Ajker Patrika

ইসলামে খেলাধুলা: উদ্দেশ্য ও সীমারেখা

কাউসার লাবীব
ইসলামে খেলাধুলা: উদ্দেশ্য ও সীমারেখা

ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গের দিকনির্দেশনা দেয়, যেখানে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রতিও সমান গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। খেলাধুলাকে ইসলাম কেবল চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং শরীরচর্চা, সুস্থ মন ও সামরিক প্রস্তুতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে। ইসলাম খেলাধুলার অনুমতি দিয়েছে, তবে তা শর্তসাপেক্ষে। কারণ, এর মূল উদ্দেশ্য হলো জীবনের মহৎ লক্ষ্য অর্জন করা।

ইসলামে খেলাধুলার উদ্দেশ্য ও উপকারিতা

খেলাধুলা মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:

  • শারীরিক সুস্থতা অর্জন: একজন মুমিনের সুস্থ দেহ থাকা উচিত। কারণ দুর্বল দেহের চেয়ে সুস্থ দেহ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। খেলাধুলা শরীরকে শক্তিশালী করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

  • রণ-নৈপুণ্যের প্রশিক্ষণ: ইসলামের প্রাথমিক যুগে তির নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড় ও বর্শা চালনার মতো খেলাগুলো ছিল যুদ্ধের জন্য একধরনের প্রশিক্ষণ। এর মাধ্যমে মুমিনেরা নিজেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের (শত্রুদের) মোকাবিলার জন্য সাধ্যমতো শক্তি ও অশ্ব প্রস্তুত করো।’ (সুরা আনফাল: ৬০)
  • প্রফুল্লতা ও সজীবতা: খেলাধুলা মানুষের মনকে আনন্দ ও প্রফুল্ল করে তোলে। এতে কর্মশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মাঝে মাঝে হৃদয়কে বিশ্রাম ও আরাম দাও।’ (আবু দাউদ)

সাহাবিদের আমলে প্রচলিত কিছু খেলাধুলা

ইসলাম সেসব খেলাকে সমর্থন করে, যাতে কোনো দ্বীনি বা দুনিয়াবি বৈধ উপকারিতা রয়েছে। এই নীতির আলোকে রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের আমলে প্রচলিত কিছু খেলা নিচে তুলে ধরা হলো:

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা: রাসুল (সা.) স্বয়ং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছেন। (সহিহ বুখারি: ২৮৭০)।

  • তির নিক্ষেপ: তির নিক্ষেপকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ একটি তিরের অসিলায় তিনজন লোককে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন—তির নির্মাতা, তির নিক্ষেপকারী এবং তা নিক্ষেপে সাহায্যকারী। তিনি আরও বলেন, তোমরা তিরন্দাজি করো ও ঘোড়দৌড় শেখো। তবে তোমাদের ঘোড়দৌড় শেখার তুলনায় তিরন্দাজি শেখা আমার কাছে বেশি পছন্দের।’ (জামে তিরমিজি: ১৬৩৭)
  • মল্লযুদ্ধ: মল্লযুদ্ধ তৎকালীন আরবের একটি প্রচলিত খেলা ছিল। দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে রাসুল (সা.) নিজেও একবার মক্কার বিখ্যাত মল্লযোদ্ধা রুকানা বিন ইয়াজিদকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম)
  • সাঁতার ও অন্যান্য খেলা: রাসুল (সা.) সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি এমন জিনিস, যাতে আল্লাহর স্মরণ নেই, তা অর্থহীন, তবে চারটি বিষয় ছাড়া। তা হলো, হাতের নিশানা ঠিক করার উদ্দেশ্যে তির খেলা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, স্ত্রীর সঙ্গে হাসি-কৌতুক করা, সাঁতার শেখা।’ (সুনানে কুবরা লিন-নাসায়ি: ৮৯৪০)। এ ছাড়া ভারোত্তোলন এবং দ্রুত হাঁটার প্রতিযোগিতা তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ছিল, যা শারীরিক শক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করত।

ইসলামে খেলাধুলার সীমারেখা ও মূলনীতি

ইসলামে খেলাধুলা বৈধ হলেও কিছু সুস্পষ্ট সীমারেখা মেনে চলতে হয়। এই মূলনীতিগুলো লঙ্ঘিত হলে খেলাধুলা আর বৈধ থাকে না, বরং তা আপত্তিকর হয়ে ওঠে:

আল্লাহর ইবাদত থেকে উদাসীন না হওয়া: খেলাধুলা কোনোভাবেই যেন মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালন থেকে বিরত না রাখে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একশ্রেণির মানুষ এমন আছে, যারা খেলাধুলা-কৌতুকাবহ কথা ক্রয় করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান: ৬)।

  • জুয়া ও বাজিমুক্ত হওয়া: যেসব খেলায় জুয়া বা বাজি ধরা হয়, তা সম্পূর্ণ হারাম। জুয়াকে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তিরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা মায়িদা: ৯০)
  • পর্দার বিধান লঙ্ঘন না করা: খেলাধুলার সময় অবশ্যই পর্দা ও শালীনতা বজায় রাখতে হবে। পুরুষদের জন্য নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং নারীদের জন্য পুরো শরীর ঢেকে রাখা ফরজ। যেসব খেলায় এই বিধান লঙ্ঘন হয়—যেমন অনেক সময় সাঁতার বা ফুটবলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেগুলো ইসলামে জায়েজ নয়।
  • জীবনের লক্ষ্য না বানানো: খেলাধুলা জীবনের লক্ষ্য বা পেশা হতে পারে না। একজন মুমিনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত: ৫৬)। খেলাধুলায় আসক্ত হয়ে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আধুনিক খেলা ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত অনেক খেলায় উপরিউক্ত শর্তগুলোর প্রায় সব কটিই লঙ্ঘিত হয়। আধুনিক খেলাধুলা, যেমন ক্রিকেট ও ফুটবলে—জুয়া, বেপর্দা, গানবাজনা এবং নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করতে গিয়ে বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪০৩১)

খেলা দেখা বা সমর্থন করার ক্ষেত্রেও এই মূলনীতিগুলো প্রযোজ্য। যেখানে অশ্লীলতা, সময় নষ্ট, আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন এবং অর্থ অপচয়ের মতো বিষয় জড়িত থাকে, সেখানে সমর্থন করা বা খেলা দেখা জায়েজ নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চাল রপ্তানিতে নতুন শর্ত দিল ভারত, বাংলাদেশে কতটা প্রভাব পড়বে

জাতীয় সংসদ নির্বাচন: বিএনপির প্রার্থী বাছাই শেষ হওয়ার পথে

মামুনুরের খোঁজ মেলেনি ৫ দিনেও, ক্লু নেই সিসিটিভি ফুটেজে

নীলক্ষেতে ব্যালট পেপার ছাপানোর অভিযোগ তদন্ত করছে ডাকসু নির্বাচন কমিশন

বাংলাদেশের বিদায়ে ৪১ বছরে প্রথমবার ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত