Ajker Patrika

নদীভাঙন

আল শাহারিয়া
নদীভাঙন

নদী কি এখনো আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে?

ভাবুন তো এমন একটি চিত্রপট: আপনি একটি বাড়ি বানালেন। পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গবাদিপশু নিয়ে সুখেই কাটছে জীবন। অতঃপর একদিন আদেশ এল সব ছেড়ে দিতে হবে। সব মানে সব, পায়ের নিচের জমিটাও।

অবাক হচ্ছেন? এতে অবাক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। এই নদীভাঙন কত বিত্তশালী মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। নদীভাঙনের শিকার হলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আপনি সর্বোচ্চ আপনার জীবনটা নিয়ে সরে পড়তে পারবেন, সেটাও অনেক সময় হয়ে ওঠে না। এমন অনেক জনশ্রুতি পাবেন যে ঘুমের মধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে মানুষের ঘরবাড়িসহ গোটা পরিবার।

প্রকৃতির খেয়ালই নদীভাঙনের প্রধান কারণ। বর্ষায় যখন উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে, তখন প্রবল স্রোতের ধাক্কায় নদীর তীর ক্ষয় হতে থাকে। অতিবৃষ্টি আর বন্যা—এই ক্ষয়কে আরও ত্বরান্বিত করে। কোথাও পলি জমে নদী অগভীর হয়ে যায়, আবার কোথাও সেই স্রোত তীরের সবকিছু গ্রাস করে ফেলে। কখনো কখনো ভূমিকম্প বা ভূমির স্বাভাবিক পরিবর্তনে নদীর গতিপথ বদলে যায়। তখন হঠাৎ করেই নতুন নতুন জায়গায় ভাঙন শুরু হয়। আর নদীর নিজস্ব চরিত্র পরিবর্তনশীল, সুযোগ পেলে সে তার গতিপথ বদলায়। কখনো এর বুকে নতুন চরের জন্ম দেয়, আবার পুরোনো চরকে গ্রাস করে নেয়।

কিন্তু, দায় কি শুধুই প্রকৃতির? না। মানুষের অব্যবস্থাপনাও নদীভাঙন বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ তৈরি কিংবা চর দখল নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করছে। অনেক সময় একপাশে বাঁধ দিয়ে ভাঙন ঠেকানো হয়, অথচ সেই পানির চাপ যখন অন্য তীরে পড়ে, তখন সেখানেই শুরু হয় নতুন ভাঙন। পাহাড় কেটে মাটি ফেলা বা বন উজাড়ের কারণে নদীতে পলির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ভারসাম্য নষ্ট হয়। নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ায় নদী আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও যুক্ত হয়। অনিয়মিত বৃষ্টি ও ক্রমাগত হিমবাহ গলে যাওয়ার ফলে নদীর ওপর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

নদীভাঙনের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক—দুই রকম প্রভাবই রয়েছে।

নদীভাঙনের সঙ্গে সবচেয়ে পরিচিত শব্দ হলো অভিবাসন। আপনি যখন পায়ের নিচের মাটিটাও হারাবেন, আপনাকে নতুন ভূমির সন্ধান করতেই হবে। একে বাধ্য অভিবাসন (ফোর্সড মাইগ্রেশন) বলা হয়। কেউ আবার ভূমি হারানোর আগেই এই অনুসন্ধান সেরে নেয় এবং নতুন জায়গায় বসতি গড়ে। এই অভিবাসন পারিবারিক দূরত্ব বাড়ায়, ফলে সামাজিক বন্ধনে অনেকটাই ভাটা পড়ে। অর্থাৎ, নদীভাঙনের সামাজিক ক্ষতি মানে শুধু স্থানচ্যুতি নয়; এটি মানুষের পরিচয়, মর্যাদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক ও নিরাপত্তাকে গভীরভাবে আঘাত করে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতি অনিবার্য। নদী গ্রাস করে নেয় উর্বর কৃষিজমি। এতে কমে যায় ফসল, ধ্বংস হয় কৃষকের জীবিকা। একই সঙ্গে বিলীন হয় কৃষকের ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, ফলের বাগান, মাছের ঘের। সব সম্পদ ও আশ্রয় হারিয়ে মানুষ শহরে গিয়ে শুরু করে দিনমজুরি, রিকশা চালানো বা ইটভাটার কাজ। আবার কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক ইটভাটায় কাজ নেয় নির্দিষ্ট মৌসুমে। একবার দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়লে এর থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন করে বসতি গড়ার খরচও অনেক সময় জোটে না। সরকারি এবং দেশি-বিদেশি এনজিওর সাহায্যও এ দেশে অপ্রতুল। স্থানীয় অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নদীভাঙনে বিলীন হয় স্থানীয় স্কুল, হাটবাজার, রাস্তাঘাট। যার ফলে বাজারে খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। যা সরাসরি জীবনের স্বাভাবিকতার ওপর প্রভাব ফেলে।

নদীভাঙনের প্রভাব আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তীব্র। উপকূলীয় নদীভাঙন ‘লবণাক্ততা’ নামের আরেকটি নতুন সমস্যাকে ত্বরান্বিত করে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে নদীর দূষিত এবং লবণাক্ত পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এটি আবার সরাসরি প্রভাব ফেলে সমাজ ও অর্থনীতিতে। হুমকির মুখে ফেলে খাদ্যনিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে।

নদীভাঙন আমাদের নদীকেন্দ্রিক সংকটগুলোর একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। যে নদী আমাদের অর্থনীতির প্রাণভোমরা, যোগাযোগের সহজতম মাধ্যম এবং হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক, সেই নদীর অস্তিত্বই আজ চতুর্মুখী আগ্রাসনের শিকার। লোভের বশবর্তী হয়ে আমরা এর দুই পাড় দখল করে সংকুচিত করেছি তার চলার পথ, আর এর বুকে দিনরাত ঢেলে চলেছি শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও শহরের আবর্জনা। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে পলি জমে হারিয়ে যাচ্ছে নাব্যতা, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চিরচেনা নৌপথ। নদীর জলে অক্সিজেনের বদলে যখন বিষাক্ত রাসায়নিক ভাসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংস হয় এর জীববৈচিত্র্য; বিলুপ্ত হয়ে যায় শত প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। একসময়ের উচ্ছল খরস্রোতা নদীগুলো আজ মৃতপ্রায় খাল, নয়তো দূষণের শিকার হয়ে বিলীন হয়ে গেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনার বিষয়ে ঢাকার সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত নয়াদিল্লি: ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব

দেশে ফেরা, নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে যা বললেন তারেক রহমান

চিরশত্রু পাকিস্তানের কাছে বন্ধু রাশিয়ার জেট ইঞ্জিন বিক্রি, ভারতে রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে

ভারতের ‘উঠান’ যেভাবে ক্রমেই চীনের ‘খেলার মাঠ’ হয়ে উঠছে

উপদেষ্টাদের অনেকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন, তাঁরা ‘সেফ এক্সিট’ খুঁজছেন— নাহিদের মন্তব্যে আলোচনার ঝড়

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত