ড. এ এস এম আলী আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সফর এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটা গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র এই অধিবেশনে যোগ দিতে পারে, এ কারণে এটাকে গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম বলা হয়। এখানে সদস্যরাষ্ট্রগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে। অনেক সময় তারা আদর্শ-নীতি প্রণয়নের জন্য (পলিসি ফরমেশনের নর্মস বিল্ডিং) কাজ করে। ধরেন, জাতিসংঘ সাসটেইন ডেভেলপমেন্ট গ্রোথ নিয়ে কাজ করছে ২০১৫ সাল থেকে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নীতি বিষয়ে আলোচনার জন্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য এই অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে এত লোক নিয়ে যাওয়া কি ঠিক?
আমরা শুনেছি যে এই সফরে তালিকার মধ্যে ৬২ জনের কথা বলা হয়েছে। আবার অন্য সূত্র থেকে জানা গেছে ১০৪ জনের কথা। আমরা সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি, এই সফরে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিরাপত্তাকর্মী বা নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট লোকজন। আমাদের কাছে মিসিং তথ্য হলো, অংশগ্রহণকারীদের পুরো তালিকা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। দেখা গেলে বোঝা যেত, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের কার্যক্রমের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচ্যসূচিতে আলোচনার জন্য গেছেন, নাকি প্রতীকী অর্থে সফরসঙ্গী হিসেবে গেছেন। প্রতীকী অর্থে সফরসঙ্গী হিসেবে কীভাবে যেতে পারেন, সে প্রশ্ন দেশের যেকোনো নাগরিকই করতে পারে। রাষ্ট্রের কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে যদি তাঁদের সফরসঙ্গী করা হয়, তাহলে এই অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা কোথায়? যদি কেউ ব্যক্তিগত খরচে যান, তাহলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন আসবে সফরসঙ্গী হিসেবে যে ব্যক্তিটি গেলেন, তিনি সেখানে কীভাবে বাংলাদেশের জন্য কনট্রিবিউট করছেন? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন কিংবা বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক ফোরামে কোন পদ্ধতিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ কী পেল? এই প্রসঙ্গটা অবশ্যই আসবে। যেহেতু আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকাটা পাইনি এবং আলোচনায় কে, কীভাবে অংশ নিয়েছেন, সেটা আমরা জানি না; তাই আমার কাছে মনে হয়, এই জায়গাটাতেই সমালোচনা আসছে। কারণ, এখানে সত্যতার একটা অভাব দেখা যাচ্ছে।
অতীতের সরকারগুলোর সময় দেখা গেছে, কোনো সরকারপ্রধান দেশের বাইরে সফরের সময় ১৫০-২০০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে যেতেন। প্রশ্ন হলো, এ রকম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কীভাবে সফরসঙ্গীর সংখ্যাটা এত বড় হলো? এ প্রশ্নটা আসা খুবই স্বাভাবিক।
প্রধানত তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গেছেন। এখানে কি বৈষম্য করা হয়নি?
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং কথাবার্তা হয়েছে। যদি আমরা ধরে নিই, এই সরকারের সঙ্গে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কথা হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের অভিমত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন, তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে কেন শুধু তিনটি দলের প্রতিনিধি অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন? এই ব্যাখ্যা সরকার ভালো দিতে পারবে। তবে আমার মনে হয়, শুধু তিনটি দলকে যুক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে যেহেতু এই সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক, সেটা প্রমাণ করার জন্য তিনটি দল মানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। আরও বেশি দলের প্রতিনিধি রাখা হলে আরও বেশি খরচ বাড়ত।
এতে সরকারের দুটি উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। এক. এই তিনটি দলকে বার্তা দেওয়া যে আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আর আমরা একসঙ্গে কাজ করছি একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। দুই. বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, সংস্কার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু যেমন রোহিঙ্গা সমস্যা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে দর-কষাকষি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নানা তর্ক-বিতর্ক, মত-অভিমত এবং দ্বিমত নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সরকার বোঝাতে চাইছে আমরা যে সবাই একসঙ্গে কাজ করছি, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমার কাছে মনে হয়, খুব সম্ভবত সরকার এ রকম একটা প্রতীকী বার্তা দিতে চেয়েছে।
দেখা যায়, বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান দেশের বাইরে গেলে সেখানকার প্রবাসীরা প্রতিবাদ করেন। এবারও তা-ই হয়েছে। আমরা এ সংস্কৃতি থেকে কেন বের হতে পারছি না?
প্রতিবাদ করা যেকোনো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রতিবাদ তাঁরা করতেই পারেন। সরকারপ্রধানের সফরের সময় বা যেকোনো রাজনৈতিক দলের ডেলিগেশনের সময়ও সেটা হতে পারে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে যে কেউ অসহিংস প্রতিবাদ করতেই পারেন। কিন্তু এবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর যে ডিম মারা হলো, সেটাতে অসহিংস আন্দোলনের সীমাটাকে অতিক্রম করা হয়েছে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে মৌন মিছিলও করা যেতে পারে। আপনি আপনার দাবি নিয়ে ছোট্ট একটা কাগজে দাবির বিষয় নিয়ে দাঁড়াতেও পারেন। এগুলোর সবই অসহিংস আন্দোলনের মধ্যে পড়ে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও গৃহীত এবং চর্চিত। কিন্তু শারীরিকভাবে নিগৃহীত করাটা আমাদের রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে মন্দ দিক বলতে হবে। এসব না করাটাই আমাদের জন্য ভালো। প্রতিবাদের মধ্যে শিষ্টাচার থাকাটা জরুরি। সেটা যদি না করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে যখন এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়, তখন সেটা মন্দ হিসেবে আমরা বিবেচিত হই অন্য দেশের লোকের কাছে। তাঁরা মনে করে থাকেন, এরা দেশের মধ্যে যেমন, তেমনি দেশের বাইরেও বিভক্ত। সুন্দর দেশ গড়ার জন্য ন্যূনতম সহনশীলতার চর্চা থাকা দরকার।
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের অধিবেশনে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশের মানুষ তাঁকে ৫, ১০ বা ৫০ বছরও ক্ষমতায় দেখতে চায়। তাহলে নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা আছে কি?
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সাধারণ মানুষ এবং তরুণদের একটা অংশ মনে করতে পারে তিনি নোবেলজয়ী এবং যোগ্য ব্যক্তি। সে কারণে তাঁর প্রতি তাদের একটা আস্থার জায়গা থাকতে পারে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত মুখ। এ রকম একজন সরকারপ্রধান থাকলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক কূটনীতির দ্বারা অনেক কিছু আদায় করা সম্ভব। এ রকম একটা ধারণা দেশের অনেকের মধ্যে আছে। তিনি হয়তোবা সেটাকে মিন করেই ওই কথাগুলো বলেছেন।
এসব কথার পরেও তাঁর সরকার কিন্তু জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। এরপরে তাঁরা আর ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন না। তিনি হয়তোবা তাঁর কমিটমেন্টের জায়গাটা ক্লিয়ার করার জন্য কথাটি বলেছেন। এটাতে আমি কোনো আশঙ্কার কিছু দেখি না।
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ভাষণে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। নির্বাচিত সরকার কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিতে পারবে?
নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে সেই দলের নিজস্ব একটা পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা থাকবে। আর সংস্কারের জন্য অ্যাজেন্ডা তো আছেই। আমরা যদি তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করি, তাহলে বলা যেতে পারে—ক্ষমতাসীনেরা তাদের পার্টির অ্যাজেন্ডা না সংস্কারকে বেশি অগ্রাধিকার দেবে, সেটা করার জন্য তাদের স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এটা নিয়ে আগেভাগে কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে একটা ব্যাপক পরিবর্তন হোক, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা তো এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে। তারা সেটাকে শ্রদ্ধা জানাবে। কারণ, সেখান থেকে দূরে সরে গেলে আবার জন-অসন্তোষ তৈরি হবে। আবার সেটা তাদের জন্য রাজনৈতিক অপরিপক্বতার কারণ হতে পারে। সংস্কারের কমিটমেন্ট থেকে যদি তারা দূরে সরে যায়, তাহলে সেই দল তো নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হবে।
আমি এ জায়গাটাকে অভিজ্ঞতার পর্যায় হিসেবে দেখতে চাই। সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ক্ষমতায় যারাই আসুক না কেন, তাদের সংস্কারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে জুলাই জাতীয় সনদের মাধ্যমে সব দল একটা পলিটিক্যাল কমিটমেন্টের জায়গায় পৌঁছাবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার এবং সেসব সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। সংস্কারের পক্ষে জনগণের যে ব্যাপক সমর্থন আছে, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
তবে শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরে অন্য ভূমিকা পালন করে। তবে আমরা আশা করতে পারি, যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, সংস্কার বাস্তবায়ন তাদের করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটা গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র এই অধিবেশনে যোগ দিতে পারে, এ কারণে এটাকে গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম বলা হয়। এখানে সদস্যরাষ্ট্রগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে। অনেক সময় তারা আদর্শ-নীতি প্রণয়নের জন্য (পলিসি ফরমেশনের নর্মস বিল্ডিং) কাজ করে। ধরেন, জাতিসংঘ সাসটেইন ডেভেলপমেন্ট গ্রোথ নিয়ে কাজ করছে ২০১৫ সাল থেকে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন হয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নীতি বিষয়ে আলোচনার জন্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। এ জন্য এই অধিবেশন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে এত লোক নিয়ে যাওয়া কি ঠিক?
আমরা শুনেছি যে এই সফরে তালিকার মধ্যে ৬২ জনের কথা বলা হয়েছে। আবার অন্য সূত্র থেকে জানা গেছে ১০৪ জনের কথা। আমরা সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পেরেছি, এই সফরে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিরাপত্তাকর্মী বা নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট লোকজন। আমাদের কাছে মিসিং তথ্য হলো, অংশগ্রহণকারীদের পুরো তালিকা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। দেখা গেলে বোঝা যেত, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের কার্যক্রমের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচ্যসূচিতে আলোচনার জন্য গেছেন, নাকি প্রতীকী অর্থে সফরসঙ্গী হিসেবে গেছেন। প্রতীকী অর্থে সফরসঙ্গী হিসেবে কীভাবে যেতে পারেন, সে প্রশ্ন দেশের যেকোনো নাগরিকই করতে পারে। রাষ্ট্রের কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে যদি তাঁদের সফরসঙ্গী করা হয়, তাহলে এই অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা কোথায়? যদি কেউ ব্যক্তিগত খরচে যান, তাহলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন আসবে সফরসঙ্গী হিসেবে যে ব্যক্তিটি গেলেন, তিনি সেখানে কীভাবে বাংলাদেশের জন্য কনট্রিবিউট করছেন? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন কিংবা বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক ফোরামে কোন পদ্ধতিতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ কী পেল? এই প্রসঙ্গটা অবশ্যই আসবে। যেহেতু আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকাটা পাইনি এবং আলোচনায় কে, কীভাবে অংশ নিয়েছেন, সেটা আমরা জানি না; তাই আমার কাছে মনে হয়, এই জায়গাটাতেই সমালোচনা আসছে। কারণ, এখানে সত্যতার একটা অভাব দেখা যাচ্ছে।
অতীতের সরকারগুলোর সময় দেখা গেছে, কোনো সরকারপ্রধান দেশের বাইরে সফরের সময় ১৫০-২০০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে যেতেন। প্রশ্ন হলো, এ রকম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কীভাবে সফরসঙ্গীর সংখ্যাটা এত বড় হলো? এ প্রশ্নটা আসা খুবই স্বাভাবিক।
প্রধানত তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গেছেন। এখানে কি বৈষম্য করা হয়নি?
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বলেছেন, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং কথাবার্তা হয়েছে। যদি আমরা ধরে নিই, এই সরকারের সঙ্গে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কথা হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের অভিমত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন, তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে কেন শুধু তিনটি দলের প্রতিনিধি অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন? এই ব্যাখ্যা সরকার ভালো দিতে পারবে। তবে আমার মনে হয়, শুধু তিনটি দলকে যুক্ত করা হয়েছে এ কারণে যে যেহেতু এই সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক, সেটা প্রমাণ করার জন্য তিনটি দল মানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। আরও বেশি দলের প্রতিনিধি রাখা হলে আরও বেশি খরচ বাড়ত।
এতে সরকারের দুটি উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। এক. এই তিনটি দলকে বার্তা দেওয়া যে আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আর আমরা একসঙ্গে কাজ করছি একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। দুই. বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, সংস্কার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু যেমন রোহিঙ্গা সমস্যা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে দর-কষাকষি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নানা তর্ক-বিতর্ক, মত-অভিমত এবং দ্বিমত নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সরকার বোঝাতে চাইছে আমরা যে সবাই একসঙ্গে কাজ করছি, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমার কাছে মনে হয়, খুব সম্ভবত সরকার এ রকম একটা প্রতীকী বার্তা দিতে চেয়েছে।
দেখা যায়, বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান দেশের বাইরে গেলে সেখানকার প্রবাসীরা প্রতিবাদ করেন। এবারও তা-ই হয়েছে। আমরা এ সংস্কৃতি থেকে কেন বের হতে পারছি না?
প্রতিবাদ করা যেকোনো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রতিবাদ তাঁরা করতেই পারেন। সরকারপ্রধানের সফরের সময় বা যেকোনো রাজনৈতিক দলের ডেলিগেশনের সময়ও সেটা হতে পারে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে যে কেউ অসহিংস প্রতিবাদ করতেই পারেন। কিন্তু এবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর যে ডিম মারা হলো, সেটাতে অসহিংস আন্দোলনের সীমাটাকে অতিক্রম করা হয়েছে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে মৌন মিছিলও করা যেতে পারে। আপনি আপনার দাবি নিয়ে ছোট্ট একটা কাগজে দাবির বিষয় নিয়ে দাঁড়াতেও পারেন। এগুলোর সবই অসহিংস আন্দোলনের মধ্যে পড়ে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও গৃহীত এবং চর্চিত। কিন্তু শারীরিকভাবে নিগৃহীত করাটা আমাদের রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে মন্দ দিক বলতে হবে। এসব না করাটাই আমাদের জন্য ভালো। প্রতিবাদের মধ্যে শিষ্টাচার থাকাটা জরুরি। সেটা যদি না করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে যখন এ ধরনের ঘটনাগুলো প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়, তখন সেটা মন্দ হিসেবে আমরা বিবেচিত হই অন্য দেশের লোকের কাছে। তাঁরা মনে করে থাকেন, এরা দেশের মধ্যে যেমন, তেমনি দেশের বাইরেও বিভক্ত। সুন্দর দেশ গড়ার জন্য ন্যূনতম সহনশীলতার চর্চা থাকা দরকার।
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের অধিবেশনে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশের মানুষ তাঁকে ৫, ১০ বা ৫০ বছরও ক্ষমতায় দেখতে চায়। তাহলে নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা আছে কি?
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সাধারণ মানুষ এবং তরুণদের একটা অংশ মনে করতে পারে তিনি নোবেলজয়ী এবং যোগ্য ব্যক্তি। সে কারণে তাঁর প্রতি তাদের একটা আস্থার জায়গা থাকতে পারে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত মুখ। এ রকম একজন সরকারপ্রধান থাকলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক কূটনীতির দ্বারা অনেক কিছু আদায় করা সম্ভব। এ রকম একটা ধারণা দেশের অনেকের মধ্যে আছে। তিনি হয়তোবা সেটাকে মিন করেই ওই কথাগুলো বলেছেন।
এসব কথার পরেও তাঁর সরকার কিন্তু জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। এরপরে তাঁরা আর ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন না। তিনি হয়তোবা তাঁর কমিটমেন্টের জায়গাটা ক্লিয়ার করার জন্য কথাটি বলেছেন। এটাতে আমি কোনো আশঙ্কার কিছু দেখি না।
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ভাষণে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। নির্বাচিত সরকার কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিতে পারবে?
নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে সেই দলের নিজস্ব একটা পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা থাকবে। আর সংস্কারের জন্য অ্যাজেন্ডা তো আছেই। আমরা যদি তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করি, তাহলে বলা যেতে পারে—ক্ষমতাসীনেরা তাদের পার্টির অ্যাজেন্ডা না সংস্কারকে বেশি অগ্রাধিকার দেবে, সেটা করার জন্য তাদের স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এটা নিয়ে আগেভাগে কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে একটা ব্যাপক পরিবর্তন হোক, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা তো এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে। তারা সেটাকে শ্রদ্ধা জানাবে। কারণ, সেখান থেকে দূরে সরে গেলে আবার জন-অসন্তোষ তৈরি হবে। আবার সেটা তাদের জন্য রাজনৈতিক অপরিপক্বতার কারণ হতে পারে। সংস্কারের কমিটমেন্ট থেকে যদি তারা দূরে সরে যায়, তাহলে সেই দল তো নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হবে।
আমি এ জায়গাটাকে অভিজ্ঞতার পর্যায় হিসেবে দেখতে চাই। সে জন্য প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ক্ষমতায় যারাই আসুক না কেন, তাদের সংস্কারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে জুলাই জাতীয় সনদের মাধ্যমে সব দল একটা পলিটিক্যাল কমিটমেন্টের জায়গায় পৌঁছাবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার এবং সেসব সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। সংস্কারের পক্ষে জনগণের যে ব্যাপক সমর্থন আছে, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
তবে শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরে অন্য ভূমিকা পালন করে। তবে আমরা আশা করতে পারি, যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন, সংস্কার বাস্তবায়ন তাদের করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে প্যারিসে আন্তসরকার সম্মেলনে ইউনেসকো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে শিক্ষকের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণীত হয়। এতে শিক্ষক নিয়োগ, দায়িত্ব, পদোন্নতি, অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন...
৫ ঘণ্টা আগেদেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিনা মূল্যে বরাদ্দের ওষুধ গুদামে মজুত আছে। অথচ রোগী এলে বলা হয়, ওষুধের সাপ্লাই নেই। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৬৪টি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে এই অভিযোগসহ গুরুতর সাতটি অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন...
৫ ঘণ্টা আগেআগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কি সন্দেহ-সংশয় আছে? আপাতদৃষ্টিতে নেই। নির্বাচন ওই সময়েই হবে— সাধারণভাবে এমনটাই ধারণা করা যায়। সরকারের ঘোষণা ও নানা সময়ের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি—এসবই এই ধারণার ভিত্তি।
১ দিন আগেবাংলাদেশে স্মার্টফোন চুরি এখন আর নতুন ঘটনা নয়। স্মার্টফোনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই এই অপরাধ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মাত্রা ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে, নতুন নিরাপত্তা ফিচার যোগ হচ্ছে, আর চোরদের কৌশলও ততই আধুনিক হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে