রুমা মোদক
প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভাঙা অতিমারি ক্লান্ত দিনে আমিও সহযাত্রী হলাম পরিসংখ্যানের। আক্রান্তের হারে পৃথিবীর হিসাবে যুক্ত হলাম আমিও। জ্বরের ঘোরে আমার বারবার বাবার মুখটা মনে পড়ে। আমি অসুস্থ হলে বাবা ঘুমাতেন না। এক অতিমানবিক শক্তিতে তিনি অফিস সেরে ক্লান্ত শরীরে সারা রাত আমার শুশ্রূষা করে আবার পরদিন অফিসে যেতেন। আমাদের তিন ভাইবোনের বেলায়ই এটা ঘটত, আর ব্যাপারটি আমাদের খুব অস্বাভাবিক মনে হতো না। আজ নিজে যখন মা হয়ে সন্তানের জন্য কখনো রাত জাগতে হয়, পরদিন টের পাই, কী কঠিন কাজটা বাবা করতেন হাসিমুখে অবলীলায়।
আয়নাবাজি ছবিটি দেখে ভাবছিলাম, পরিচালক এই থিম পেলেন কই! এ রকম কি এ দেশে হয়? নিশ্চয়ই এটা বিদেশি কোনো কাহিনির অনুকরণ। এই নিউজটা সামনে আসার আগে পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনি, এ দেশে সত্যি এটা ঘটে। একজনের হয়ে অন্যজন জেল খাটে। আমার অসুস্থতাজনিত শ্রান্তিকে আরও গভীর অমোচনীয় বিষাদে ঢেকে দিল চট্টগ্রামে ট্রাকচাপায় নিহত মিনু আক্তারের ঘটনাটি। আহারে, তিনটি সন্তানের তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তায় এক গর্ভধারিণী অনায়াসে বেছে নিলেন কারাজীবন। আহা! সন্তানের মুখে আহার তুলে দেওয়ার এই দায় তাঁকে কে দিয়েছে? এই সমাজ, সংসার, ব্যবস্থা? নাকি গর্ভে ধারণের জৈবিকতা? ইন্সটিংক্ট। যার থেকে মুক্তি নেই পৃথিবীর প্রাণিজগতের অধিকাংশ প্রাণীর। সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করি নিজেদের; অথচ এখনো এমন সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, যে সমাজে সন্তান শুধু মায়ের নয়, সমাজের সম্পদ হয়। সন্তান শুধু মায়ের দায়িত্ব নয়, সমাজেরও দায়িত্ব। আমি নেটে ঘাঁটছিলাম, কোথাও এই সন্তানগুলোর পিতৃপরিচয় পাই কি না। না, পাইনি।
আমার ঘরের নবনিযুক্ত গৃহকর্মী মিনতি। তাঁর ছেলে নয়ন। বয়স ১০–১১। জিজ্ঞেস করলাম, নিজের নাম লিখতে পারো? না। স্কুলে যাওনি কোনো দিন? না। কী করো? চায়ের দোকানে কাজ করি। মাসে দুই হাজার টাকা আর এক বেলা ভাত। কী দিয়ে ভাত দেয়? এই মাছ, ডাল, সবজি—যা থাকে। সকালে কী খেয়ে দোকানে যাও? চা আর মুড়ি। রাতে ফিরে কী খাও? আলু ভর্তা আর ভাত। শোনো, লকডাউন উঠে গেলে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন আসবে, আমি লিখতে-পড়তে শেখাব। মাথা নেড়ে সায় দিল ছেলেটি। জানতে চাইলাম, লেখাপড়া শিখে কী করবে? একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছেলেটি জবাব দিল, ‘বাপরে গিয়া ধরুম।’ আমি থ মেরে তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটির দিকে। আপাতনিরীহ, চুপচাপ, বিষণ্ন ছেলেটির ভেতরে কী তীব্র আগুন! মাত্র দুই বছরের ছেলেসহ মাকে বিদায় করে তার বাপ আরেকটা বিয়ে করেছে।
আমি কোভিড পজিটিভ জেনে নিউইয়র্ক থেকে ফোন করেছে জুহেনা। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বিয়ে করে ও আমাদের ছেড়ে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন স্কুলের পাট ফুরিয়েছে কি ফুরায়নি! তারপর সাকল্যে দেখা হয়েছে হয়তো বার দুয়েক। আমি যেবার নিউইয়র্কে গেলাম, সেবার ও পারিবারিক প্রোগ্রামে ফ্লোরিডায়। ফেসবুক থাকায় তবু দূরত্বটা দূরত্ব মনে হয় না ইদানীং। স্কুল লাগোয়া বাড়ি ওদের। সেই বালিকাবেলা থেকে দেখি জুহেনারা পরির মতো কয়েকজন বোন। ঘরে মা নেই। গেল বছর এমন দিনে, নিউইয়র্ক যখন লকডাউনে, জুহেনা গভীর রাতে ফোন দিত। ওর তখন সকাল। ওর আব্বার গল্প করছিল একদিন। বলছিল : ‘জানিস, আব্বা এখানে যখন ছিলেন, একদিন দেখি জায়নামাজে বসে কাঁদছেন। আমাকে বলছেন, “মা রে, আমারে মাফ করে দিস।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন আব্বা?” আব্বা বললেন, “ঘরে তোমাদের মা ছিল না।
তোমরা অপূর্ব রূপবতী মেয়ে আমার। যদি ঠিকমতো দেখাশোনা করতে না পারি, ভয়ে সবাইকে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। লেখাপড়া করাতে পারিনি বেশি।” জুহেনার আম্মা যখন মারা যান, তখন ওর আব্বার বয়স আটত্রিশ। ছয় বোন আর এক ভাইয়ের সংসার আগলে রেখেছেন মাতৃস্নেহেই। প্রায় নব্বই বছর বয়সে গত বছর তিনি মারা গেছেন। ‘আমার, বোনদের ছেলেমেয়েরা সব উচ্চশিক্ষিত—আব্বা দেখে গেছেন।’ বলতে বলতে কাঁদছিল জুহেনা।
শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, পিতৃত্ব কী অসীম মায়াময়, মানবিক এক সম্পর্ক। শুধু গড়তে জানলে।
(এখানে ব্যবহৃত সবই ছদ্মনাম)
লেখক: সাহিত্যিক
প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভাঙা অতিমারি ক্লান্ত দিনে আমিও সহযাত্রী হলাম পরিসংখ্যানের। আক্রান্তের হারে পৃথিবীর হিসাবে যুক্ত হলাম আমিও। জ্বরের ঘোরে আমার বারবার বাবার মুখটা মনে পড়ে। আমি অসুস্থ হলে বাবা ঘুমাতেন না। এক অতিমানবিক শক্তিতে তিনি অফিস সেরে ক্লান্ত শরীরে সারা রাত আমার শুশ্রূষা করে আবার পরদিন অফিসে যেতেন। আমাদের তিন ভাইবোনের বেলায়ই এটা ঘটত, আর ব্যাপারটি আমাদের খুব অস্বাভাবিক মনে হতো না। আজ নিজে যখন মা হয়ে সন্তানের জন্য কখনো রাত জাগতে হয়, পরদিন টের পাই, কী কঠিন কাজটা বাবা করতেন হাসিমুখে অবলীলায়।
আয়নাবাজি ছবিটি দেখে ভাবছিলাম, পরিচালক এই থিম পেলেন কই! এ রকম কি এ দেশে হয়? নিশ্চয়ই এটা বিদেশি কোনো কাহিনির অনুকরণ। এই নিউজটা সামনে আসার আগে পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনি, এ দেশে সত্যি এটা ঘটে। একজনের হয়ে অন্যজন জেল খাটে। আমার অসুস্থতাজনিত শ্রান্তিকে আরও গভীর অমোচনীয় বিষাদে ঢেকে দিল চট্টগ্রামে ট্রাকচাপায় নিহত মিনু আক্তারের ঘটনাটি। আহারে, তিনটি সন্তানের তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তায় এক গর্ভধারিণী অনায়াসে বেছে নিলেন কারাজীবন। আহা! সন্তানের মুখে আহার তুলে দেওয়ার এই দায় তাঁকে কে দিয়েছে? এই সমাজ, সংসার, ব্যবস্থা? নাকি গর্ভে ধারণের জৈবিকতা? ইন্সটিংক্ট। যার থেকে মুক্তি নেই পৃথিবীর প্রাণিজগতের অধিকাংশ প্রাণীর। সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করি নিজেদের; অথচ এখনো এমন সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, যে সমাজে সন্তান শুধু মায়ের নয়, সমাজের সম্পদ হয়। সন্তান শুধু মায়ের দায়িত্ব নয়, সমাজেরও দায়িত্ব। আমি নেটে ঘাঁটছিলাম, কোথাও এই সন্তানগুলোর পিতৃপরিচয় পাই কি না। না, পাইনি।
আমার ঘরের নবনিযুক্ত গৃহকর্মী মিনতি। তাঁর ছেলে নয়ন। বয়স ১০–১১। জিজ্ঞেস করলাম, নিজের নাম লিখতে পারো? না। স্কুলে যাওনি কোনো দিন? না। কী করো? চায়ের দোকানে কাজ করি। মাসে দুই হাজার টাকা আর এক বেলা ভাত। কী দিয়ে ভাত দেয়? এই মাছ, ডাল, সবজি—যা থাকে। সকালে কী খেয়ে দোকানে যাও? চা আর মুড়ি। রাতে ফিরে কী খাও? আলু ভর্তা আর ভাত। শোনো, লকডাউন উঠে গেলে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন আসবে, আমি লিখতে-পড়তে শেখাব। মাথা নেড়ে সায় দিল ছেলেটি। জানতে চাইলাম, লেখাপড়া শিখে কী করবে? একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছেলেটি জবাব দিল, ‘বাপরে গিয়া ধরুম।’ আমি থ মেরে তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটির দিকে। আপাতনিরীহ, চুপচাপ, বিষণ্ন ছেলেটির ভেতরে কী তীব্র আগুন! মাত্র দুই বছরের ছেলেসহ মাকে বিদায় করে তার বাপ আরেকটা বিয়ে করেছে।
আমি কোভিড পজিটিভ জেনে নিউইয়র্ক থেকে ফোন করেছে জুহেনা। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বিয়ে করে ও আমাদের ছেড়ে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন স্কুলের পাট ফুরিয়েছে কি ফুরায়নি! তারপর সাকল্যে দেখা হয়েছে হয়তো বার দুয়েক। আমি যেবার নিউইয়র্কে গেলাম, সেবার ও পারিবারিক প্রোগ্রামে ফ্লোরিডায়। ফেসবুক থাকায় তবু দূরত্বটা দূরত্ব মনে হয় না ইদানীং। স্কুল লাগোয়া বাড়ি ওদের। সেই বালিকাবেলা থেকে দেখি জুহেনারা পরির মতো কয়েকজন বোন। ঘরে মা নেই। গেল বছর এমন দিনে, নিউইয়র্ক যখন লকডাউনে, জুহেনা গভীর রাতে ফোন দিত। ওর তখন সকাল। ওর আব্বার গল্প করছিল একদিন। বলছিল : ‘জানিস, আব্বা এখানে যখন ছিলেন, একদিন দেখি জায়নামাজে বসে কাঁদছেন। আমাকে বলছেন, “মা রে, আমারে মাফ করে দিস।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন আব্বা?” আব্বা বললেন, “ঘরে তোমাদের মা ছিল না।
তোমরা অপূর্ব রূপবতী মেয়ে আমার। যদি ঠিকমতো দেখাশোনা করতে না পারি, ভয়ে সবাইকে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। লেখাপড়া করাতে পারিনি বেশি।” জুহেনার আম্মা যখন মারা যান, তখন ওর আব্বার বয়স আটত্রিশ। ছয় বোন আর এক ভাইয়ের সংসার আগলে রেখেছেন মাতৃস্নেহেই। প্রায় নব্বই বছর বয়সে গত বছর তিনি মারা গেছেন। ‘আমার, বোনদের ছেলেমেয়েরা সব উচ্চশিক্ষিত—আব্বা দেখে গেছেন।’ বলতে বলতে কাঁদছিল জুহেনা।
শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, পিতৃত্ব কী অসীম মায়াময়, মানবিক এক সম্পর্ক। শুধু গড়তে জানলে।
(এখানে ব্যবহৃত সবই ছদ্মনাম)
লেখক: সাহিত্যিক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন এমন এক আবহে অনুষ্ঠিত হবে যে তা শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটা তাঁর নিজের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে
১১ ঘণ্টা আগেসোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। আস্থা আছে কি না, স্বপ্রণোদিত হয়ে যাচাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরু। সংসদে ১৯৪ জন সংসদ সদস্য তাঁর ওপর আস্থা জানিয়ে ভোট দিলেও ৩৬৪ জন তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের আইনপ্রণেতা হচ্ছেন মোট ৫৭৭ জন। ফলে মাত্র ৯ মাস ক্ষমতায়
১১ ঘণ্টা আগেসময় এখন অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মানুষ তার হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে—কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতিটি বিপ্লব আমাদের জীবনধারায় গভীর পরিবর্তন এনেছে, কেউ কেউ পেছনে পড়ে গেছে, কেউ সামনের সারিতে উঠে এসেছে। কিন্তু এইবার যা আসছে, তা হয়তো আর কাউকে কেবল পেছনেই ফেলবে না; বরং মানুষক
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আজকের পত্রিকায় ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল’ (ক্যাবি) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
১১ ঘণ্টা আগে