সত্য সব সময় জনপ্রিয় নয়। কিন্তু জনপ্রিয় না হলে মানুষকে নিজের দিকে ধরে রাখা যাবে না, এটা জেনেই মিথ্যাচার করে থাকেন বক্তারা। সাধারণ মানুষ চাটনি মেশানো আবেগতাড়িত বক্তব্য শুনতে পছন্দ করে। তাই অতিরঞ্জিত কথা বলে মানুষকে কাছে টানার চেষ্টা করা হয়।
জাহীদ রেজা নূর
রাজনীতির মাঠে অশালীন শব্দ ব্যবহার করলে আর মিথ্যা কথা বললে জনপ্রিয়তা বাড়ে—এ রকম বক্তব্যসহ সহকর্মী জাহাঙ্গীর আলমের লেখা একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবারের আজকের পত্রিকায়। ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যদিও উপসম্পাদকীয়টি মার্কিনদের নিয়ে, কিন্তু সেটা একটু ডালপালা মেললেই আমাদের দেশ পর্যন্ত আসতে পারবে না—এমন কোনো কথা নেই। বরং আমরা রাজনীতিতে বিলক্ষণ অশালীনতার চর্চা করে যাচ্ছি এবং মিথ্যা কথার এক রমরমা অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, সেটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
কেন এ রকম ঘটল, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে এর একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে, সে কথাও বলা হয়েছে সেসব গবেষণায়। সেই সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু কারণ। বিষয়ে প্রবেশের আগে কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যাক, যেগুলো প্রায় সবাই শুনেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় এই উদাহরণগুলোই দেওয়া হলো।
এর মধ্যে একটি হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে গুটিকয় মানুষ উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন অশ্লীল স্লোগান দিচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়নি। যতক্ষণ তাঁদের মন চায়, ততক্ষণ তাঁরা সেখানে অবস্থান করে অশ্লীল বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছেন। সেখানে এক তরুণীকে দেখা গেল বেশ রোমাঞ্চ নিয়েই একটি ‘রসালো’ স্লোগান দিচ্ছেন। প্রথম বাক্য ‘টিনের চালে কাউয়ার সঙ্গে’ অন্ত্যমিল দিয়ে পরবর্তী বাক্যটিতে তিনি ব্যবহার করেছেন এমন একটি শব্দ, যা দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় নারীর জননেন্দ্রিয়কে বোঝায়। সেই স্লোগানে আনন্দ পাচ্ছিলেন উপস্থিত সতীর্থরা। তাঁরাও অতি উৎসাহের সঙ্গে, অবলীলায় একই স্লোগান দিয়েছেন। বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধাকে ‘তুই-তোকারি’ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাম বিকৃত করে ‘ফজু পাগলা’ করে ফেলা হচ্ছিল। সেটাও যেন এক আমোদের ব্যাপার! অরুচিকর স্লোগান দেওয়া যে তরুণীর কথা বলা হলো, তিনি সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
‘কাউয়া’র সঙ্গে অন্ত্যমিল দিয়ে জননেন্দ্রিয়ের আঞ্চলিক নামটি উচ্চারণ করে বক্তৃতা করতে দেখা গেছে ৫ আগস্টের পর গঠিত তরুণদের এক সংগঠনের নেতাকেও। অশোভন গালাগালও শোনা গেছে সেই একই বক্তৃতায়। ‘খ’ ‘চ’ বর্গ দিয়ে তৈরি গালাগালগুলো এখন প্রকাশ্যে ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। সেগুলো ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে।
বক্তৃতা-বয়ানে ডাহা মিথ্যা কথা বলারও বহু উদাহরণ দেখা যাচ্ছে। তাজা বিষয়টির দিকেই চোখ রাখি। সম্প্রতি একজন ধর্মীয় বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘আজান দিতে দেওয়া হয়নি’ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সকালবেলায় ‘মদ দিয়ে কুলি করে’—এ মর্মে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে তোলপাড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে বক্তাকে ক্ষমা চাইতে বলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় সকালবেলা মদ দিয়ে কুলি করা হয় বলে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তা আরও অদ্ভুত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে দায়িত্বশীল কেউ এ রকম মিথ্যাচার করতে পারে, এটা ভাবাই যায় না। স্বাভাবিকভাবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। এই দুই ঘটনার পর ওই ধর্মীয় বক্তা যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা তাকে বিতর্কিত মন্তব্য করতে নিষেধ করে দেয়।
কিন্তু এভাবে লাগাতার মিথ্যা কথা বলার পর কেউ যদি ক্ষমা চায়, তাহলেই কি এর প্রতিকার হয়ে যায়? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব বক্তব্য অনেকেই বিশ্বাস করবে। তারা বলে বেড়াবে, মুহসীন হলে সত্যিই ১৬ বছর আজান হয়নি। তারা বলে বেড়াবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকালে মদ দিয়ে কুলি করে।
২.
কখন মানুষ অশালীন কথা বলে? কখন মানুষ মিথ্যাচার করে?
ভব্য সমাজে অশালীনতার স্থান নেই। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনযাপনে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে বিদ্রোহ বা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কখনো কখনো অশালীন শব্দাবলি উচ্চারিত হয়। সমাজে যখন সরাসরি প্রতিবাদের সুযোগ কম থাকে, তখন অশ্লীল ছড়া, অশ্লীল স্লোগান দেখা যায়। একধরনের অবদমিত রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও তার দেখা পাওয়া যায়। অশালীনতা সরাসরি মনে ধাক্কা মারে, তাই তা জুতসই হয়ে ওঠে কখনো কখনো। অনলাইনের এই যুগে নতুন যেটা হচ্ছে, সেটা হলো ভিউ-প্রীতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন কিছু বললে তা দেখার জন্য উৎসুক হয় মানুষ। তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অর্থকড়ি আগমনের পথও সুগম হয়। মিথ্যা বা বেফাঁস কথা প্রচারে কারও কারও আগ্রহের কারণও তা-ই। ওই যে, সেই পুরোনো কথাটা এখানেও খাটে—নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই আকর্ষণ বেশি থাকে।
এসব স্লোগান বা বক্তৃতার মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে ছোট করা। শালীন ভাষায় বললে তা গায়ে লাগে না, তাই ছুড়ে মারা হয় অশালীনতার তির—এই আঘাত সামলানো কঠিন।
আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিন অর্থাৎ কিনা সাহিত্য–সংস্কৃতির ছোটকাগজগুলো বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে এসেছে। মূলধারার গণমাধ্যম বা সাহিত্যচর্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এখন বিশ্বজুড়েই মূলধারার গণমাধ্যম নিয়ে মানুষের সন্দেহ ও হতাশা বেড়েছে। যা ঘটছে, তার পুরো সঠিক বা সম্পূর্ণ তথ্য মূলধারার গণমাধ্যমে পাওয়া যায় না—এ রকম একটি ধারণা গড়ে উঠেছে জনগণের, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ফলে তথ্যের জন্য তারা বেছে নিচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ধরনের মাধ্যমকে। সেই তথ্যসমুদ্রে অমিয়-গরল দুই-ই আছে বিস্তর। কিন্তু সরাসরি সেখান থেকেই তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে বহু মানুষ। যেহেতু সেখানে কোনো সম্পাদনার বালাই নেই, তাই সরাসরি বক্তব্যে যা খুশি তা বলায় বাধাও নেই। সেদিকেই মানুষ ঝুঁকছে বলে এর মাধ্যমে উঠে আসা অশালীনতাও একটা ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। আরও একটা ব্যাপার, দায়িত্বশীলতার দায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় চমক থাকে কম। ফলে মার্জিত ভাষার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। অশালীন শব্দ উচ্চারণ করে মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ বলে এই পথটিকে বেছে নিচ্ছে অনেকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রাজনীতিসহ বিভিন্ন জায়গায় মূলত অভিজাত বা শিক্ষিত শ্রেণির আধিপত্য ছিল দীর্ঘদিন। সেই আধিপত্য খর্ব হয়েছে প্রযুক্তির প্রসারের কারণে। এখন অভিজাত বলবে, আমি শুনব—এই জায়গা থেকে সরে গেছে নিত্যদিনের জীবন। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই যে কেউ বলে ফেলতে পারছে যা খুশি তাই। ফলে, অস্বীকার করা যাবে না, নতুন এক বাস্তবতার জন্ম হয়েছে।
কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে বসে ‘কাউয়া’ স্লোগান দেওয়াকে সেই প্রতিবাদের মধ্যে কি ফেলা সম্ভব, যা সরকারের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উচ্চারণ করা যায়? ফজলুর রহমানের শক্তি কী? মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থাই তাঁর শক্তির জায়গা। সেই জায়গাটিকে যখন আঘাত করা হচ্ছে, তখন বুঝতে হয়, এর পেছনে কিছু মতলব আছে। এটা সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নয়।
৩.
করোনার সময় একদল বক্তার আগমন ঘটেছিল, যারা ওই ভয়াবহ মহামারির মধ্যেও ধর্মের নাম করে অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা ছড়িয়েছিলেন। কেউ একজন বলেছিলেন, কোনো মুসলমানের কোভিড হবে না। কেউ নিজেই ‘আবিষ্কার করেছিলেন’ কোভিড মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। আরও কত হাস্যকর বার্তাই না তারা দিয়েছিল! সরলমতি ধর্মপরায়ণ মানুষের মাঝে এইসব বিপজ্জনক মিথ্যা ছড়ানো সমীচীন নয় জেনেও যখন তা ছড়ানো হয়, তখন সত্যিই কপালে ভাঁজ পড়ে। দেশে বয়ান-বক্তৃতায় ধর্মীয় বক্তা বা রাজনীতিবিদেরা অযৌক্তিক এমনকি মিথ্যা কথা বললেও সাধারণত তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয় না। কেউ করেন না ভয়ে, কেউ করেন না বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই বলে।
সম্প্রতি সমালোচনার ঝড় তোলা ধর্মীয় বক্তা যেভাবে শিক্ষার্থীদের হেয় করলেন, তার প্রতিবাদ হতে পারল সচেতন তরুণদের সম্মিলিত শক্তির কারণে। মূলত নির্দিষ্ট হল বা নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ‘ধরা’ খেলেন ধর্মভিত্তিক দলটির এই নেতা। এ কথাগুলোই যদি তিনি বলতেন কোনো ওয়াজ মাহফিলে, তাহলে কি এ রকম প্রতিবাদ হতো? প্রশ্নটি এড়ানো যাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও যে কত বানানো গল্প চালু রেখেছেন, তার কি ইয়ত্তা আছে? সেগুলো নিয়ে আরেক দিন বলা যাবে।
কেন মিথ্যাচার ছড়ানো হয়, তার কিছু কারণও এখানে বলে রাখা ভালো। সত্য সব সময় জনপ্রিয় নয়। কিন্তু জনপ্রিয় না হলে মানুষকে নিজের দিকে ধরে রাখা যাবে না, এটা জেনেই মিথ্যাচার করে থাকেন বক্তারা। সাধারণ মানুষ চাটনি মেশানো আবেগতাড়িত বক্তব্য শুনতে পছন্দ করে। তাই অতিরঞ্জিত কথা বলে মানুষকে কাছে টানার চেষ্টা করা হয়। আরও একটা সাংঘাতিক ব্যাপার রয়েছে। বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাদের নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে হেয় করা হয়।
৪.
অশালীনতা ও মিথ্যা যদি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে শুভবুদ্ধির উদয় হবে না। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না, সত্যিই বিশ্বজুড়ে অশালীনতা আর মিথ্যার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। প্রচলিত মূল্যবোধ দিয়ে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে উত্তর খোঁজার আগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, পরিবর্তিত মনন, পরিবর্তিত সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা করা দরকার। তখন হয়তো এই পরিবর্তনের উৎসমূল খুঁজে পাওয়া যাবে। সন্ধান মিলবে পরিত্রাণের পথেরও।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রাজনীতির মাঠে অশালীন শব্দ ব্যবহার করলে আর মিথ্যা কথা বললে জনপ্রিয়তা বাড়ে—এ রকম বক্তব্যসহ সহকর্মী জাহাঙ্গীর আলমের লেখা একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবারের আজকের পত্রিকায়। ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যদিও উপসম্পাদকীয়টি মার্কিনদের নিয়ে, কিন্তু সেটা একটু ডালপালা মেললেই আমাদের দেশ পর্যন্ত আসতে পারবে না—এমন কোনো কথা নেই। বরং আমরা রাজনীতিতে বিলক্ষণ অশালীনতার চর্চা করে যাচ্ছি এবং মিথ্যা কথার এক রমরমা অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি, সেটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো।
কেন এ রকম ঘটল, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে এর একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে, সে কথাও বলা হয়েছে সেসব গবেষণায়। সেই সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু কারণ। বিষয়ে প্রবেশের আগে কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যাক, যেগুলো প্রায় সবাই শুনেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় এই উদাহরণগুলোই দেওয়া হলো।
এর মধ্যে একটি হলো, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে গুটিকয় মানুষ উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন অশ্লীল স্লোগান দিচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়নি। যতক্ষণ তাঁদের মন চায়, ততক্ষণ তাঁরা সেখানে অবস্থান করে অশ্লীল বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছেন। সেখানে এক তরুণীকে দেখা গেল বেশ রোমাঞ্চ নিয়েই একটি ‘রসালো’ স্লোগান দিচ্ছেন। প্রথম বাক্য ‘টিনের চালে কাউয়ার সঙ্গে’ অন্ত্যমিল দিয়ে পরবর্তী বাক্যটিতে তিনি ব্যবহার করেছেন এমন একটি শব্দ, যা দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় নারীর জননেন্দ্রিয়কে বোঝায়। সেই স্লোগানে আনন্দ পাচ্ছিলেন উপস্থিত সতীর্থরা। তাঁরাও অতি উৎসাহের সঙ্গে, অবলীলায় একই স্লোগান দিয়েছেন। বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধাকে ‘তুই-তোকারি’ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাম বিকৃত করে ‘ফজু পাগলা’ করে ফেলা হচ্ছিল। সেটাও যেন এক আমোদের ব্যাপার! অরুচিকর স্লোগান দেওয়া যে তরুণীর কথা বলা হলো, তিনি সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
‘কাউয়া’র সঙ্গে অন্ত্যমিল দিয়ে জননেন্দ্রিয়ের আঞ্চলিক নামটি উচ্চারণ করে বক্তৃতা করতে দেখা গেছে ৫ আগস্টের পর গঠিত তরুণদের এক সংগঠনের নেতাকেও। অশোভন গালাগালও শোনা গেছে সেই একই বক্তৃতায়। ‘খ’ ‘চ’ বর্গ দিয়ে তৈরি গালাগালগুলো এখন প্রকাশ্যে ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। সেগুলো ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে।
বক্তৃতা-বয়ানে ডাহা মিথ্যা কথা বলারও বহু উদাহরণ দেখা যাচ্ছে। তাজা বিষয়টির দিকেই চোখ রাখি। সম্প্রতি একজন ধর্মীয় বক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘আজান দিতে দেওয়া হয়নি’ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সকালবেলায় ‘মদ দিয়ে কুলি করে’—এ মর্মে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে তোলপাড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে বক্তাকে ক্ষমা চাইতে বলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় সকালবেলা মদ দিয়ে কুলি করা হয় বলে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তা আরও অদ্ভুত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে দায়িত্বশীল কেউ এ রকম মিথ্যাচার করতে পারে, এটা ভাবাই যায় না। স্বাভাবিকভাবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। এই দুই ঘটনার পর ওই ধর্মীয় বক্তা যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা তাকে বিতর্কিত মন্তব্য করতে নিষেধ করে দেয়।
কিন্তু এভাবে লাগাতার মিথ্যা কথা বলার পর কেউ যদি ক্ষমা চায়, তাহলেই কি এর প্রতিকার হয়ে যায়? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব বক্তব্য অনেকেই বিশ্বাস করবে। তারা বলে বেড়াবে, মুহসীন হলে সত্যিই ১৬ বছর আজান হয়নি। তারা বলে বেড়াবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকালে মদ দিয়ে কুলি করে।
২.
কখন মানুষ অশালীন কথা বলে? কখন মানুষ মিথ্যাচার করে?
ভব্য সমাজে অশালীনতার স্থান নেই। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনযাপনে অতিষ্ঠ হয়ে গেলে বিদ্রোহ বা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কখনো কখনো অশালীন শব্দাবলি উচ্চারিত হয়। সমাজে যখন সরাসরি প্রতিবাদের সুযোগ কম থাকে, তখন অশ্লীল ছড়া, অশ্লীল স্লোগান দেখা যায়। একধরনের অবদমিত রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও তার দেখা পাওয়া যায়। অশালীনতা সরাসরি মনে ধাক্কা মারে, তাই তা জুতসই হয়ে ওঠে কখনো কখনো। অনলাইনের এই যুগে নতুন যেটা হচ্ছে, সেটা হলো ভিউ-প্রীতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন কিছু বললে তা দেখার জন্য উৎসুক হয় মানুষ। তাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অর্থকড়ি আগমনের পথও সুগম হয়। মিথ্যা বা বেফাঁস কথা প্রচারে কারও কারও আগ্রহের কারণও তা-ই। ওই যে, সেই পুরোনো কথাটা এখানেও খাটে—নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই আকর্ষণ বেশি থাকে।
এসব স্লোগান বা বক্তৃতার মূল লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে ছোট করা। শালীন ভাষায় বললে তা গায়ে লাগে না, তাই ছুড়ে মারা হয় অশালীনতার তির—এই আঘাত সামলানো কঠিন।
আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিন অর্থাৎ কিনা সাহিত্য–সংস্কৃতির ছোটকাগজগুলো বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে এসেছে। মূলধারার গণমাধ্যম বা সাহিত্যচর্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এখন বিশ্বজুড়েই মূলধারার গণমাধ্যম নিয়ে মানুষের সন্দেহ ও হতাশা বেড়েছে। যা ঘটছে, তার পুরো সঠিক বা সম্পূর্ণ তথ্য মূলধারার গণমাধ্যমে পাওয়া যায় না—এ রকম একটি ধারণা গড়ে উঠেছে জনগণের, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ফলে তথ্যের জন্য তারা বেছে নিচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ধরনের মাধ্যমকে। সেই তথ্যসমুদ্রে অমিয়-গরল দুই-ই আছে বিস্তর। কিন্তু সরাসরি সেখান থেকেই তথ্য সংগ্রহ করে নিচ্ছে বহু মানুষ। যেহেতু সেখানে কোনো সম্পাদনার বালাই নেই, তাই সরাসরি বক্তব্যে যা খুশি তা বলায় বাধাও নেই। সেদিকেই মানুষ ঝুঁকছে বলে এর মাধ্যমে উঠে আসা অশালীনতাও একটা ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে। আরও একটা ব্যাপার, দায়িত্বশীলতার দায় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় চমক থাকে কম। ফলে মার্জিত ভাষার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। অশালীন শব্দ উচ্চারণ করে মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ বলে এই পথটিকে বেছে নিচ্ছে অনেকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রাজনীতিসহ বিভিন্ন জায়গায় মূলত অভিজাত বা শিক্ষিত শ্রেণির আধিপত্য ছিল দীর্ঘদিন। সেই আধিপত্য খর্ব হয়েছে প্রযুক্তির প্রসারের কারণে। এখন অভিজাত বলবে, আমি শুনব—এই জায়গা থেকে সরে গেছে নিত্যদিনের জীবন। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই যে কেউ বলে ফেলতে পারছে যা খুশি তাই। ফলে, অস্বীকার করা যাবে না, নতুন এক বাস্তবতার জন্ম হয়েছে।
কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে বসে ‘কাউয়া’ স্লোগান দেওয়াকে সেই প্রতিবাদের মধ্যে কি ফেলা সম্ভব, যা সরকারের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উচ্চারণ করা যায়? ফজলুর রহমানের শক্তি কী? মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থাই তাঁর শক্তির জায়গা। সেই জায়গাটিকে যখন আঘাত করা হচ্ছে, তখন বুঝতে হয়, এর পেছনে কিছু মতলব আছে। এটা সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নয়।
৩.
করোনার সময় একদল বক্তার আগমন ঘটেছিল, যারা ওই ভয়াবহ মহামারির মধ্যেও ধর্মের নাম করে অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা ছড়িয়েছিলেন। কেউ একজন বলেছিলেন, কোনো মুসলমানের কোভিড হবে না। কেউ নিজেই ‘আবিষ্কার করেছিলেন’ কোভিড মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। আরও কত হাস্যকর বার্তাই না তারা দিয়েছিল! সরলমতি ধর্মপরায়ণ মানুষের মাঝে এইসব বিপজ্জনক মিথ্যা ছড়ানো সমীচীন নয় জেনেও যখন তা ছড়ানো হয়, তখন সত্যিই কপালে ভাঁজ পড়ে। দেশে বয়ান-বক্তৃতায় ধর্মীয় বক্তা বা রাজনীতিবিদেরা অযৌক্তিক এমনকি মিথ্যা কথা বললেও সাধারণত তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয় না। কেউ করেন না ভয়ে, কেউ করেন না বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই বলে।
সম্প্রতি সমালোচনার ঝড় তোলা ধর্মীয় বক্তা যেভাবে শিক্ষার্থীদের হেয় করলেন, তার প্রতিবাদ হতে পারল সচেতন তরুণদের সম্মিলিত শক্তির কারণে। মূলত নির্দিষ্ট হল বা নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ‘ধরা’ খেলেন ধর্মভিত্তিক দলটির এই নেতা। এ কথাগুলোই যদি তিনি বলতেন কোনো ওয়াজ মাহফিলে, তাহলে কি এ রকম প্রতিবাদ হতো? প্রশ্নটি এড়ানো যাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও যে কত বানানো গল্প চালু রেখেছেন, তার কি ইয়ত্তা আছে? সেগুলো নিয়ে আরেক দিন বলা যাবে।
কেন মিথ্যাচার ছড়ানো হয়, তার কিছু কারণও এখানে বলে রাখা ভালো। সত্য সব সময় জনপ্রিয় নয়। কিন্তু জনপ্রিয় না হলে মানুষকে নিজের দিকে ধরে রাখা যাবে না, এটা জেনেই মিথ্যাচার করে থাকেন বক্তারা। সাধারণ মানুষ চাটনি মেশানো আবেগতাড়িত বক্তব্য শুনতে পছন্দ করে। তাই অতিরঞ্জিত কথা বলে মানুষকে কাছে টানার চেষ্টা করা হয়। আরও একটা সাংঘাতিক ব্যাপার রয়েছে। বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাদের নামে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে হেয় করা হয়।
৪.
অশালীনতা ও মিথ্যা যদি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে শুভবুদ্ধির উদয় হবে না। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না, সত্যিই বিশ্বজুড়ে অশালীনতা আর মিথ্যার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। প্রচলিত মূল্যবোধ দিয়ে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে উত্তর খোঁজার আগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, পরিবর্তিত মনন, পরিবর্তিত সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা করা দরকার। তখন হয়তো এই পরিবর্তনের উৎসমূল খুঁজে পাওয়া যাবে। সন্ধান মিলবে পরিত্রাণের পথেরও।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভাইরাল নিউজ চোখে পড়ল। একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ক্লিনার বকশিশ চেয়ে না পেয়ে অসুস্থ শিশুর মুখ থেকে অক্সিজেনের মাস্ক খুলে ফেলেন। এতে সেই শিশুর একপর্যায়ে করুণ মৃত্যু হয়। এমন অভিযোগ শিশুর মায়ের।
২ ঘণ্টা আগেবাগছাস নেতা এসে স্কুলের ফেল করা শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়ে যাচ্ছেন—এটাকে কি রূপকথার গল্প বলে মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে কারও অলীক কল্পনা? চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হারাটি উচ্চবিদ্যালয়ের অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটির আহ্বায়ক হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহম্মদ।
২ ঘণ্টা আগেদেশের দু’টি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ—ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের অভাবনীয় উত্থান সাম্প্রতিক ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যে সংগঠনটি অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে নিষিদ্ধ ছিল, তারাই কীভাবে এত সংখ্যক পদে জয়ী হলো—এই প্রশ্ন শিক্ষিত সমাজকে
৮ ঘণ্টা আগেযশোর-খুলনা অঞ্চলের দুঃখ বলা হয় ভবদহকে। কারণ, প্রায় চার দশক ধরে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এক অভিশপ্ত জলাবদ্ধতার শিকার। বছরের অধিকাংশ সময়ই তারা পানির মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। বিভিন্ন সরকারের আমলে জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কোনোটাই তাদের জীবনে স্বস্তি বয়ে আনেনি।
১ দিন আগে