আরব বিশ্বের নতুন উপলব্ধি
ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
কাতারের আকাশে সেই রাতের নীরবতা হঠাৎই ভেঙে গেল এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের গর্জনে। দোহায় হামাসের এক শীর্ষ নেতাকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যেন শুধু একটি বাড়ি নয়, ভেঙে দিল গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা-সমীকরণের দেয়াল। কাতার—যে নগরী এত দিন কূটনৈতিক আলোচনার মঞ্চ ছিল, শান্তির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করত, সেই নগরীর বুকেও যদি ইসরায়েলের আগ্রাসী শক্তি পৌঁছে যায়, তবে প্রশ্ন জাগে: সত্যিকার শত্রু কে?
দশকের পর দশক ধরে উপসাগরীয় শাসকেরা ইরানকে ভয়ের কেন্দ্র বলে বিবেচনা করেছেন। ইরানের সীমান্ত অতিক্রমী প্রভাব, পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আঞ্চলিক মিত্রগোষ্ঠীকে দেওয়া সহায়তা—সবকিছুই যেন নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দোহায় সেই ক্ষণিক বিস্ফোরণ যেন চোখের সামনে নতুন এক বাস্তবতা উন্মোচন করল। ভীতির কেন্দ্রে ইরান নয়—বরং আরও কাছে, আরও প্রবল, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইসরায়েল।
রাতের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আগুন কেবল এক ব্যক্তির জীবনই নিভিয়ে দেয়নি, বরং আরব রাজনীতির অভ্যন্তরে বপন করেছে এক গভীর প্রশ্নবীজ—এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ হুমকি আসলে কোথা থেকে আসছে? ইরানের পূর্বপরিচিত আচরণ, নাকি ইসরায়েলের অপ্রত্যাশিত উন্মত্ততা?
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তের বাইরে সামরিক হামলার যৌক্তিকতা দাঁড় করিয়েছে ‘জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আগাম আঘাত’ হিসেবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ছয়টি দেশে লক্ষ্যভেদী অভিযান চালিয়েছে—লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, এমনকি ইরান পর্যন্ত। তবে কাতারে হামলা একেবারেই ভিন্ন ধরনের বার্তা বহন করে। কারণ, কাতার শুধু ধনী উপসাগরীয় রাজতন্ত্র নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সহযোগী, ন্যাটোবহির্ভূত প্রধান মিত্র এবং ইসরায়েল-হামাস আলোচনার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী। এই বাস্তবতায় দোহায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুধু একটি সামরিক ঘটনা নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ।
আঘাত হেনেছে দোহার এক অভিজাত আবাসিক এলাকায়, যেখানে সম্প্রতি সফর করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং যার খুব কাছেই অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। এই প্রেক্ষাপট উপসাগরীয় শাসকদের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। এত দিন ধরে তাঁরা যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করতেন, সেই নিশ্চয়তা আদৌ কতটা নির্ভরযোগ্য—এই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে। হামলার ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ছত্রচ্ছায়া থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল তার কৌশলগত স্বার্থে যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে দ্বিধা করছে না।
ফলে কাতারের ঘটনাটি গোটা উপসাগরীয় ভূরাজনীতিতে এক নতুন উপলব্ধি তৈরি করেছে। এত দিন যেখানে নিরাপত্তাঝুঁকির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরান, সেখানে ইসরায়েলের এই আগ্রাসী অবস্থান এবং পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি তার প্রকাশ্য অবজ্ঞা এখন আরব নেতাদের সামনে নতুন প্রশ্ন তুলে ধরছে: প্রকৃত হুমকি কার কাছ থেকে—ইরানের পূর্বানুমেয় প্রভাব বিস্তার নীতি, নাকি ইসরায়েলের সীমাহীন আগ্রাসী সামরিক কৌশল?
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে উপসাগরীয় নিরাপত্তাকাঠামোর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরান।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত আঞ্চলিক মিত্রগোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া এবং সীমান্ত অতিক্রম করে আঘাত হানার সক্ষমতা—এসবই আরব দেশগুলোর কাছে প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। ফলে উপসাগরীয় রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের ইরানভীতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই চিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার সামরিক অভিযান, পশ্চিম তীরে দমননীতির তীব্রতা বৃদ্ধি এবং লেবানন-সিরিয়া-কাতারে ধারাবাহিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আরব রাষ্ট্রগুলোর সামনে এক নতুন বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল এখন কেবল ফিলিস্তিন প্রশ্নেই নয়, বরং পুরো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যই প্রধান অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেকের কাছে এটি একধরনের নিরাপত্তা-ধারণার পুনর্নির্মাণ, যেখানে ইরানের ভূমিকা যেমন এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি ইসরায়েলও এক অপ্রত্যাশিত ও ক্রমবর্ধমান হুমকিতে রূপ নিয়েছে।
ইরানের আগ্রাসী কার্যক্রম আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছে নতুন কিছু নয়—তার আচরণ তুলনামূলকভাবে পূর্বানুমানযোগ্য, যদিও তা মোকাবিলা করা কঠিন। কিন্তু ইসরায়েলের বর্তমান আচরণ অনেক বেশি অনিশ্চিত ও বেপরোয়া। সে শুধু আঞ্চলিক সামরিক প্রেক্ষাপটকেই অস্থির করছে না, বরং প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টাচার, আন্তর্জাতিক সমঝোতা এবং নিরাপত্তার মৌলিক নিয়মাবলিকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ফলত, উপসাগরীয় শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে—যেখানে ইরান আর একক হুমকি নয়, বরং ইসরায়েলকেও সমানভাবে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আরও বড় হুমকি হিসেবে দেখা শুরু হয়েছে।
টানা দুই মার্কিন প্রশাসন—ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন কেউই ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হননি কিংবা নিতে চাননি। ওয়াশিংটন বহু বছর ধরে আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আশ্বাস দিয়ে এসেছে, কিন্তু দোহায় হামলার পর সেই আশ্বাসের বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উপসাগরীয় শাসকদের কাছে এখন পরিষ্কার হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা রাখে না, অথবা ইচ্ছুক নয়, এমনকি যখন বিষয়টি তাদের নিকটতম মিত্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
এই নতুন বাস্তবতা আরব দেশগুলোকে ভিন্ন পথ খুঁজতে বাধ্য করছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার পাশাপাশি তারা ক্রমেই চীন ও তুরস্কের মতো শক্তির দিকে ঝুঁকছে, যারা বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদার হতে পারে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা, বিশেষ করে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় যেসব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা এখন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। গাজায় চলমান যুদ্ধ ও উপসাগরীয় মিত্রদের ভেতরে তীব্র অসন্তোষ সেই প্রক্রিয়াকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ফলে মার্কিন নীতি ও ভূমিকা নিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে যে আঞ্চলিক নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে ধরা হতো, দোহায় হামলার পর সেই ভাবমূর্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর কৌশলগত হিসাব এখন নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে—যেখানে আর একমাত্র ভরসা ওয়াশিংটন নয়, বরং বহুমুখী অংশীদারত্বই হয়ে উঠছে টিকে থাকার কৌশল।
দোহায় হামলা শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনা নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকাঠামোর পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যের নতুন সূচনা। দীর্ঘদিন ধরে যেখানে ইরানকে উপসাগরীয় নিরাপত্তার মূল হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেখানে এখন বাস্তবতাটি ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং কাতারে ইসরায়েলের ধারাবাহিক সামরিক পদক্ষেপ এবং অনিশ্চিত নীতি আরব শাসকদের কাছে এটিকে প্রধান অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলো কেবল প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের দিকে মনোনিবেশ করছে না; বরং তারা কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতার সীমাবদ্ধতা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তারা বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্ব, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং চীন ও তুরস্কের মতো শক্তিশালী বাহ্যিক মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে এখন প্রশ্ন আর শুধু এটুকুই নয় যে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না, বরং কী ধরনের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল গ্রহণ করবে, তা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
দোহায় হামলা মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ও নিরাপত্তার খেলা-ক্ষেত্রকে এক নতুন ধাক্কা দিয়েছে—যেমন ঝড়ের আগমনের আগে আকাশে স্থিরতা ভেঙে যায়, তেমনি দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা ধ্যানধারণার স্তরও এই ঘটনার সঙ্গে ভেঙে পড়েছে। এত দিন যেখানে ইরানকে মূল হুমকি বলে ধরা হতো, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলও সমানভাবে অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত এবং অস্থিরতার প্রতীক। এই বিস্ফোরণ শুধু ভূরাজনৈতিক স্থিতি নয়, বরং উপসাগরীয় শাসকদের অন্তরেও একটি গভীর সচেতনতার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন, নিরাপত্তার জন্য একক নির্ভরতা—যা বহু বছর ধরে ওয়াশিংটনের ওপর তৈরি হয়েছিল—এখন আর যথেষ্ট নয়।
ফলে তাঁরা নিজেরা পথ তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন—নিজস্ব কৌশল, বহুপক্ষীয় অংশীদারত্ব এবং নতুন আন্তর্জাতিক সমীকরণের দিকে চোখ রেখেই। এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি, অংশীদারত্ব এবং স্থিতিশীলতার নিদর্শনকে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে। আরব বিশ্বের এই আত্মনির্ভরতার সন্ধানে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতি ও শক্তির ভারসাম্য পুনঃস্থাপিত হবে, যা শুধু রাজনীতিক নয়, বরং ইতিহাসের পাঠেও একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
কাতারের আকাশে সেই রাতের নীরবতা হঠাৎই ভেঙে গেল এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের গর্জনে। দোহায় হামাসের এক শীর্ষ নেতাকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যেন শুধু একটি বাড়ি নয়, ভেঙে দিল গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা-সমীকরণের দেয়াল। কাতার—যে নগরী এত দিন কূটনৈতিক আলোচনার মঞ্চ ছিল, শান্তির মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করত, সেই নগরীর বুকেও যদি ইসরায়েলের আগ্রাসী শক্তি পৌঁছে যায়, তবে প্রশ্ন জাগে: সত্যিকার শত্রু কে?
দশকের পর দশক ধরে উপসাগরীয় শাসকেরা ইরানকে ভয়ের কেন্দ্র বলে বিবেচনা করেছেন। ইরানের সীমান্ত অতিক্রমী প্রভাব, পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আঞ্চলিক মিত্রগোষ্ঠীকে দেওয়া সহায়তা—সবকিছুই যেন নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দোহায় সেই ক্ষণিক বিস্ফোরণ যেন চোখের সামনে নতুন এক বাস্তবতা উন্মোচন করল। ভীতির কেন্দ্রে ইরান নয়—বরং আরও কাছে, আরও প্রবল, আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইসরায়েল।
রাতের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আগুন কেবল এক ব্যক্তির জীবনই নিভিয়ে দেয়নি, বরং আরব রাজনীতির অভ্যন্তরে বপন করেছে এক গভীর প্রশ্নবীজ—এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ হুমকি আসলে কোথা থেকে আসছে? ইরানের পূর্বপরিচিত আচরণ, নাকি ইসরায়েলের অপ্রত্যাশিত উন্মত্ততা?
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তের বাইরে সামরিক হামলার যৌক্তিকতা দাঁড় করিয়েছে ‘জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় আগাম আঘাত’ হিসেবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ছয়টি দেশে লক্ষ্যভেদী অভিযান চালিয়েছে—লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, এমনকি ইরান পর্যন্ত। তবে কাতারে হামলা একেবারেই ভিন্ন ধরনের বার্তা বহন করে। কারণ, কাতার শুধু ধনী উপসাগরীয় রাজতন্ত্র নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সহযোগী, ন্যাটোবহির্ভূত প্রধান মিত্র এবং ইসরায়েল-হামাস আলোচনার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী। এই বাস্তবতায় দোহায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুধু একটি সামরিক ঘটনা নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ।
আঘাত হেনেছে দোহার এক অভিজাত আবাসিক এলাকায়, যেখানে সম্প্রতি সফর করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং যার খুব কাছেই অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। এই প্রেক্ষাপট উপসাগরীয় শাসকদের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার জন্ম দিয়েছে। এত দিন ধরে তাঁরা যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার জন্য ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করতেন, সেই নিশ্চয়তা আদৌ কতটা নির্ভরযোগ্য—এই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে। হামলার ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ছত্রচ্ছায়া থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল তার কৌশলগত স্বার্থে যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে দ্বিধা করছে না।
ফলে কাতারের ঘটনাটি গোটা উপসাগরীয় ভূরাজনীতিতে এক নতুন উপলব্ধি তৈরি করেছে। এত দিন যেখানে নিরাপত্তাঝুঁকির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরান, সেখানে ইসরায়েলের এই আগ্রাসী অবস্থান এবং পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি তার প্রকাশ্য অবজ্ঞা এখন আরব নেতাদের সামনে নতুন প্রশ্ন তুলে ধরছে: প্রকৃত হুমকি কার কাছ থেকে—ইরানের পূর্বানুমেয় প্রভাব বিস্তার নীতি, নাকি ইসরায়েলের সীমাহীন আগ্রাসী সামরিক কৌশল?
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে উপসাগরীয় নিরাপত্তাকাঠামোর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরান।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত আঞ্চলিক মিত্রগোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া এবং সীমান্ত অতিক্রম করে আঘাত হানার সক্ষমতা—এসবই আরব দেশগুলোর কাছে প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। ফলে উপসাগরীয় রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের ইরানভীতির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই চিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার সামরিক অভিযান, পশ্চিম তীরে দমননীতির তীব্রতা বৃদ্ধি এবং লেবানন-সিরিয়া-কাতারে ধারাবাহিক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আরব রাষ্ট্রগুলোর সামনে এক নতুন বাস্তবতা উন্মোচন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল এখন কেবল ফিলিস্তিন প্রশ্নেই নয়, বরং পুরো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যই প্রধান অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেকের কাছে এটি একধরনের নিরাপত্তা-ধারণার পুনর্নির্মাণ, যেখানে ইরানের ভূমিকা যেমন এখনো ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি ইসরায়েলও এক অপ্রত্যাশিত ও ক্রমবর্ধমান হুমকিতে রূপ নিয়েছে।
ইরানের আগ্রাসী কার্যক্রম আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছে নতুন কিছু নয়—তার আচরণ তুলনামূলকভাবে পূর্বানুমানযোগ্য, যদিও তা মোকাবিলা করা কঠিন। কিন্তু ইসরায়েলের বর্তমান আচরণ অনেক বেশি অনিশ্চিত ও বেপরোয়া। সে শুধু আঞ্চলিক সামরিক প্রেক্ষাপটকেই অস্থির করছে না, বরং প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টাচার, আন্তর্জাতিক সমঝোতা এবং নিরাপত্তার মৌলিক নিয়মাবলিকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ফলত, উপসাগরীয় শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে—যেখানে ইরান আর একক হুমকি নয়, বরং ইসরায়েলকেও সমানভাবে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আরও বড় হুমকি হিসেবে দেখা শুরু হয়েছে।
টানা দুই মার্কিন প্রশাসন—ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন কেউই ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক নীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হননি কিংবা নিতে চাননি। ওয়াশিংটন বহু বছর ধরে আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার আশ্বাস দিয়ে এসেছে, কিন্তু দোহায় হামলার পর সেই আশ্বাসের বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উপসাগরীয় শাসকদের কাছে এখন পরিষ্কার হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা রাখে না, অথবা ইচ্ছুক নয়, এমনকি যখন বিষয়টি তাদের নিকটতম মিত্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
এই নতুন বাস্তবতা আরব দেশগুলোকে ভিন্ন পথ খুঁজতে বাধ্য করছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার পাশাপাশি তারা ক্রমেই চীন ও তুরস্কের মতো শক্তির দিকে ঝুঁকছে, যারা বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদার হতে পারে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা, বিশেষ করে আব্রাহাম চুক্তির আওতায় যেসব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা এখন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। গাজায় চলমান যুদ্ধ ও উপসাগরীয় মিত্রদের ভেতরে তীব্র অসন্তোষ সেই প্রক্রিয়াকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ফলে মার্কিন নীতি ও ভূমিকা নিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে যে আঞ্চলিক নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে ধরা হতো, দোহায় হামলার পর সেই ভাবমূর্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর কৌশলগত হিসাব এখন নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে—যেখানে আর একমাত্র ভরসা ওয়াশিংটন নয়, বরং বহুমুখী অংশীদারত্বই হয়ে উঠছে টিকে থাকার কৌশল।
দোহায় হামলা শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনা নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকাঠামোর পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যের নতুন সূচনা। দীর্ঘদিন ধরে যেখানে ইরানকে উপসাগরীয় নিরাপত্তার মূল হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেখানে এখন বাস্তবতাটি ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং কাতারে ইসরায়েলের ধারাবাহিক সামরিক পদক্ষেপ এবং অনিশ্চিত নীতি আরব শাসকদের কাছে এটিকে প্রধান অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলো কেবল প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের দিকে মনোনিবেশ করছে না; বরং তারা কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতার সীমাবদ্ধতা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তারা বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্ব, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং চীন ও তুরস্কের মতো শক্তিশালী বাহ্যিক মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে এখন প্রশ্ন আর শুধু এটুকুই নয় যে তারা প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না, বরং কী ধরনের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল গ্রহণ করবে, তা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
দোহায় হামলা মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ও নিরাপত্তার খেলা-ক্ষেত্রকে এক নতুন ধাক্কা দিয়েছে—যেমন ঝড়ের আগমনের আগে আকাশে স্থিরতা ভেঙে যায়, তেমনি দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা ধ্যানধারণার স্তরও এই ঘটনার সঙ্গে ভেঙে পড়েছে। এত দিন যেখানে ইরানকে মূল হুমকি বলে ধরা হতো, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলও সমানভাবে অপ্রত্যাশিত, অনিশ্চিত এবং অস্থিরতার প্রতীক। এই বিস্ফোরণ শুধু ভূরাজনৈতিক স্থিতি নয়, বরং উপসাগরীয় শাসকদের অন্তরেও একটি গভীর সচেতনতার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন, নিরাপত্তার জন্য একক নির্ভরতা—যা বহু বছর ধরে ওয়াশিংটনের ওপর তৈরি হয়েছিল—এখন আর যথেষ্ট নয়।
ফলে তাঁরা নিজেরা পথ তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন—নিজস্ব কৌশল, বহুপক্ষীয় অংশীদারত্ব এবং নতুন আন্তর্জাতিক সমীকরণের দিকে চোখ রেখেই। এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি, অংশীদারত্ব এবং স্থিতিশীলতার নিদর্শনকে নতুনভাবে আকার দিচ্ছে। আরব বিশ্বের এই আত্মনির্ভরতার সন্ধানে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতি ও শক্তির ভারসাম্য পুনঃস্থাপিত হবে, যা শুধু রাজনীতিক নয়, বরং ইতিহাসের পাঠেও একটি স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
যশোর-খুলনা অঞ্চলের দুঃখ বলা হয় ভবদহকে। কারণ, প্রায় চার দশক ধরে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এক অভিশপ্ত জলাবদ্ধতার শিকার। বছরের অধিকাংশ সময়ই তারা পানির মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। বিভিন্ন সরকারের আমলে জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কোনোটাই তাদের জীবনে স্বস্তি বয়ে আনেনি।
১২ ঘণ্টা আগেডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অশালীন ভাষার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকের বিস্ময়, অস্বস্তি ও অসন্তোষ দৃশ্যমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি, মিথ্যা বয়ান। এর বিপরীতে ফ্যাক্টচেকারদের ক্যারিয়ারেরও উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটছে।
১২ ঘণ্টা আগেগাজার বোমা আর ক্ষুধার ঘায়ে জর্জরিত ফিলিস্তিনিদের ক্ষতে ক্ষণিকের হলেও স্বস্তির পরশ দিচ্ছে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে স্বীকৃতির ‘ঘনঘটা’। ইতিহাসের পরিহাস, স্বীকৃতিদাতা কিছু দেশেরই অস্ত্রশস্ত্র, কূটনৈতিক সমর্থনে পুষ্ট হয়ে ফিলিস্তিনিদের পীড়ন করে এসেছে ক্ষমতাদর্পী ইসরায়েল। ইসরায়েল গাজার সাধারণ বাসিন্দাদ
১ দিন আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগের পরেই বড় দল হলো বিএনপি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন বিএনপিই বড় দল। এই দল স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জুলাই আন্দোলনের পটপরিবর্তনের পর জামায়াতে ইসলামী এখন বিএনপির বড় প্রতিপক্ষ। একসময় এ দুটি দল জোটবদ্ধ
১ দিন আগে