Ajker Patrika

ইউরোপ আর ইউক্রেন

মার্ক চ্যাম্পিয়ন
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ১৮
ইউরোপকে রক্ষা করার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র আর যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং ইউক্রেন।
ইউরোপকে রক্ষা করার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র আর যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং ইউক্রেন।

‘আচ্ছা, আমরা গেলাম, তোমরা ভালো থেকো’—ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত সপ্তাহের ইউক্রেন-সম্পর্কিত বক্তব্যকে এভাবেই সংক্ষেপে বলা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হঠাৎ ঘোষণা করলেন, ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে তার সব হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে পারে, তবে সেটা কেবল ইউরোপের সমর্থনে। এতে তেমন অবাক হওয়ার কিছু নেই। এর মানে হলো, ট্রাম্পকে বোঝানোর বা যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে ফেরানোর আশা এখন শেষ। তবে বাস্তবে এটি খুব বেশি কিছু পাল্টে দেবে—এমন নয়। বরং সঠিকভাবে বুঝতে পারলে বিষয়টি কিছুটা স্বচ্ছতাও আনতে পারে।

ট্রাম্পের বক্তব্য মূলত একধরনের আত্মরক্ষামূলক কৌশল। তিনি নিশ্চিত করতে চান, ভবিষ্যতে যা-ই ঘটুক না কেন, ইউক্রেন থেকে দূরে থাকার তাঁর এই সিদ্ধান্ত যেন কোনোভাবে তাঁর নিজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। তিনি বলেছেন, রাশিয়াকে হারানোর জন্য যদি ইউক্রেন ও ইউরোপ যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তাহলে তারা ব্যর্থ হলে দায় ট্রাম্পের ওপর বর্তাবে না।

অনেক আগে থেকেই ট্রাম্প ইউক্রেনকে দেওয়া সাহায্যের বড় অংশ বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সবচেয়ে বড় যুদ্ধে (১৯৪৫ সালের পর থেকে) কেবল অস্ত্র বিক্রেতা ও দর্শকে পরিণত হয়েছে। এটা খারাপ, তবে তাঁর সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত থাকার সময় অবস্থা আরও খারাপ ছিল, কারণ পুতিন তখন আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্টকে সহজেই নিজের মতো করে চালাচ্ছিলেন। রাশিয়া ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ও ন্যাটোকে দুর্বল করে বিপুল সুবিধা পেয়েছে, অথচ নিজে কোনো ছাড় দেয়নি।

কেন বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হলো এবং কার কারণে তা চলছে—ট্রাম্প প্রকাশ্যে পুতিনের এই বক্তব্য মেনে নিয়েছেন। কোনো আলোচনা ছাড়াই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেন কখনো ন্যাটোতে যোগ দেবে না। তিনি কিয়েভের অর্থ ও সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছেন, এমনকি কিছু সময়ের জন্য গোয়েন্দা তথ্যও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর সুযোগে পুতিন কুরস্ক থেকে ‘অন্ধ’ ইউক্রেনীয় সেনাদের তাড়িয়ে দেন, যা কিয়েভের জন্য ভীষণ মূল্যবান এক অবস্থান ছিল। উপরন্তু, ট্রাম্প আলাস্কায় পুতিনকে লালগালিচা দিয়ে অভ্যর্থনা জানান।

পুতিনের জন্য ঝুঁকিটা ছিল—এত ছাড় পাওয়ার পরও যদি তিনি ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করেন বা ন্যূনতম একটি চুক্তিতেও রাজি না হন, তবে তাঁর জন্য ভয়ানক শাস্তি আসতে পারে। কিন্তু সেই ভয়ও নিরর্থক হয়ে গেল। এখন স্পষ্ট যে কিছু কথার আক্রমণ বাদ দিলে এতসব করেও রাশিয়া কোনো শাস্তি পাবে না।

এমন নজিরবিহীন ছাড় পেয়ে পুতিন আরও সাহসী হয়ে উঠবেন। এর ইঙ্গিত মিলছে ন্যাটোর আকাশসীমায় ড্রোন অনুপ্রবেশের ঘটনায় (যদিও মস্কো এগুলো অস্বীকার করছে)। ট্রাম্প যদি সত্যিই মিত্রদের সতর্ক করতেন যে যুক্তরাষ্ট্র সব রকম পরিস্থিতিতে তাদের পাশে দাঁড়াবে, তাহলে হয়তো এর প্রতিরোধে কাজ দিত। কিন্তু তিনি তা করেননি।

তবু ট্রাম্পের জাতিসংঘে দেওয়া বক্তব্যে কিয়েভের জন্য কিছুটা সান্ত্বনা আছে: তাঁর পুতিনকে তুষ্ট করার নীতি, যা ইউরোপ ও ইউক্রেনের জন্য বিপর্যয় হয়ে এসেছিল, এখন শেষ হয়েছে। এখন এই দুই পক্ষ নিশ্চিত হতে পারে যে বিশ্বাসঘাতকতা আপাতত থেমেছে এবং তারা নিজেদের কৌশল কেবল নিজেদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে সাজাতে পারবে। আরেকটি ক্ষীণ আশা আছে—ইউরোপীয় নেতারা, কিংবা কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা বা উভয়ে মিলে চাপ দিলে হয়তো ট্রাম্প পুতিনকে শাস্তি দেবেন। তবে এর ওপর ভরসা করা উচিত নয়।

কিছু শিক্ষা অবশ্য এইসব ঘটনা থেকে পাওয়া যায়। প্রথমত, ইউরোপকে এখন যেকোনো মূল্যে রাশিয়ার জমাটবদ্ধ সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। নাহলে ট্রাম্পের সরে যাওয়ায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক শূন্যতা পূরণ করা রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব হয়ে পড়বে। জার্মানিও সম্প্রতি এই পদক্ষেপের নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ট্রাম্পের সরে যাওয়া প্রমাণ করেছে—ইউরোপকে রক্ষা করার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র আর যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং ইউক্রেন। এখন ইউক্রেনের হাতে ৭ লাখের বেশি সেনা, ইউরোপের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী এবং বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ড্রোনশিল্প আছে, যা রাশিয়ার পাল্টা-কৌশলের সঙ্গে রিয়েল-টাইমে মানিয়ে নিতে পারে। যুদ্ধের ধরন আমূল বদলে দিয়েছে এই সক্ষমতা।

এ ছাড়া ইউক্রেনের এমন অস্ত্রশিল্প আছে, যা ইউরোপের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। এবং তারা লড়াই করতে প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি কেবল ইউরোপের অনেক দেশের মতো নয়, যাদের বিশ্বাস ছিল বিরোধ মীমাংসা হয় কেবল আইনের মাধ্যমে, অস্ত্রের জোরে নয়। ন্যাটো যে রাশিয়ার ড্রোন আক্রমণ কার্যকরভাবে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে—পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও ডেনমার্কের আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ থামাতে না পারা—তার স্পষ্ট প্রমাণ।

আমি নিশ্চিত নই, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউক্রেন জয়ী হতে পারবে কি না। পুরো হারানো ভূখণ্ড ফেরত পাওয়া তো আরও অনিশ্চিত। কিন্তু পরিস্থিতি একেবারে নিরাশাজনক নয়।

সামরিক একীকরণের মানে ইউরোপীয় সেনাদের সরাসরি ফ্রন্টলাইনে পাঠানো নয়। ইউক্রেন ও ইউরোপের এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য ও বিশেষ প্রযুক্তি প্রয়োজন হবে, সঙ্গে আমেরিকার পারমাণবিক ছাতারও। অর্থাৎ, পুরোপুরি বিচ্ছেদ সম্ভব নয়; ট্রাম্পকে খুশি রাখার কূটনৈতিক প্রয়োজন এখনো রয়ে গেছে।

যা বদলাতে হবে, তা হলো ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি: ইউক্রেন শুধু সাহায্যপ্রার্থী নয়, সে আসলে প্রতিরক্ষাসেবা সরবরাহকারীও। ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে—বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি ও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি পাওয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে, যা কিয়েভের প্রস্তুতকারকদের দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করছে। না হলে ফ্রান্স বা জার্মানির তৈরি ড্রোন উৎপাদনের সময়ই অচল হয়ে পড়বে।

আমরা ইতিমধ্যেই এ প্রক্রিয়ার সূচনা দেখছি: যুক্তরাজ্য, ডেনমার্কসহ কিছু দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে যৌথভাবে ড্রোনশিল্পে কাজ করছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর, গভীরতর এবং জনসমক্ষে আরও গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।

লেখক: ব্লুমবার্গ পত্রিকার কলামিস্ট

(যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ পত্রিকায় প্রকাশিত)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুর্গাপূজায় অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে বিএনপি নেতার বিতর্কিত মন্তব্য

হাজি সেলিমের আজিমপুরের বাড়িতে যৌথ বাহিনীর অভিযান, ৬টি বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার

গ্যালারিতে বসে দেখার দিন শেষ, আমরা এখন নিজে খেলব: প্রধান উপদেষ্টা

ভারত-পাকিস্তান ‘হাইভোল্টেজ’ ফাইনাল নিয়ে সুপার কম্পিউটার কী বলে

ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই কিস্তিতে মোবাইল ফোন কেনার সুযোগ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত