলেও তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৌ হামলার ঝুঁকি থেকেই যাবে।

তাই সরাসরি আক্রমণের পরিবর্তে এএ কায়াকফিউকে অবরোধ করে রেখেছে। তারা জান্তা সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করতে চায় আলোচনার মাধ্যমে, ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে নয়।

সিতওয়ে: ভারত ফ্যাক্টর

রাখাইনের রাজধানী সিতওয়েতে রয়েছে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। এর মধ্যে সিতওয়ে বন্দর এবং কালাদান মাল্টি-মডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) উল্লেখযোগ্য। প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলারের ভারতীয় অনুদানে নির্মিত এই বন্দর চালু হয় ২০২৩ সালের মে মাসে। তখন কলকাতা থেকে আসা প্রথম মালবাহী জাহাজ সেখানে ভেড়ে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।

কলকাতা থেকে সিতওয়ে বন্দর হয়ে কালাদান নদীপথে মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতওয়া পর্যন্ত, আর সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পণ্য পরিবহন হবে। আরাকান আর্মি ২০২৩ সালে পালেতওয়া ও কালাদান নদীর পাশের টাউনশিপগুলো দখল করলে ভারত সরাসরি গোষ্ঠীটির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এতে চীনের পর ভারতও এএ–এর সঙ্গে যোগাযোগ করা দ্বিতীয় বড় শক্তি হয়ে ওঠে।

এরপর, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর সিতওয়েতে গিয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন। তিনি প্রকল্পটি ২০২৭ সালে চালুর লক্ষ্যে ভারতের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে খাইন থুকা বলেন, এএ ভারতকে কালাদান প্রকল্প শেষ করতে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মিয়ানমার সেনারা রাখাইনে পণ্য প্রবাহ বন্ধ করে দিলে এএ নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও স্থানীয় জনগণ ভারত থেকে আসা ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আরাকান আর্মি সিতওয়েতে আক্রমণ চালালে ভারতীয় অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি ভারতের সীমান্ত বাণিজ্য সীমিত করার ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই কায়াকফিউর মতো সিতওয়েতে এএ সরাসরি আক্রমণ না চালিয়ে অবরোধ কৌশল নিয়েছে।

এএ–এর আরেকটি কৌশল হলো—রাজনৈতিক বৈধতা পাওয়া ও একটি বৈধ, গ্রহণযোগ্য শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা। এরই মধ্যে রাখাইনের ১৪টি টাউনশিপ ও চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপ এএ–এর নিয়ন্ত্রণে। এসব দখলের আট মাস পেরিয়ে গেছে। এখন তাদের চ্যালেঞ্জ হলো বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠীর এলাকায় প্রশাসন চালানো।

তবে এই সময়ের মধ্যে এএ–এর শাসন নিয়ে সমালোচনা বেড়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ও চিন জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। ২০২৫ সালের মার্চে এএ বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগের আইন চালু করার পর সমালোচনা তীব্র হয়। অভিযোগ উঠেছে, এএ রোহিঙ্গা মুসলমানদের জোরপূর্বক তাদের বাহিনীতে ভর্তির চেষ্টা করছে। এ মাসে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয়, এএ ৬০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। যদিও মুখপাত্র খাইন থুকা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

চিন রাজ্যের পালেতওয়াতেও এএ–এর বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার, যৌন সহিংসতা, জোরপূর্বক নিয়োগ ও আদিবাসী চিন জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় সংগঠনগুলো। গ্লোবাল খুমি অর্গানাইজেশন, চিন হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন (সিএইচআরও) ও চিন পলিটিক্যাল স্টিয়ারিং কমিটি (সিপিএসসি) বারবার এএ–এর কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে।

এই বৈধতা ও শাসন সংকট এএ–এর অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে। সরাসরি নতুন আক্রমণে যাওয়ার বদলে এএ এখন শাসনব্যবস্থা সুসংহত করা ও জনগণের আস্থা অর্জনের দিকে মন দিচ্ছে। উত্তর শান রাজ্যে তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) মতো অন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোরও একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

এএ এখন এমন কৌশল নিয়েছে, যাতে জান্তাবাহিনী পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা না করতে পারে। ৩১ জুলাই জান্তা সেনারা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, যেখানে তারা এএ–নিয়ন্ত্রিত সব টাউনশিপের নাম তালিকাভুক্ত করে। ১৫ আগস্ট নির্বাচন কমিশন এসব টাউনশিপকে আসন বণ্টনে অন্তর্ভুক্ত করে।

খাইন থুকা বলেন, কোনো টাউনশিপ জান্তাবাহিনীর ফেরত দেওয়া হবে না, আর এএ–এর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোনো নির্বাচনও হতে দেওয়া হবে না। এএ এখন মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে সেনাদের আগ্রাসন ঠেকাতে মনোযোগ দিচ্ছে—

১. মগওয়ে অঞ্চলের অ্যান–প্যাদান করিডর, যা রাখাইন ও মগওয়ে যুক্ত করে ২. বাগো অঞ্চলের টাউংউপ–পান্ডাউং করিডর, যা রাখাইন ও বাগোকে যুক্ত করে এবং আয়েরওয়াদি অঞ্চলের গওয়া–উঙাথাইংচাউং করিডর, যা রাখাইন ও আয়েরওয়াদিকে যুক্ত করে।

এদিকে জান্তাবাহিনী কায়াকফিউতে আরাকান আর্মির ওপর হামলা বাড়াচ্ছে এবং শিগগিরই সিতওয়েতেও নতুন অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থায় এএ এখন অপেক্ষা করছে—হয় জান্তাবাহিনী আলোচনার মাধ্যমে সেনাদের প্রত্যাহার করবে, অথবা জাতীয় পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে একযোগে ‘থার্ড ওয়েভ বা তৃতীয় ঢেউ’ অভিযান চালাবে।

তথ্যানুসারে, এই ‘তৃতীয় ঢেউ’ হবে সমন্বিত জাতীয় অভিযান, যা ২০২৩ সালের অক্টোবরের অপারেশন ১০২৭ এবং ২০২৪ সালের দ্বিতীয় দফার আক্রমণের (জুন–ডিসেম্বর) পরবর্তী ধাপ। এগুলো শুরু করেছিল এএ, টিএনএলএ এবং এমএনডিএএ–এর যৌথ ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স।

সব মিলিয়ে আপাতত এএ–এর কৌশল হলো—নতুন আক্রমণ না চালিয়ে জান্তাবাহিনীর পাল্টা হামলা ঠেকানো, নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অবস্থান সুসংহত করা এবং জনগণের আস্থা অর্জনে মনোযোগী হওয়া।

তথ্যসূত্র: দ্য ইরাবতী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত