Ajker Patrika

মোহাম্মদপুরে নিহত ২: গণপিটুনি নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

  • ভোরের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে বলা হয় গণপিটুনি
  • গরুর খামার ও হোটেল থেকে ডেকে দুই তরুণকে পিটিয়ে হত্যা
  • পুলিশই গণপিটুনি বলতে শিখিয়ে দেয় হামলাকারীদের
আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
মো. সুজন ও মো. হানিফ।
মো. সুজন ও মো. হানিফ।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ভোররাতে একজনকে, ভোর হতেই আরও একজনকে একই কায়দায় রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর রটানো হয়, ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশও একই সুরে গণপিটুনির তথ্য ছড়িয়ে দেয় গণমাধ্যমে। আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ছিনতাইয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ তোলেনি। দুই তরুণকে পূর্বপরিকল্পনা করে তাঁদের বাসার কাছে একই জায়গায় ২ ঘণ্টার ব্যবধানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যাঁরা পিটিয়েছেন এবং যাঁরা নিহত হয়েছেন সবাই পূর্বপরিচিত, একই এলাকার বাসিন্দা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ১২৪ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খুঁজলে দেখা যাবে প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনাই পরিকল্পিত। ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন মতবিরোধকে ঘিরে গণপিটুনির নামে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। শুরুতে যদি জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হতো, তাহলে এ রকম ঘটনা বারবার ঘটত না।’

গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোররাত ও সকালে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ১৬ নম্বর সড়কের মাথায় সাঁকোরপাড় এলাকায় দুই দফায় চার তরুণকে পেটানো হয়। ভোররাত সাড়ে ৪টায় মারধরের শিকার হন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. শরীফ।

পরে সকাল সাড়ে ৬টায় একই স্থানে আবারও মারধর করা হয় মো. হানিফ ও মো. ফয়সালকে। এতে সুজন ও হানিফ নিহত হন। গুরুতর আহত শরীফ ও ফয়সালকে ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

নিহত সুজনের গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বি-ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসায় বাবা টাইলস মিস্ত্রি জাহাঙ্গীর আলম, মা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে থাকতেন। মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে টাইলসের কাজও করতেন তিনি।

সুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে চাচাতো বোনের বাসায় খাওয়ার পর বন্ধু শরীফের সঙ্গে স্থানীয় সাদিক অ্যাগ্রোর গরুর খামারে যান। খামারকর্মী মনিরুলের কক্ষে তাঁরা ঘুমান। ভোররাত ৪টার পর নৈশপ্রহরী মালেক, হাবীবসহ ৭-৮ জন তাঁদের খামার থেকে তুলে নবীনগরের ১৪ নম্বর সড়কের মাথায় সাঁকোরপাড় এলাকায় নিয়ে যান।

এই প্রতিবেদক ২৩ সেপ্টেম্বর ওই গরুর খামারে গেলে কর্মচারী মো. মিলন বলেন, খামারে থাকতে দেওয়ার কারণে মনিরুলকেও মারধর করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সোনিয়া আক্তার সুমি জানান, নবীনগর ১৬ নম্বর সড়কে তাঁর বাসা। তিনি চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখেন, কয়েকজন লোক সুজন ও শরীফকে ১৪ নম্বর সড়কের মাথায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে নৈশপ্রহরী হাবীব, মালেক, শাহাবুদ্দিন, আক্তার, নুরু, হাসনাইন, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন মিলে তাঁদের মারধর করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি সুজন ও শরীফকে মারধরের তিনটি ভিডিও আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। স্থানীয়দের নিয়ে ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হামলাকারীদের মধ্যে রয়েছেন বাঁশ ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন, নৈশপ্রহরী হাবীবুর রহমান হাবীব ও মালেক, মুরগি ব্যবসায়ী আল আমিন ও তাঁর কর্মচারী শাহীন, মকবুল, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ, কবির, নূরু মিয়া, শামসু ও তাঁর ছেলে শাহাবুদ্দিন।

সেদিন খবর পেয়ে ভোররাতে মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান প্রথম ঘটনাস্থলে যান। তিনিই হামলাকারীদের গণপিটুনির কথা শিখিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেছেন আহত শরীফের ভাই। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ভোররাতে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে থাকা কেউ মারধরের কথা স্বীকার করেননি। পরে তিনি দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুজনকে একই জায়গায় মারধর করা হয়। তাঁরা দুজনে একটি হোটেলে নাশতা করতে যাচ্ছিলেন—এ সময় একই লোকজন আকবরের চায়ের দোকানের সামনে তাঁদের আটকায়। ভিডিওতে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে।

কবির, নৈশপ্রহরী মালেক ও হাবীব মিলে হানিফকে পিটিয়ে ফুটপাতে অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখেন। এ ঘটনার সময় পোশাকশ্রমিকেরা কারখানায় যাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন শিউলী বেগম। তিনি বলেন, সেদিন তাঁরা কারখানায় যাওয়ার সময় দেখেন, দুই ব্যক্তিকে ৮-৯ জনে মিলে মারধর করছেন। ঠেকানোর চেষ্টা করেন ফয়সালের ভাই মো. রবিউল ও তাঁর স্ত্রী সোনিয়া আক্তার সুমি। সোনিয়া ঘটনার সময়ের একটি ভিডিওতে নিজেকে দেখিয়ে বলেন, পিটুনি ঠেকাতে গেলে তাঁর স্বামী রবিউলকেও মারধর করে আল আমিন, মালেক, নূরু, হাবীব, শাহাবুদ্দিন, শাহ আলম।

নিহত হানিফ নবীনগর হাউজিংয়ের ১৪ নম্বর সড়কের শেষ মাথার একটি বাসায় মা-বাবা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। তিনি একটি পাম্পের কর্মচারী ছিলেন। তাঁকে হত্যার ১৭ দিন আগে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে তাঁর স্ত্রী ঝুমু প্রথম কন্যাসন্তানের মা হন। হানিফ সেই সন্তানকেও দেখে যেতে পারেননি বলে স্ত্রী আফসোস করেন।

হানিফের বাবা সাদেক হাওলাদার বলেন, প্রথম ঘটনার পর পুলিশ যদি হামলাকারীদের ধরত, জেরা করত, তাহলে দ্বিতীয় ঘটনা ঘটত না। তিনি বলেন, হানিফকে হত্যায় অভিযুক্ত আক্তার তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। সরকার পরিবর্তনের পর সে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেছে, হাউজিংয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেয়েছে। চার-পাঁচ দিন আগে থেকে পরিকল্পনা করে তারা দুজনকে পিটিয়ে মারছে।

নিহত ব্যক্তিদের পরিবার অভিযোগ করেছে, চারজনকে পিটুনির নেতৃত্বে ছিলেন আক্তার হোসেন। যাঁরা হামলায় অংশ নিয়েছেন, তাঁরা সবাই আক্তারের লোক হিসেবেই পরিচিত। মূল অভিযুক্ত আক্তার হোসেনকে নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কের বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ঘটনার দিন ভোরে নৈশপ্রহরীরা ফোন দিয়ে তাঁর স্বামীকে (আক্তার) বাসা থেকে ডেকে নেন। এরপর থেকে তিনি আর বাসায় নেই।

নিহত হানিফের বড় ভাই আক্তার হোসেন বলেন, যারা মেরেছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে পুলিশ মামলা নেয়নি। ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ তাঁর স্বাক্ষর নিয়েছে।

মোহাম্মদপুর থানার ভরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রফিক বলেন, গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য ছিল। নিহত একজনের ভাই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, নিহত দুজনের বিরুদ্ধে চারটি করে মাদক ও ছিনতাইয়ের মামলা ছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত