Ajker Patrika

অভুক্তের ক্ষুধা ও বিপদগ্রস্তের সংকটে মুমিনের করণীয়

কাউসার লাবীব
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এই নশ্বর পৃথিবীতে আমাদের জীবন সুখের ভেলায় ভাসলেও হয়তো অদূরেই কোনো এক মানবসন্তান ক্ষুধায় কাতর বা গভীর কোনো বিপদে অসহায়। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমরা হয়তো তাদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই না, কিন্তু তাদের হৃদয়ের কান্না ও প্রয়োজন আকাশ ছুঁয়ে যায়। একজন মুমিন হিসেবে আমাদের মনে রাখা জরুরি, জীবন একটাই এবং এই জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রাপ্তিগুলো প্রকৃত সফলতা নয়। প্রকৃত সফলতা নিহিত আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও ভালোবাসায়। যদি আমরা দয়াময় আল্লাহর দয়া পেতে চাই; তবে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে সেই আর্তি—ক্ষুধার্তকে অন্ন দেওয়া ও বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, অসহায়ত্বের চরম মুহূর্তে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইবাদতের শ্রেষ্ঠতম কাজ।

আল্লাহর করুণা লাভের চাবিকাঠি

ইসলামে মানবসেবা শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, বরং তা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। মহানবী (সা.)-কে যখন প্রশ্ন করা হলো, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো।’ (সহিহ বুখারি: ১২)

আমরা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে বেঁচে থাকি। যদি আমরা তাঁর করুণা ও দয়া পেতে চাই, তবে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়ার নজর দিতে হবে। দয়ার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন, ‘দয়াশীলদের প্রতি করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৪১)। সমাজে ধনী-গরিব, সক্ষম-অসক্ষম সব ধরনের মানুষ আছে। যে ব্যক্তি তার সাধ্যমতো অসহায়ের পাশে দাঁড়ায়, আল্লাহ তাকেও করুণার দৃষ্টি দেন।

ক্ষুধার্তকে না খাওয়ানোর ভয়াবহ পরিণতি

ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করার গুরুত্ব এত বেশি যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ অনাহারীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, তবে তা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হতে পারে। পবিত্র কোরআনে জাহান্নামিদের আত্মস্বীকৃত জবানবন্দি তুলে ধরা হয়েছে, ‘(তাদের প্রশ্ন করা হবে) কিসে তোমাদের জাহান্নামে নিয়ে গেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না এবং মিসকিনদের খাবার খাওয়াতাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির: ৪২-৪৪)

অন্যদিকে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ব্যক্তির প্রতি কঠোর প্রশ্ন রাখবেন, ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি খাবার চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খেতে দাওনি...তুমি কি জানতে না যে যদি তুমি তাকে খাবার খাওয়াতে, তাহলে তা অবশ্যই আমার কাছে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৯)। এর মাধ্যমে আল্লাহ বুঝিয়ে দেন, সৃষ্টির সেবা করা হলো সৃষ্টিকর্তার ইবাদত।

বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানোর পুরস্কার

বিপদগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে আল্লাহ বান্দার প্রতিদান বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। পবিত্র কোরআনে সেই সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি (চেহারা) লাভের জন্য মিসকিন, এতিম ও কয়েদিদের খাবার খাওয়ায়। তারা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চায় না। এই কাজের ফলস্বরূপ আল্লাহ তাদের রক্ষা করবেন এবং সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন, ‘যার ফলে আল্লাহ তাদের সেদিনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন আর তাদের দেবেন সজীবতা ও আনন্দ।’ (সুরা দাহার: ৮-১১)

সহযোগিতার পুরস্কার প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অন্যের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৬)

ইসলামে সাহায্য-সহযোগিতাকে ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই এবং একে অপরের সহায়ক। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অন্য ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৩১৪)। সৎকর্মশীল ব্যক্তি তারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, মুসাফির ও সাহায্য প্রার্থীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করে। তাদের জন্য কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তাও নেই।

আমরা অনেক সময় ইবাদতের অর্থকে শুধু নামাজ, রোজা বা হজের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। অথচ ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে ক্ষুধার্তকে আহার করানো, বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানো এবং অসহায়কে আশ্রয় দেওয়া আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠ ইবাদতগুলোর অন্যতম। মানবতার সেবা হলো ইমানের প্রকৃত সৌন্দর্য। তাই আমাদের সাধ্যের সামান্যতম দানও যদি কোনো অভুক্ত মুখে হাসি ফোটাতে পারে, সেটি আল্লাহর দৃষ্টিতে অমূল্য। মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী প্রাপ্তি একদিন হারিয়ে যাবে, কিন্তু মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রতিটি কাজ পরকালের পাথেয় হয়ে থাকবে। আসুন, আমরা জীবনের এই সংক্ষিপ্ত যাত্রায় দয়ার নবী (সা.)-এর পথ অনুসরণ করি, অসহায়কে আশ্রয় দিই এবং ক্ষুধার্তের মুখে আহার তুলে দিই। হয়তো এই সামান্য দয়া ও করুণা কিয়ামতের দিনে আমাদের জন্য জান্নাতের দুয়ার খুলে দেবে। রবের দয়া পেতে সাহায্য করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত