Ajker Patrika

তরুণদের মধ্যে নিজস্ব পাঠ্যক্রমে বই পড়ার প্রবণতা বাড়ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
এই পড়াশোনায় নেই কোনো গ্রেড, নেই কোনো কঠোর সময়সীমা। ছবি: সংগৃহীত
এই পড়াশোনায় নেই কোনো গ্রেড, নেই কোনো কঠোর সময়সীমা। ছবি: সংগৃহীত

মাস্টার্স শেষ করার পর ক্লেয়ার ইয়েওরের কেটে গেছে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়। পিয়ানো পারফরম্যান্সে ডিগ্রি নেওয়ার পর এবার আবারও ‘সেমিস্টার’ শুরু করেছেন তিনি। তবে সেটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, নিজের ঘরে।

এবার নিজের জন্য একাডেমিক সেমিস্টার সাজিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী সিঙ্গাপুরের এই কপিরাইটার। পাঠ্যতালিকায় রয়েছে ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ ও ‘দ্য ইডিয়ট’, উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘দ্য টেম্পটেস্ট’ এবং হান্না আরেন্টের ‘ইচম্যান ইন জেরুজেলাম: এ রিপোর্ট অন দ্য ব্যানালিটি অব ইভিল’।

দিনের চাকরির বাইরে প্রতি রাতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় দেন ইয়েও। পড়েন, নোট নেন, নায়ক আর খলনায়কদের ধারণা মানুষের মধ্যে কীভাবে গড়ে ওঠে, তা বোঝার চেষ্টা করেন। বছরের শেষে লেখার পরিকল্পনা রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন হাওয়া: ‘পারসোনাল কারিকুলাম’

ক্লেয়ার ইয়েওর মতো অনেকে এখন সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন এক ইতিবাচক ট্রেন্ডে যোগ দিচ্ছেন—‘পারসোনাল কারিকুলাম’। টিকটক ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বহু তরুণ এখন নিজেরাই নিজেদের জন্য সাজিয়ে নিচ্ছেন সিলেবাস, তৈরি করছেন পড়ার তালিকা। কেউ কেউ পড়ছেন পুঁজিবাদ কীভাবে নারীদের আত্মপরিচয়ে প্রভাব ফেলে, কেউ শিখছেন কোরিয়ান ভাষা, আবার কেউ গবেষণা করছেন চকলেট চিপ কুকির (একধরনের বিস্কুট) রেসিপি নিয়েও।

এই পড়াশোনায় নেই কোনো গ্রেড, নেই কোনো কঠোর সময়সীমা—আছে কেবল শেখার আনন্দ আর আত্মতুষ্টি।

এই প্রবণতা অনেকের কাছে ‘ব্রেইন রট’ বা মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত নিজের পারসোনাল কারিকুলাম শেয়ার করলেও ক্লেয়ার ইয়েও প্রতিদিন রাত ৯টার পর ফোন হাতেই নেন না। তখন কেবল বই, পৃষ্ঠা আর চিন্তার সঙ্গেই সময় কাটে তাঁর।

ইয়েও বলেন, এই ৯০ সেকেন্ডের ক্লিপগুলোর ঝাঁজ এতটাই বেশি যে চোখ-মাথা অবশ হয়ে আসে। মানুষ এখন ধীরে চলতে চাইছে।

আবার পড়ালেখায় ফিরে আসা

টিকটকে এ পারসোনাল কারিকুলাম ট্রেন্ডের সূচনা হয় এলিজাবেথ জিন নামের এক সৃষ্টিশীল তরুণীর হাত ধরে।

৩২ বছর বয়সী এলিজাবেথ জানান, ছোটবেলা থেকেই কৌতূহলী স্বভাবের হলেও স্কুলে বরাবরই তিনি অনিরাপত্তায় ভুগতেন। পড়ালেখা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল ভয় আর অস্বস্তির নাম। এখন নিজেই নিজের সিলেবাস তৈরি করে সেই পুরোনো ভালো লাগাগুলো ফিরে পাচ্ছেন।

এলিজাবেথ বলেন, ‘যখন ইচ্ছা পড়ি, যখন ইচ্ছা বিরতি নিই। এতে আমার মনটা খুব শান্তি পায়।’

গত জুনে তিনি পড়েছেন এসথার ও জেরি হিকসের ‘মানি অ্যান্ড দ্য ল অব অ্যাটরাকশন’, জুলিয়া ক্যামেরনের ‘দ্য আর্টিস্টস ওয়ে’ এবং জেন সিনসেরোর ‘ইউ আর আ ব্যাডঅ্যাস’। আর জুলাইয়ে শেখেন বেকিং, আবার পড়েছেন আধ্যাত্মিকতা, সাইকোলজি, স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস সম্পর্কিত নানা বই। চলতি মাসে পড়ছেন জন গ্রিনের ‘এভ্রিথিং ইজ টিউবারকিউলোসিস’। সে সঙ্গে দেখছেন ২০১৫ সালের ডকুমেন্টারি ‘দ্য ফরগেটেন প্লেগ’।

টিকটকে নিজের এই পাঠপরিকল্পনা শেয়ার করার পর অনেকেই জানতে চান—তিনি কীভাবে এই তালিকা তৈরি করেন, কীভাবে সময় বের করেন।

এলিজাবেথ বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমি যেহেতু এলোমেলোভাবে এসব করছি, অন্যরাও সাহস পাচ্ছে কিছু এলোমেলোভাবে শুরু করার।’

একঘেয়েমি থেকে মুক্তি, মনোযোগ ফেরানোর প্রচেষ্টা

এই ট্রেন্ডের পেছনে রয়েছে আধুনিক জীবনের জটিলতা। সারা দিনের দৌড়ঝাঁপ, সোশ্যাল মিডিয়ার শব্দ—এসবের মধ্যে মনোযোগ ধরে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকের জন্য।

কলেজ শেষ করে যখন এলিনর কাং কাজ শুরু করেন, তখন দিনের শেষের দিকে শুধু মোবাইল ফোন স্ক্রল করে সময় কাটাতেন তিনি। পুরোনো সিরিজ ‘গ্রেস অ্যানাটমি’ একাধিকবার দেখে ফেলেন।

সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে কাং বলেন, ‘জীবনটা যেন অর্থহীন লাগছিল। নিজের মতামত গঠন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলাম। সবকিছু কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল, আর তা ভীতিকর ছিল।’

নিজের দাদার আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ ও চ্যাটজিপিটির ওপর মানুষের অতিরিক্ত নির্ভরতা দেখে তিনি আরও সচেতন হন।

ফলে নিজেই তৈরি করেন একটি ‘সাবস্ট্যাক’ (Substack) সিরিজ: হাও টু গেট স্মার্ট অ্যাগেইন। সেখানে তিনি নিজের অভ্যাসগুলো ভাগ করেন—প্রতিদিন একটি প্রবন্ধ পড়া, পুরোনো টিভি সিরিজ দেখা কমিয়ে দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের সিনেমা দেখা, নিজের জন্য পাঠ্যসূচি তৈরি ইত্যাদি। সিরিজের প্রথম পোস্টই ৪০ হাজারের বেশি লাইক পায়।

উল্লেখ্য, দ্য ক্রাইটেরিয়ন কালেকশন (Criterion Collection) হলো একটি প্রিমিয়াম চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, যা শিল্পমানসম্পন্ন, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্রগুলো সংগ্রহ এবং বিশেষ সংস্করণে প্রকাশ করে থাকে।

ক্লেয়ার ইয়েও নিজেও এই বছরের শুরুতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। এ বিরতি নেওয়ার মাধ্যমে নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও চিন্তাভাবনা বুঝে নেন।

এক মাস আগে আবার যখন তিনি অনলাইনে ফিরে আসেন, দেখেন অনেকেই ঠিক তাঁর মতোই ব্যক্তিগত পড়াশোনার দিকে ঝুঁকছেন।

পড়াশোনার কাঠামো, তবে চাপহীন

পারসোনাল কারিকুলাম অনেকটাই যেন শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো, তবে নেই কোনো শিক্ষক বা সহপাঠী।

তবে একে অনেকে সামাজিক অভিজ্ঞতায় রূপ দিচ্ছেন। ক্লেয়ার ইয়েওর ‘ভালো ও মন্দ’-বিষয়ক পাঠ্যক্রম এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, তিনি এখন একটি সাপ্তাহিক বুক ক্লাব চালু করেছেন। এই ক্লাবে বই নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রথম সেশনে যোগ দিয়েছিলেন শত শত পাঠক। বুক ক্লাবের আলোচনা এগিয়ে নিতে গিয়ে পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগী হয়েছেন।

অনেকের মতে, পারসোনাল কারিকুলাম হয়তো একটা অস্থায়ী সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড। একাডেমিক জবাবদিহি না থাকায় কেউ কেউ মাঝপথে থেমেও যেতে পারেন।

তবুও যখন চারপাশে মূর্খতা আর তথ্যভিত্তিক চিন্তার অভাব প্রকট, তখন মানুষের মধ্যে নতুন করে শেখার আগ্রহ দেখা সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে করেন ইয়েও।

ইয়েও বলেন, ‘এটা এমন নয় যে কেউ চাকরিতে প্রমোশন পেতে পড়ছে। মানুষ যখন দার্শনিক প্রশ্নে ডুব দেয়, তখন মনে হয়, মানবিকতা এখনো হারিয়ে যায়নি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত