Ajker Patrika

ইপিআই কার্যক্রম: শিশুদের টিকার সংকট

  • দেশজুড়ে বিভিন্ন মাত্রায় টিকার অভাব রয়েছে
  • কৌশলগত পরিকল্পনা না থাকায় সংগ্রহে জটিলতা
  • শিগগির সমাধানের আশ্বাস স্বাস্থ্যবিষয়ক সহকারীর
  • সরাসরি গ্যাভি থেকে টিকা কেনার পরিকল্পনা
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৬
ইপিআই কার্যক্রম: শিশুদের টিকার সংকট

গত সপ্তাহের শুরুতে ৯ মাস বয়সী মেয়েশিশুকে রাজধানীর রমনা এলাকায় ইপিআইয়ের এক স্থায়ী টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যান বেসরকারি চাকরিজীবী বাবা। উদ্দেশ্য, হাম-রুবেলার (এমআর) প্রথম ডোজ দেওয়া। তবে সেদিন কেন্দ্রটিতে টিকা না থাকায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়। এমআরসহ আরও কয়েক ধরনের টিকার ঘাটতির কারণে সেদিন শিশুসন্তানদের টিকা দেওয়া ছাড়াই ফিরতে বাধ্য হন অনেক অভিভাবক।

শুধু ঢাকার রমনার কেন্দ্রটি নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুদের নিয়মিত টিকাগুলোর ক্ষেত্রে একই সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) আওতায় দেওয়া এসব টিকার সংকট চলছে কয়েক মাস ধরে। কোথাও সংকট তীব্র, কোথাওবা তুলনামূলক কম। সংশ্লিষ্টদের মতে, টিকা কেনা এবং তারপর সরবরাহ ব্যবস্থার জটিলতায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবে না। তথ্য অনুযায়ী দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।

টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য কিছু রোগ নির্মূলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। ইপিআই কর্মসূচিতে বর্তমানে ১১টি রোগ প্রতিরোধে ৮টি টিকা দেওয়া হয়। নবজাতক থেকে ১১ মাস বয়সী শিশু, ২৩ মাস বয়সী শিশু, ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম নারীদের এসব টিকা দেওয়া হয়। যক্ষ্মা, পোলিও, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, হাম ও রুবেলা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ও হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি) এসব রোগের টিকাদান সারা বছর চলে।

ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে পিসিভি (নিউমোনিয়া) ও পেন্টাভ্যালেন্ট (ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি) টিকার সংকট রয়েছে। তবে তিন মাস আগের তুলনায় অভাব কিছুটা কম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সংকট পিসিভি টিকার। এ ঘাটতি সাত মাস ধরে চলছে। মাসখানেক আগে পৌঁছানো সর্বশেষ চালানটি সাত দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশজুড়ে সব জায়গাতেই দু-তিন ধরনের টিকার অভাব রয়েছে।১৯৭৯ সালে দেশের শহরগুলোতে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) চালু হয়। ১৯৮৫ সালে তা সারা দেশে বিস্তৃত হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এ কর্মসূচি চালুর আগে প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ১৫১ জন।

২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। বাংলাদেশের ইপিআই কর্মসূচি জনস্বাস্থ্যে বড় সাফল্য হিসেবে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। এর মাধ্যমে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে, শিশু মৃত্যুহার কমেছে এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এ টিকা কর্মসূচি পোলিও এবং মাতৃ ও নবজাতক ধনুষ্টঙ্কার (এমএনটি) নির্মূল করা এবং হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। পাশাপাশি কিশোরী মেয়েদের মধ্যে ৯৩ শতাংশকে এইচপিভি টিকা দেওয়া যাচ্ছে, যা জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন গত আগস্টের শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিল, সেপ্টেম্বরে টিকা কেনায় দেরি হলে অক্টোবরের মধ্যেই মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটি সম্প্রতি ইপিআই কর্মসূচির জন্য টিকা কেনায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ইউনিসেফের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ‘গ্যাভি’ থেকে টিকা সংগ্রহ করা হবে। প্রসঙ্গত, ‘গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স’ হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য সুলভে টিকা সহজলভ্য করতে গঠিত এক বৈশ্বিক উদ্যোগ।

যেসব জেলায় টিকার সংকট বেশি রয়েছে, কুমিল্লা তার অন্যতম। কুমিল্লার ডেপুটি সিভিল সার্জন রেজা মো. সারোয়ার আকবর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টিকার সংকট গত অর্থবছরে বেশি ছিল, তবে সংকট কমেছে। আমরা নিয়মিত টিকা পাচ্ছি এবং শেষ হওয়ার আগেই আবার চাহিদা পাঠিয়েছি। সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়, কোন টিকার সংকট আছে। কারণ, একেক সময় একেক ধরনের টিকার অভাব হয়। ফলে কোনো একটির সংকটই স্থায়ী নয়। বর্তমানে পেন্টাভ্যালেন্ট ও পিসিভির সংকট রয়েছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে রুটিন ইপিআইয়ের টিকার সংকট রয়েছে। আগে স্বাস্থ্য খাতের পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে টিকা কেনা হতো, যা সহজ ছিল। নতুন ওপি না হওয়ায় বর্তমানে রাজস্ব খাত থেকে কেনা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল। সচিব ও মন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত অর্থের ক্রয়াদেশ দিতে পারেন। এর বেশি হলে তা সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হয়।’

দুজন সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, জেলার সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়) একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন। তাতে টিকার সংকটের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ইপিআই সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সরকার টিকা কেনার জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে আট শ কোটি টাকা দিয়ে ইপিআইয়ের নিয়মিত টিকা এবং বাকি অর্থ দিয়ে হাজিদের টিকা, জলাতঙ্কের টিকা ইত্যাদি কেনা হবে।

ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কোল্ডস্টোরেজ থেকে টিকা জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে পাঠানো হয় এবং সেখানে সংরক্ষণ করে উপজেলা পর্যায়ে বিতরণ করা হয়। গত মঙ্গলবার থেকে জেলা চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাঠানো শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০টির বেশি জেলায় টিকা বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ নুর আলম দীন জানিয়েছেন, জেলায় শিশুদের টিকার চলমান সংকট তিন দিন আগে শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদেরও সংকট ছিল। তবে তিন-চার দিন আগে চাহিদা অনুযায়ী সব টিকা সরবরাহ পেয়েছি। যে টিকা এসেছে, তাতে দেড় মাস নির্বিঘ্নে চলবে।’

সিলেটের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, বিভাগের চার জেলায় মজুত টিকায় আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ইপিআই) মো. শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, নিয়মিত অপারেশনাল প্ল্যান থেকে কার্যক্রম রাজস্ব খাতে চলে আসার কারণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এগুলো স্থায়ী নয়। দেশের কোথাও কোথাও টিকার সংকট রয়েছে। কিন্তু এ সংকট সাধারণ কার্যক্রমে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করেনি। কোনো এলাকায় সংকট দেখামাত্রই সেখানে টিকা পাঠানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানও স্বাস্থ্য কার্যক্রম ওপি থেকে রাজস্ব খাতে আনার কারণে সাময়িক সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, শিগগির এর সমাধান হবে। বিশেষ সহকারী জানান, গত অর্থবছরে টিকার জন্য সাড়ে চার শ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। চলতি অর্থবছরে তা ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। টিকা কেনার জন্য অর্থের অনুমোদন হয়েছে। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে টিকা হাতে আসবে।

ডা. মো. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, ‘টিকা এখন হাতে নেই, এমনটি নয়। কিছু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে কয়েকটি কেন্দ্রে টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। ১০-১২টি উপজেলায় এবং ৪টি জেলায় সাময়িক ঘাটতি হয়েছে, যা ইতিমধ্যে সমাধান করা হয়েছে। আমাদের হাতে থাকা মজুত দিয়ে কার্যক্রম চলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত