প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক যতীন সরকার চলে গেলেন গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অগ্রগণ্য গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বিদায় নিলেন ২ অক্টোবর। প্রগতিবাদী গবেষকদের এ শূন্যতা পূরণ করার চ্যালেঞ্জ যখন আমাদের সামনে, তখন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির দেখানো সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পথে হেঁটে অতলে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি না নিলেই নয়?
আজাদুর রহমান চন্দন
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের তোড়জোড় সত্ত্বেও সন্দেহ-সংশয় কিছু কমছে কি? একে তো জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দূর হয়নি; তার ওপর নীতিনির্ধারকদের নানা বক্তব্যে সংশয় বাড়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে, এমন প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস অতিসম্প্রতি নিউইয়র্কে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিওকে বলেছেন, ‘অবশ্যই, আপনি বললেন, মানুষ বলছে অনেক সময় লাগছে। এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন।’ এর আগে ২ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে সে নির্বাচনে কোনো বিদেশি শক্তি যেন থাবা বসাতে না পারে। সে জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তা চান।
নির্বাচন ইনক্লুসিভ তথা সবার অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সে নিয়েও নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা কুহেলিকাচ্ছন্ন। এ দেশের ভোটারদের বড় অংশই বড় দুই দল—বিএনপি ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগে বিভাজিত। শুরু থেকেই আমার মতো কারও কারও প্রত্যাশা ছিল, আওয়ামী লীগপ্রধান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ যাঁদের গায়ে দুর্নীতি-দুঃশাসনের কাদা লেপ্টে রয়েছে, তাঁরা দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী নেতাদের দল পুনর্গঠনের সুযোগ দেবেন; কিন্তু সেটি তাঁরা করেননি। পরে সেনাপ্রধানের রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ধারণাটিও বিতর্কের মুখে পড়ে ফলদায়ক হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ব্রিটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধ হলেও তাদের কার্যক্রম স্থগিত আছে। তবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার অবস্থান যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এখন নয়, কারণ তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে। তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে এখনো বৈধ। কিন্তু কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। যেকোনো সময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে বক্তব্য প্রচার হলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ১ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও সংশয় জাগে। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন, নির্বাচনের আগে একটি ‘ডামি আওয়ামী লীগ’ বানানো হতে পারে। বড় কোনো দলের ডামি বানানোর এমন চেষ্টা আগের বিভিন্ন সরকারও করেছে। তবে সেগুলো হাস্যরসের সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনো ফল দেয়নি।
এ দেশে গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা, ভোট ও ভাতের অধিকার এবং সর্বোপরি মানবমুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সম্প্রতি দলটির কংগ্রেসে (জাতীয় সম্মেলন) নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়েছে এবং পরে সংসদীয় পদ্ধতি মোতাবেক সেই কমিটি বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা নির্বাচন করেছে। এ নিয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক চলছে। সমালোচনা ও বিতর্ক নতুন মাত্রা পায় বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে দলটির নতুন সাধারণ সম্পাদকের কিছুদিন আগের একটি বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে সামনে আসায়। এক আলোচনা সভায় সিপিবির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান নাকি ব্রিটেন থেকে ভেটিং করিয়ে আনা। এমনকি ভারত থেকে ভেটিং করিয়ে আনা হয়ে থাকতে পারে বলেও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। সিপিবি নেতার বক্তব্য ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, ঘটনা যখনকার তখন তো আমি কেবল দ্বিতীয় শ্রেণির (অটো প্রমোশন নিলে অবশ্য তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতাম) বালক। কোনো রটনা বা কানকথা শুনে কিছু বলার পক্ষপাতী আমি নই। এ বিষয়ে কিছু বলতে হলে যথাযথ রেফারেন্সের আশ্রয় নিতে হয়।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য না হয়েও কমিটির সঙ্গে নিবিষ্টভাবে কাজ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রয়াত আনিসুজ্জামান খুব কাছ থেকে দেখা সংবিধান রচনার মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’তে। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করেননি। সংবিধান-প্রণয়নকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের খসড়া, বিল আকারে উপস্থাপিত সংবিধানের পাঠ এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের যে কপি নিজের কাছে রেখেছিলেন, সেসবেরও সহায়তা নিয়েছেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কমিটির সদস্য না হয়েও আমি প্রতি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি, অনেক সদস্যের উপস্থিতির হার তুলনায় অনেক কম ছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান খুব কমই আসতেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝেমধ্যে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে।’ আরেক জায়গায় আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ১২ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে শাসনতন্ত্র কমিটিতে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং আরও দু-একজন সদস্য কথাটা উঠিয়েছিলেন। তাঁরা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন, মুসলমান হিসেবে তাঁরা এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন সেখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা চলে না, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশকে তাঁরা ধর্মীয় রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান। বাংলাদেশে পালিত ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাত করুক; কিংবা ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ঘটুক, তা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়ে—যেমন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই পরিচালিত হতে চান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অধিকাংশের মত তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন। আরও নানা বিষয়ে বিতর্ক ও তার সুরাহার কথা উল্লেখ রয়েছে ওই আত্মজীবনীতে।
আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কামাল হোসেন একপর্যায়ে স্থির করলেন, তাঁর ইংরেজি খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের জন্য একজন পেশাদার আইনি খসড়া-প্রণেতার ইংরেজিতে যাকে লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান বলা হয়, তেমন একজনের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। দেশে তেমন কেউ ছিলেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাইভেট মেম্বারস বিল তৈরি করত একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তার এক সদস্যকে (রবার্ট গাথরি) এ কাজে নিযুক্ত করা হলো কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সৌজন্যে।’ তিনি ঢাকায় এসেই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। রবার্ট গাথরিকে আনতে কামাল যে লন্ডনে গিয়েছিলেন সেটিতে কোনো লুকোছাপা ছিল না। সে সংবাদ প্রকাশ হলে কিছুটা রটনাও হয়েছিল যে, কামাল লন্ডনে গেছেন সংবিধানের ভেটিং করিয়ে আনতে। যে দল বছরের পর বছর আন্দোলন করেছে বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করতে, সেই দলের নেতাও যদি পুরোনো রটনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে দাবি করেন, কামাল খসড়া ব্রিফকেসে করে নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন ভেটিং করিয়ে আনতে, তাহলে আর বলার কী থাকে!
সিপিবির এই নতুন নেতা কাদের নিয়ে কত সালের নির্বাচনে কী ফল করবেন, তার চিত্রও তুলে ধরেছেন পরে এক বক্তব্যে। এ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা টিকা-টিপ্পনী দেখা যাচ্ছে। সিপিবি নেতার ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ ফলে গেলে খুবই খুশি হব। আমার শুধু প্রশ্ন, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির মতো বিষয় নিয়ে এত দূরবর্তী সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করাটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত? সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্রায়ন-তত্ত্বায়ন কি এতই সহজ? গবেষণাপ্রক্রিয়ার একটি মৌলিক ধাপ হলো সমগ্র থেকে অংশকে বিচ্ছিন্ন করা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণায় এ ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপ ও রাসায়নিক রি-এজেন্টের ব্যবহার অপরিহার্য। সমাজ-বিপ্লবের তত্ত্ব উদ্ভাবনকারী মনীষী কার্ল মার্ক্সের মতে, সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় মাইক্রোস্কোপ ও রাসায়নিক রি-এজেন্টের বিকল্প হলো বিমূর্তকরণ শক্তি। আমি এটিকে বলি ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা অন্তর্দৃষ্টি। এর ওপর নির্ভরতায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
এমনিতেই আমাদের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানসাধকেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক যতীন সরকার চলে গেলেন গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অগ্রগণ্য গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বিদায় নিলেন ২ অক্টোবর। প্রগতিবাদী গবেষকদের এ শূন্যতা পূরণ করার চ্যালেঞ্জ যখন আমাদের সামনে, তখন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির দেখানো সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পথে হেঁটে অতলে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি না নিলেই নয়? কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে বাম রাজনীতির দুর্বলতা প্রসঙ্গে আহমদ রফিক সুদক্ষ, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাব ও মতাদর্শগত বিভ্রান্তির কথা বলেছিলেন। চিন্তার সেই দৈন্য কুয়াশা কাটানোর চেষ্টা করাই প্রয়াত মনীষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যথার্থ উপায়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের তোড়জোড় সত্ত্বেও সন্দেহ-সংশয় কিছু কমছে কি? একে তো জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দূর হয়নি; তার ওপর নীতিনির্ধারকদের নানা বক্তব্যে সংশয় বাড়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে, এমন প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস অতিসম্প্রতি নিউইয়র্কে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম জিটিওকে বলেছেন, ‘অবশ্যই, আপনি বললেন, মানুষ বলছে অনেক সময় লাগছে। এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন।’ এর আগে ২ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হবে। তবে সে নির্বাচনে কোনো বিদেশি শক্তি যেন থাবা বসাতে না পারে। সে জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বাত্মক সমর্থন ও সহায়তা চান।
নির্বাচন ইনক্লুসিভ তথা সবার অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সে নিয়েও নীতিনির্ধারকদের কথাবার্তা কুহেলিকাচ্ছন্ন। এ দেশের ভোটারদের বড় অংশই বড় দুই দল—বিএনপি ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগে বিভাজিত। শুরু থেকেই আমার মতো কারও কারও প্রত্যাশা ছিল, আওয়ামী লীগপ্রধান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ যাঁদের গায়ে দুর্নীতি-দুঃশাসনের কাদা লেপ্টে রয়েছে, তাঁরা দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী নেতাদের দল পুনর্গঠনের সুযোগ দেবেন; কিন্তু সেটি তাঁরা করেননি। পরে সেনাপ্রধানের রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের ধারণাটিও বিতর্কের মুখে পড়ে ফলদায়ক হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ব্রিটিশ-আমেরিকান সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বৈধ হলেও তাদের কার্যক্রম স্থগিত আছে। তবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার অবস্থান যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এখন নয়, কারণ তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে। তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে এখনো বৈধ। কিন্তু কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। যেকোনো সময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। তিনি আরও বলেন, ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে বক্তব্য প্রচার হলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ১ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও সংশয় জাগে। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন, নির্বাচনের আগে একটি ‘ডামি আওয়ামী লীগ’ বানানো হতে পারে। বড় কোনো দলের ডামি বানানোর এমন চেষ্টা আগের বিভিন্ন সরকারও করেছে। তবে সেগুলো হাস্যরসের সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনো ফল দেয়নি।
এ দেশে গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা, ভোট ও ভাতের অধিকার এবং সর্বোপরি মানবমুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সম্প্রতি দলটির কংগ্রেসে (জাতীয় সম্মেলন) নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়েছে এবং পরে সংসদীয় পদ্ধতি মোতাবেক সেই কমিটি বিভিন্ন পদে কর্মকর্তা নির্বাচন করেছে। এ নিয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্ক চলছে। সমালোচনা ও বিতর্ক নতুন মাত্রা পায় বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে দলটির নতুন সাধারণ সম্পাদকের কিছুদিন আগের একটি বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে সামনে আসায়। এক আলোচনা সভায় সিপিবির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান নাকি ব্রিটেন থেকে ভেটিং করিয়ে আনা। এমনকি ভারত থেকে ভেটিং করিয়ে আনা হয়ে থাকতে পারে বলেও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। সিপিবি নেতার বক্তব্য ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, ঘটনা যখনকার তখন তো আমি কেবল দ্বিতীয় শ্রেণির (অটো প্রমোশন নিলে অবশ্য তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতাম) বালক। কোনো রটনা বা কানকথা শুনে কিছু বলার পক্ষপাতী আমি নই। এ বিষয়ে কিছু বলতে হলে যথাযথ রেফারেন্সের আশ্রয় নিতে হয়।
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য না হয়েও কমিটির সঙ্গে নিবিষ্টভাবে কাজ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রয়াত আনিসুজ্জামান খুব কাছ থেকে দেখা সংবিধান রচনার মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’তে। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করেননি। সংবিধান-প্রণয়নকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের খসড়া, বিল আকারে উপস্থাপিত সংবিধানের পাঠ এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের যে কপি নিজের কাছে রেখেছিলেন, সেসবেরও সহায়তা নিয়েছেন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কমিটির সদস্য না হয়েও আমি প্রতি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি, অনেক সদস্যের উপস্থিতির হার তুলনায় অনেক কম ছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান খুব কমই আসতেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝেমধ্যে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে।’ আরেক জায়গায় আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ১২ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে শাসনতন্ত্র কমিটিতে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং আরও দু-একজন সদস্য কথাটা উঠিয়েছিলেন। তাঁরা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন, মুসলমান হিসেবে তাঁরা এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন সেখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা চলে না, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশকে তাঁরা ধর্মীয় রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান। বাংলাদেশে পালিত ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাত করুক; কিংবা ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ঘটুক, তা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়ে—যেমন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই পরিচালিত হতে চান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অধিকাংশের মত তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন। আরও নানা বিষয়ে বিতর্ক ও তার সুরাহার কথা উল্লেখ রয়েছে ওই আত্মজীবনীতে।
আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কামাল হোসেন একপর্যায়ে স্থির করলেন, তাঁর ইংরেজি খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের জন্য একজন পেশাদার আইনি খসড়া-প্রণেতার ইংরেজিতে যাকে লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান বলা হয়, তেমন একজনের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। দেশে তেমন কেউ ছিলেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাইভেট মেম্বারস বিল তৈরি করত একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তার এক সদস্যকে (রবার্ট গাথরি) এ কাজে নিযুক্ত করা হলো কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সৌজন্যে।’ তিনি ঢাকায় এসেই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। রবার্ট গাথরিকে আনতে কামাল যে লন্ডনে গিয়েছিলেন সেটিতে কোনো লুকোছাপা ছিল না। সে সংবাদ প্রকাশ হলে কিছুটা রটনাও হয়েছিল যে, কামাল লন্ডনে গেছেন সংবিধানের ভেটিং করিয়ে আনতে। যে দল বছরের পর বছর আন্দোলন করেছে বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করতে, সেই দলের নেতাও যদি পুরোনো রটনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে দাবি করেন, কামাল খসড়া ব্রিফকেসে করে নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন ভেটিং করিয়ে আনতে, তাহলে আর বলার কী থাকে!
সিপিবির এই নতুন নেতা কাদের নিয়ে কত সালের নির্বাচনে কী ফল করবেন, তার চিত্রও তুলে ধরেছেন পরে এক বক্তব্যে। এ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা টিকা-টিপ্পনী দেখা যাচ্ছে। সিপিবি নেতার ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ ফলে গেলে খুবই খুশি হব। আমার শুধু প্রশ্ন, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির মতো বিষয় নিয়ে এত দূরবর্তী সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করাটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত? সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্রায়ন-তত্ত্বায়ন কি এতই সহজ? গবেষণাপ্রক্রিয়ার একটি মৌলিক ধাপ হলো সমগ্র থেকে অংশকে বিচ্ছিন্ন করা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের গবেষণায় এ ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপ ও রাসায়নিক রি-এজেন্টের ব্যবহার অপরিহার্য। সমাজ-বিপ্লবের তত্ত্ব উদ্ভাবনকারী মনীষী কার্ল মার্ক্সের মতে, সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় মাইক্রোস্কোপ ও রাসায়নিক রি-এজেন্টের বিকল্প হলো বিমূর্তকরণ শক্তি। আমি এটিকে বলি ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা অন্তর্দৃষ্টি। এর ওপর নির্ভরতায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
এমনিতেই আমাদের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞানসাধকেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক যতীন সরকার চলে গেলেন গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অগ্রগণ্য গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বিদায় নিলেন ২ অক্টোবর। প্রগতিবাদী গবেষকদের এ শূন্যতা পূরণ করার চ্যালেঞ্জ যখন আমাদের সামনে, তখন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির দেখানো সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়ানোর পথে হেঁটে অতলে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি না নিলেই নয়? কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে বাম রাজনীতির দুর্বলতা প্রসঙ্গে আহমদ রফিক সুদক্ষ, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাব ও মতাদর্শগত বিভ্রান্তির কথা বলেছিলেন। চিন্তার সেই দৈন্য কুয়াশা কাটানোর চেষ্টা করাই প্রয়াত মনীষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যথার্থ উপায়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
বলা হতো খেলার রাজা ক্রিকেট আর রাজার খেলা পোলো। ক্রিকেট খেলার রাজা ছিল একসময়। এখন আর আছে বলে মনে হয় না। উপমহাদেশের বাইরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা বাদে আর কোথাও ক্রিকেট চলে না। মানুষ ক্রিকেট জানে না বোঝেও না।
১৫ ঘণ্টা আগেভাবুন তো এমন একটি চিত্রপট: আপনি একটি বাড়ি বানালেন। পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গবাদিপশু নিয়ে সুখেই কাটছে জীবন। অতঃপর একদিন আদেশ এল সব ছেড়ে দিতে হবে। সব মানে সব, পায়ের নিচের জমিটাও।
১৫ ঘণ্টা আগেইয়াবা কারবারের যে একটা সিন্ডিকেট আছে, সেই সিন্ডিকেটের ভেতরে যে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ রয়েছেন, সে কথা নতুন নয়। সেই অর্থে গত শনিবারের আজকের পত্রিকায় ইয়াবা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি জানা ঘটনারই পুনরাবৃত্তি।
১৫ ঘণ্টা আগেড. এ এস এম আলী আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সফর এবং আগামী জাতীয়...
২ দিন আগে