Ajker Patrika

ধ্রুপদি চলচ্চিত্র নিয়ে দূরপাল্লার দৌড়

বিধান রিবেরু
বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন বিশ্বের ধ্রুপদি চলচ্চিত্র দেখার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে। ছবি: লেখক
বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন বিশ্বের ধ্রুপদি চলচ্চিত্র দেখার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে। ছবি: লেখক

নতুন চলচ্চিত্র দেখা মানেই আপনি ঝুঁকি নিয়ে ছবিটি দেখছেন। এটা ঠিক, লোকমুখে, পত্রপত্রিকায়, এমনকি নানামুখী প্রচারে হয়তো একটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার পূর্বধারণা হচ্ছে, কিন্তু গোটা ছবি না দেখা পর্যন্ত আসলে আপনার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, ছবিটি আপনার আদৌ ভালো লেগেছে নাকি খারাপ লেগেছে। ছবি দেখার আগে ভালো-মন্দের এই দোলাচল দুনিয়ার প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে হয়, চলচ্চিত্র উৎসবেও হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম বোধ হয় বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন। কারণ, এখানে সেসব ছবিই স্থান পায়, যাতে রয়েছে কালকে পরাস্ত করার কলা, মানে শিল্পের জোরে যা সময়কে অতিক্রম করেছে, আর পেয়েছে দর্শকের তারিফ ও ভালোবাসা।

পুরোনো ধ্রুপদি চলচ্চিত্রকে পুনরুদ্ধার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যত্নসহকারে প্রদর্শন করা হয় বলেই খুব কম সময়ের ভেতর বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা বাহুল্য নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকে উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে বড় পর্দায় দেখানোর উপযোগী করা হয়, সেসব ল্যাবের সঙ্গে বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করে এবং তাদের কাছ থেকে চলচ্চিত্র এনে তারা দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দেয়। ধ্রুপদি হওয়া সত্ত্বেও সব ছবি সবার সব সময় ভালো না-ও লাগতে পারে। তবে পছন্দ-অপছন্দের ব্যক্তিক জায়গাটি বাদ দিলে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলা যায় হাঙ্গেরির এই ফিল্ম ম্যারাথন মূলত বিশ্বের নানা প্রান্তের ধ্রুপদি চলচ্চিত্র দেখার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে।

হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে চলচ্চিত্রের এই আয়োজন হচ্ছে ২০১৭ সাল থেকে। এ বছরের অষ্টম আসরে তারা চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপ্রেসির সাধারণ সভার সহ-আয়োজক হয়। ফিপ্রেসি নিজেদের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্‌যাপন করছে এ বছর। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ফিপ্রেসি চ্যাপ্টারের একজন সদস্য হিসেবে আমি যাই বুদাপেস্টে। একে বলা যেতে পারে, এক টিকিটে দুই ছবি দেখা। যেহেতু বুদাপেস্ট ফিপ্রেসির জেনারেল অ্যাসেম্বলির হোস্ট, তাই ফিপ্রেসির সভা ছাড়াও ম্যারাথনের উদ্বোধনী গালা, বিশেষ প্রদর্শনী ইত্যাদি দেখার আমন্ত্রণও পাই আমি। এখন প্রশ্ন হলো, এই সিনেমা-সফর থেকে আমি কী নিয়ে এলাম? প্রথমত, আমার নামের পাশে বাংলাদেশ নামটি ছিল, বুদাপেস্ট ম্যারাথন কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন দলিলে এটি প্রকাশ করেছে এবং এ কারণে বাংলাদেশের নামটি স্থায়ীভাবে তাদের কাগজপত্রে রয়ে যাবে। আমি একজন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, সেটি লেখালেখির মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে জানাতে পারছি, এটি আমার জন্য পরম আনন্দের। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে যে আন্তর্জাতিক মানের সিনেমার ট্রেড ম্যাগাজিন বের হয়, কাট টু সিনেমা, সেটি আমি বিশ্বের ২৭টি দেশের চলচ্চিত্র সমালোচক ও চলচ্চিত্রকর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে জানাতে পেরেছি। তাঁদের হাতে দিতে পেরেছি। শুধু তা-ই নয়, হাঙ্গেরির ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভেও যেন রাখা হয়, সেই অনুরোধ করেছি। তাঁরা কথা দিয়েছেন সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি তাঁরা সংরক্ষণ করবেন। কারণ, বুদাপেস্ট ম্যারাথনের অগ্রিম খবর সেখানে ছাপা হয়েছিল।

যত দিন যাচ্ছে বুদাপেস্টের ম্যারাথন তার গন্তব্য আরও সুদৃঢ় করে তুলছে। লোকে বলে লম্বা রেসের ঘোড়া। বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন লম্বা রেসেরই ঘোড়া। নয়তো তারা প্রতিবছর যেভাবে জীবিত কিংবদন্তি পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের আয়োজনে হাজির করছে এবং তাতে আকৃষ্ট হয়ে যেভাবে মানুষ উপস্থিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী ১০ বছরের ভেতর এই আয়োজন ইউরোপের এক অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হবে। একটু পেছনের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে, কেন এই কথাটি বললাম।

ম্যারাথন শুরুর পরের বছর, ২০১৮ সালে বুদাপেস্টের এই আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ইতালীয় চলচ্চিত্রের আইকন, সদ্যপ্রয়াত ক্লদিয়া কার্দিনাল। তিনি ম্যারাথনের ‘ইল গাত্তোপারদো’ সিনেমার স্ক্রিনিংয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া সে বছর উপস্থিত ছিলেন ‘ম্যাফিস্টো’খ্যাত অস্ট্রিয়ান অভিনেতা ক্লাউস মারিয়া ব্র্যান্ডওর, ‘দি বিগ ব্লু’খ্যাত জঁ মার্ক বার ও ইঙ্গমার বারিম্যানের দীর্ঘদিনের সহযোগী ও সুইডিশ প্রযোজক কাতিনকা ফার্গো।

ম্যারাথনে ২০১৯ সালের আয়োজনে ছিলেন ফ্রান্সের প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা পিয়ের রিচার্ড, ব্রিটিশ মিনিমালিস্ট কম্পোজার মাইকেল নাইমান, জার্মান গুণী অভিনেতা উদো কিয়ের, ‘দ্য ভ্যানিশিং’খ্যাত ডাচ অভিনেত্রী জোহানা টের স্টিজ, স্লোভাক অভিনেত্রী মাগদা ভাসারইয়োভা এবং হাঙ্গেরির অস্কারজয়ী পরিচালক ইস্তভান জাবো।

২০২০ সালে করোনার জন্য সাময়িক বিরতি, এরপর ২০২১ সালে সে রকম বিশ্বনন্দিত কেউ ম্যারাথনে যাননি। ২০২২ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর থিয়েরি ফ্রেমু উপস্থিত ছিলেন। ২০২৩ সালে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন স্কটিশ ফিল্মমেকার কেভিন ম্যাকডোনাল্ড, ব্রিটিশ প্রযোজক অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড, ‘ম্যালিনা’খ্যাত হাঙ্গেরীয় সিনেমাটোগ্রাফার লাজস কলতাই এবং ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান অ্যানিমেটর ও পরিচালক পিয়ের ফোলদেস। ২০২৪ সালে সব আলো একাই নিজের দিকে টেনে নেন জার্মান অতর ফিল্মমেকার ভিম ভেন্ডার্স। আর ২০২৫, অর্থাৎ এ বছর ছিলেন কানাডিয়ান পরিচালক ডেভিড ক্রোনেনবার্গ, তাঁকে বলা হয় মাস্টার অব বডি হরর। আরও উপস্থিত ছিলেন আমেরিকান-কানাডিয়ান এটম এগোয়ান, কানাডিয়ান প্রযোজক রবার্ট ল্যানতোস এবং হাঙ্গেরির অস্কারজয়ী পরিচালক ‘ম্যাফিস্তো’খ্যাত ইস্তভান জাবো। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় জাবোর ‘বিয়িং জুলিয়া’ ছবিটি দেখানো হয়। এই সুবাদে নির্মাতা জাবোর সঙ্গে দু-চারটি কথা বলারও সুযোগ হয় আমার।

গত ১৬ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা ম্যারাথনে ১২২টি স্ক্রিনিং ছাড়াও ছাত্রদের জন্য হয় ২৬টি স্ক্রিনিং, ৬টি গোলটেবিল বৈঠক, ৪টি সিনে কনসার্ট অর্থাৎ নির্বাক ছবির সঙ্গে লাইভ মিউজিক, ডেভিড ক্রোনেনবার্গের মাস্টারক্লাসসহ আরও অনেক কিছু। চলচ্চিত্রের ১৩০ বছর অতিক্রমের বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয় অষ্টম আসরে। বিশেষভাবে প্রদর্শন করা হয় লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের তৎকালে ধারণ করা বিরল কিছু রিল। দর্শক লুমিয়ের ভাইদের আত্মনিয়োগ দেখে অভিভূত হন। থিয়েরি ফ্রেম্যুর মাধ্যমে লুমিয়ের ভাইদের এই দুর্লভ কাজগুলো দেখানোর পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বুদাপেস্ট ক্লাসিকস ফিল্ম ম্যারাথন এবং হাঙ্গেরির ন্যাশনাল ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রিজারভেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডিভিশনের ডিরেক্টর গিয়োর্গি রাদুলি। দেখলাম এই মানুষটির উদ্যোগ ও উদ্যমে গোটা ম্যারাথন রকেটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য স্থির ও আপসহীন। রাজনীতির কারণে সরকার পরিবর্তন হলে ম্যারাথনে সেটার কোনো প্রভাব পড়ে না। তারা জানে, দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি রাজনৈতিক দল ও দলাদলির ঊর্ধ্বে। এই বোধ তাদের এক দিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এই জনপদের দীর্ঘ পথপরিক্রমা। এ কারণেই বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাঙ্গেরির অবদান অত্যন্ত উজ্জ্বল।

দেশটির ডজনখানেক নির্মাতার নাম বলা যাবে, যাঁরা বিশ্বদরবারে নিজেদের ফিল্মমেকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। বেলা তার, মিকোস ইয়াঙ্কসো, ইস্তভান জাবো, জোলতান ফাব্রি, কারোই মাক, মার্তা মেসজারোস, লাজলো নেমিস প্রমুখ। বলে রাখি, এদের ভেতর কারোই মাকের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হয়েছে ম্যারাথনের অষ্টম আসরে। তাঁর ১০টি ছবি সংস্কার করে দেখানো হয় এ বছর। ম্যারাথনে কারোই মাকের কোনো ছবি দেখার সুযোগ হয়নি আমার, তবে তাঁর বিখ্যাত ‘লাভ’ (১৯৭১) ছবিটি আগেই দেখেছিলাম। ইউরোপের আর ১০টা ছবির থেকে ভিন্ন বয়ান ও সম্পাদনা রীতি তাতে পরিস্ফুট। যদি চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ও পণ্ডিতদের কথা বলি, তাহলেও কিন্তু হাঙ্গেরির নাম আপনাকে নিতেই হবে। চলচ্চিত্র তত্ত্বের ভিত্তি যাঁরা স্থাপন করেছেন, তাঁদের ভেতর তো হাঙ্গেরির বেলা বালাজ অগ্রগণ্য তাত্ত্বিক। এ ছাড়া মার্ক্সবাদী দার্শনিক গিয়োর্গি লুকাস, আন্দ্রেস বালিন্ত কোভাকস, পলিন কায়েল প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এই নামগুলো অপরিচিত নয়। তা ছাড়া, আমরা যাঁরা শ্রেণিকক্ষে চলচ্চিত্র পড়াই, তাঁরাও হাঙ্গেরির এই চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের কাছে ঋণী। চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্য ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে হাঙ্গেরি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে আমাদের শেখার আছে। আমরাও যদি দুই ঈদের বাইরে, আমাদের দেশের ধ্রুপদি ছবিগুলো যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে পারি, অথবা চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে কালোত্তীর্ণ ছবির জন্য একটি বিভাগ রাখতে পারি, তবে তা তরুণ নির্মাতাদের জন্য দিকনির্দেশক হবে, পাশাপাশি মানুষ নতুন করে বড় পর্দায় দেশীয় ধ্রুপদি ছবি দেখে নিজেদের হীনম্মন্যতা কাটাতে পারবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাজধানীর মিরপুরে যাত্রী নামিয়ে গুলি ছুড়ে বাসে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা

দিল্লির সংকটকালে ভারতীয়-আমেরিকানদের বিস্ময়কর নীরবতা

শুধু ডিজিএফআইয়ের লোগোর সঙ্গে মিল থাকায় শাপলা না দেওয়া বৈষম্যমূলক: এনসিপি

মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে মুছে ফেলার হুমকি দিলেন ভারতের সেনাপ্রধান

তোফায়েল আহমেদের শারীরিক অবস্থা ‘অপরিবর্তিত’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত