Ajker Patrika

শিশু শফিকুলের মুক্তিযুদ্ধ

রেহানা পারভীন
শিশু শফিকুলের মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক, এমনকি যুদ্ধকালীন শিশুদের মনেও রয়েছে এর ভিন্ন ভিন্ন ক্ষত। শিশুমনে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব কেমন ছিল, তা নিয়ে বৃহৎ পরিসরে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো কাজ হয়েছে বলে জানা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও শিশুমনে এর প্রতিক্রিয়া নিঃসন্দেহে সে সময়ে শিশুর পরিবারের সামাজিক অবস্থান এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কেননা, শিশুরা কোনো বিষয় সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করতে যেমন পারে না ঠিকই, তবে তাদের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাও তাদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এমন এক শিশুর কথা–জয়পুরহাট সদর উপজেলার বুবুপাড়া গ্রামের আন্তাজ মণ্ডলের (বুলুপাড়া গণহত্যায় শহীদ) ছেলে শফিকুল ইসলাম।

১৯৭১ সালে শফিকুলের বয়স আট বছর। যেদিন তাদের বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা এসে তার দাদা, চাচা, বাবাসহ অন্যদের তাদের বাড়ির সামনে ডেকে এনে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করায়, সেদিন সে দৃশ্য দেখার জন্য অন্যদের সঙ্গে শিশু শফিকুলও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কথা ছিল, সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মিছিল শুরু করবে। হয়তো সে মিছিলে যুক্ত হতে চেয়েছিল শফিকুলও। সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে এ দেশের শিশুদের মনে মিছিল নিয়ে নিশ্চয়ই ছিল নানা আনন্দস্মৃতি। মিছিল সেদিন শফিকুল দেখেছিল, তবে স্লোগানের নয়–গুলির এবং মৃত্যুর।

আট বছরের শিশুর চোখের ঠিক সামনেই এক সারি মানুষ রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দু-একজন দৌড়ে পালিয়েও যেতে পারল। এ ঘটনায় শফিকুল কী বুঝল? সে কি তার আট বছরের জীবনে কখনো এমন দৃশ্য দেখেছে? ঘটনার আকস্মিকতায় বাবা-চাচাদের ‘পানি’ ‘পানি’ চিৎকারে শফিকুল ঘরের মধ্যে ছুটে যায়। ঘরের ভেতর ভয়ার্ত ছুটতে থাকা শফিকুলের দাদি তাকে কোলে তুলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। শফিকুলের বাবা-চাচারা পানি খেতে পেয়েছিল কি না, রক্তাক্ত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে পেরেছিল কি না, তা আর জানা হয় না তার।

বেশ কয়েক দিন পর নিজেদের বসতভিটায় ফিরে এলেও শফিকুল তখন উন্মত্ত। দাদা, বাবা, চাচাদের জন্য তার মনে কোনো শোক তখন ছিল কি না, আজ আর শফিকুল তা বলতে পারে না। কিন্তু আজও তার মনে পড়ে ‘হত্যা’ দেখতে তার ‘ভালো’ লাগত। ভবঘুরের মতো সে ঘুরে বেড়াত। পাকিস্তানিরা যেখানে মানুষ হত্যা করতে যেত, সেখানে শফিকুল লুকিয়ে দেখত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শফিকুল জয়পুরহাট থেকে মায়ের সঙ্গে তাঁর নানাবাড়ি বগুড়ায় চলে যান। কারণ, তাঁর পরিবারের পুরুষেরা সবাই হত্যার শিকার। বগুড়ায় তাঁকে লেখাপড়ার জন্য স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু পড়ায় তিনি মন বসাতে পারেন না। একদিন পালিয়ে চলে আসেন নিজেদের শূন্য ভিটায়। মানুষের বাড়িতে এটা-ওটা করে খাবার জোগাড় করেন। একসময় শুরু করেন সবজি বিক্রেতার কাজ। তাতেও জীবন চলে কোনোমতে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সংগ্রামে এখন তিনি একজন সচ্ছল গরুর মাংসের ব্যবসায়ী। মাসহ পরিবারকে নিজের কাছে এনেছেন অনেক আগেই। নিজের সংসারেও রয়েছে পুত্র-পুত্রবধূ।

একাত্তরে বুলুপাড়া গ্রামের সবচেয়ে সচ্ছল পরিবার ছিল শফিকুল ইসলামের। লেখাপড়া জানা তাঁর বাবার জয়পুরহাট সদরে বইয়ের দোকানও ছিল, যাকে ঘিরে চলত রাজনীতির নানা পাঠ। যদি একাত্তরের সেই দিন শফিকুল পিতৃহীন না হতেন, তবে তাঁকে কি ৫০ বছর অমানুষিক সংগ্রাম করতে হতো? শিক্ষাবঞ্চিত হতে হতো। না নিশ্চয়ই। সংগ্রাম করে নিজের জীবনের আর্থিক দৈন্য ঘোচালেও শফিকুলের শিশুমনের সে ভয়ানক স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যে বিষয়টি তাঁকে অপমানিত করে, তা হলো–রাষ্ট্রের ইতিহাসে কোথাও তাঁর বাবা, চাচাদের নাম উচ্চারিত হয় না। প্রতিবছর স্বাধীনতার নানান দিবস উদযাপিত হয়, সেখানে তাঁদের কোনো অংশ নেই। কেন? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের এই বিশাল ত্যাগ কি তবে ‘অপ্রয়োজনীয়’ ছিল? 

লেখক: গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত