বিশ্ব শিক্ষক দিবস
ড. এম এ সবুর
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে প্যারিসে আন্তসরকার সম্মেলনে ইউনেসকো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে শিক্ষকের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণীত হয়। এতে শিক্ষক নিয়োগ, দায়িত্ব, পদোন্নতি, অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান-শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্যারিস সম্মেলনের এ দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। এ দিবসটিতে জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের প্রত্যাশা করা হয়। এ দিবসে শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা এবং তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’। এতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
জাতি গঠন ও জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান অসামান্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের সব দেশে-সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সর্বাধিক এবং তাঁরাই সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকের অবস্থা তার উল্টো। এ দেশের শিক্ষকেরা সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। আর্থিক দৈন্য ও সামাজিক বঞ্চনা বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের নিত্যসঙ্গী। তবে তাঁদের বঞ্চনা-দুঃখ-যাতনা বেশির ভাগই অব্যক্ত থাকে।
একই সিলেবাস ও প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য ক্যাডারের চেয়ে নিচে ধরা হয়! অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা পদবিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদেরও মেনে চলতে হয়! স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের স্নাতক পাস মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হয়! শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষাপ্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে শিক্ষকের চেয়ে অশিক্ষকের প্রাধান্য ও গুরুত্ব বেশি দেখা যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষকের বেতনকাঠামো এসএসসি/অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মচারীদের মতো বিবেচনা করা হয়। এখনো অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন বা ঝাড়ুদাড়ের ব্যবস্থা না থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ শিক্ষকদেরই করতে হয়! পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রাপ্তিতে অনেক শিক্ষককে পেশাগত হতাশায় ভুগতে হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতার ন্যায্য অধিকারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একই পাঠ্যক্রমে ও একই নিয়মে পাঠদান সত্ত্বেও সমযোগ্যতাসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের ব্যাপক বৈষম্য বঞ্চনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বেসরকারি শিক্ষকদের এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি ও উচ্চতর গবেষণা পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিবেচনা না করায় বৈষম্যের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষকের বেতনকাঠামো ও পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা-বঞ্চনা শিক্ষক সমাজে হতাশা বাড়ায়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর শিক্ষকদের নির্ভর করতে হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের সুবিধা এবং স্বেচ্ছাচারিতায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তাই চাকরি রক্ষার্থে অনেক সময় আত্মমর্যাদা ভুলে শিক্ষককে তোষামুদে হতে হয়!
নন-এমপিও (সরকারি অনুদানবহির্ভূত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জীবনযাপন করেন সবচেয়ে করুণ অবস্থায়। পাঠদানের অনুমোদিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি-সংস্থার দানে প্রতিষ্ঠিত মক্তব, কওমি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার অধিকার অসচেতন শিক্ষকদের করুণ অবস্থা অবর্ণনীয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে ন্যায্য অধিকার, বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকদের নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়!
অস্বীকার করার উপায় নেই, কিছুসংখ্যক অসৎ-অযোগ্য লোকও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে পেশাবহির্ভূত বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিছুসংখ্যক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার্থী ধর্ষণসহ অনেক অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ আছে। সংখ্যায় বেশি না হলেও তাঁরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় অন্যায়-অপকর্ম ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে শিক্ষক সমাজের ভাব-মর্যাদা নষ্ট করছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসা করে অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে আছে। তবে অর্থনৈতিক দৈন্য ঘোচাতে কোনো কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষায় নিজ প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ভালো করতেও কিছু শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন।
শিক্ষকেরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাই সমাজের সর্বস্তরের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ প্রভাবে কিছু শিক্ষক প্রভাবিত হয়ে থাকেন। তবে এসব অসৎ-অনৈতিক শিক্ষক ও তাঁদের পেশাবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আমাদের শিক্ষক সমাজের চরম অপছন্দ। তাঁদের অনৈতিক কাজের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের একান্ত চাওয়া।
শিক্ষার উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন। আর শিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত শিক্ষকের উন্নয়ন। শিক্ষকের উন্নয়ন বলতে বোঝায় তাঁদের যোগ্যতা-দক্ষতা, জ্ঞান-সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন। তাই শিক্ষকের চাকরির নিরাপত্তা, তাঁদের যথাযথ অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সব বঞ্চনা-বৈষম্য দূরীকরণ করা দরকার। এ সবকিছুর জন্য দরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষাবিষয়ক সংগঠন ‘এডুকেশন ফর অল’ (ইএফএ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি দেশের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে নিজ দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। অথচ আমাদের দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১.৫৩ শতাংশ বা মোট বাজেটের ১২.১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বরাদ্দের বেশির ভাগ ব্যয় হবে শিক্ষকের বেতন, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, বৃত্তি-উপবৃত্তি ইত্যাদি খাতে। অধিকন্তু শিক্ষা খাতের এ বরাদ্দের মধ্যে আবার ধর্মীয় খাতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন ভাগ-বণ্টনে শিক্ষকদের ভাগে খুব কম অংশই জোটে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সর্বস্তরের সব শিক্ষকের বঞ্চনা-বৈষম্য দূর করে তাঁদের যথাযথ অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক: শিক্ষক ও আহ্বায়ক, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবরে প্যারিসে আন্তসরকার সম্মেলনে ইউনেসকো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে শিক্ষকের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণীত হয়। এতে শিক্ষক নিয়োগ, দায়িত্ব, পদোন্নতি, অধিকার, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান-শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্যারিস সম্মেলনের এ দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। এ দিবসটিতে জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের প্রত্যাশা করা হয়। এ দিবসে শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি মানসম্মত শিক্ষা এবং তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়। এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’। এতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
জাতি গঠন ও জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান অসামান্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের সব দেশে-সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সর্বাধিক এবং তাঁরাই সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকের অবস্থা তার উল্টো। এ দেশের শিক্ষকেরা সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। আর্থিক দৈন্য ও সামাজিক বঞ্চনা বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের নিত্যসঙ্গী। তবে তাঁদের বঞ্চনা-দুঃখ-যাতনা বেশির ভাগই অব্যক্ত থাকে।
একই সিলেবাস ও প্রশ্নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য ক্যাডারের চেয়ে নিচে ধরা হয়! অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা পদবিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদেরও মেনে চলতে হয়! স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের স্নাতক পাস মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হয়! শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষাপ্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে শিক্ষকের চেয়ে অশিক্ষকের প্রাধান্য ও গুরুত্ব বেশি দেখা যায়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস শিক্ষকের বেতনকাঠামো এসএসসি/অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মচারীদের মতো বিবেচনা করা হয়। এখনো অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন বা ঝাড়ুদাড়ের ব্যবস্থা না থাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজ শিক্ষকদেরই করতে হয়! পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রাপ্তিতে অনেক শিক্ষককে পেশাগত হতাশায় ভুগতে হয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতার ন্যায্য অধিকারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একই পাঠ্যক্রমে ও একই নিয়মে পাঠদান সত্ত্বেও সমযোগ্যতাসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের ব্যাপক বৈষম্য বঞ্চনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বেসরকারি শিক্ষকদের এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি ও উচ্চতর গবেষণা পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিবেচনা না করায় বৈষম্যের মাত্রা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাশিক্ষকের বেতনকাঠামো ও পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা-বঞ্চনা শিক্ষক সমাজে হতাশা বাড়ায়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল-মাদ্রাসা-কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর শিক্ষকদের নির্ভর করতে হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের সুবিধা এবং স্বেচ্ছাচারিতায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তাই চাকরি রক্ষার্থে অনেক সময় আত্মমর্যাদা ভুলে শিক্ষককে তোষামুদে হতে হয়!
নন-এমপিও (সরকারি অনুদানবহির্ভূত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জীবনযাপন করেন সবচেয়ে করুণ অবস্থায়। পাঠদানের অনুমোদিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি-সংস্থার দানে প্রতিষ্ঠিত মক্তব, কওমি ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার অধিকার অসচেতন শিক্ষকদের করুণ অবস্থা অবর্ণনীয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে ন্যায্য অধিকার, বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকদের নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়!
অস্বীকার করার উপায় নেই, কিছুসংখ্যক অসৎ-অযোগ্য লোকও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে পেশাবহির্ভূত বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিছুসংখ্যক শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার্থী ধর্ষণসহ অনেক অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ আছে। সংখ্যায় বেশি না হলেও তাঁরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় অন্যায়-অপকর্ম ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে শিক্ষক সমাজের ভাব-মর্যাদা নষ্ট করছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসা করে অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে আছে। তবে অর্থনৈতিক দৈন্য ঘোচাতে কোনো কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষায় নিজ প্রতিষ্ঠানের ফলাফল ভালো করতেও কিছু শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন।
শিক্ষকেরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাই সমাজের সর্বস্তরের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ প্রভাবে কিছু শিক্ষক প্রভাবিত হয়ে থাকেন। তবে এসব অসৎ-অনৈতিক শিক্ষক ও তাঁদের পেশাবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আমাদের শিক্ষক সমাজের চরম অপছন্দ। তাঁদের অনৈতিক কাজের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের একান্ত চাওয়া।
শিক্ষার উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন। আর শিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত শিক্ষকের উন্নয়ন। শিক্ষকের উন্নয়ন বলতে বোঝায় তাঁদের যোগ্যতা-দক্ষতা, জ্ঞান-সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন। তাই শিক্ষকের চাকরির নিরাপত্তা, তাঁদের যথাযথ অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সব বঞ্চনা-বৈষম্য দূরীকরণ করা দরকার। এ সবকিছুর জন্য দরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষাবিষয়ক সংগঠন ‘এডুকেশন ফর অল’ (ইএফএ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি দেশের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে নিজ দেশের জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। অথচ আমাদের দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১.৫৩ শতাংশ বা মোট বাজেটের ১২.১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বরাদ্দের বেশির ভাগ ব্যয় হবে শিক্ষকের বেতন, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, বৃত্তি-উপবৃত্তি ইত্যাদি খাতে। অধিকন্তু শিক্ষা খাতের এ বরাদ্দের মধ্যে আবার ধর্মীয় খাতও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন ভাগ-বণ্টনে শিক্ষকদের ভাগে খুব কম অংশই জোটে। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সর্বস্তরের সব শিক্ষকের বঞ্চনা-বৈষম্য দূর করে তাঁদের যথাযথ অধিকার-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক: শিক্ষক ও আহ্বায়ক, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন, অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স
ড. এ এস এম আলী আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টার সফর এবং আগামী জাতীয়...
৩ ঘণ্টা আগেদেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিনা মূল্যে বরাদ্দের ওষুধ গুদামে মজুত আছে। অথচ রোগী এলে বলা হয়, ওষুধের সাপ্লাই নেই। দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৬৪টি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে এই অভিযোগসহ গুরুতর সাতটি অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন...
৩ ঘণ্টা আগেআগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কি সন্দেহ-সংশয় আছে? আপাতদৃষ্টিতে নেই। নির্বাচন ওই সময়েই হবে— সাধারণভাবে এমনটাই ধারণা করা যায়। সরকারের ঘোষণা ও নানা সময়ের বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি—এসবই এই ধারণার ভিত্তি।
১ দিন আগেবাংলাদেশে স্মার্টফোন চুরি এখন আর নতুন ঘটনা নয়। স্মার্টফোনের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই এই অপরাধ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মাত্রা ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। প্রযুক্তি যতই উন্নত হচ্ছে, নতুন নিরাপত্তা ফিচার যোগ হচ্ছে, আর চোরদের কৌশলও ততই আধুনিক হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে