Ajker Patrika

আর্থিক খাতে তারল্যসংকটের কারণ

আব্দুর রাজ্জাক
আর্থিক খাতে তারল্যসংকটের কারণ

বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্যসংকট চলছে। সচেতন মানুষ যাঁদের আর্থিক সংগতি কিছুটা ভালো, সেই সব মানুষজন ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। অনেকেই আমার কাছে বলেছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিনই দু-একটি টেলিফোন পান, সব প্রতিষ্ঠানের একই কথা—আমাদের সক্ষমতা ভালো, আপনার সঞ্চয়ী অর্থ আমাদের প্রতিষ্ঠানে জমা রাখুন। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় লভ্যাংশের হিসাবটাও। প্রতিদিন ঘন ঘন এই সব টেলিফোন পাওয়ার অর্থ তাদের তারল্যসংকট প্রকট।

এই তারল্যসংকটের কারণ কী? যদি আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব, বাজারে যে পরিমাণ মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চালনায় রেখেছে, তাতে তারল্যসংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও সংকট প্রবল হচ্ছে, উচ্চ সুদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতের আহ্বান জানাচ্ছে।

কেন এই তারল্যসংকট? চলুন জানি। কিছু কিছু মানুষের ঘরের সিন্দুকে নগদ টাকা অলস পড়ে আছে। একেবারে নির্মোহ বিশ্লেষণ করা যাক, কোন শ্রেণির মানুষের ঘরে নগদ টাকা অলস পড়ে আছে। দেশে বেশ কয়েক বছরে আর্থিক খাতের অনলাইন সংস্করণ হয়েছে, অর্থাৎ ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। মানে, ব্যাংকে টাকা রাখতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র, টিন নম্বরসহ যেসব তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়, সেই সব তথ্য থেকে এই টাকার উৎস ও মালিক কে তা জানা যায়। আয়কর বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা টাকার সব উৎস অনুসন্ধান করতে পারে এসব তথ্যের মাধ্যমে।

যাঁদের অপ্রদর্শিত অর্থ, এককথায় বলতে পারেন কালোটাকা আছে, তাঁরা এখন আর ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখার সাহস পাচ্ছেন না। তাঁদের কাছে ব্যক্তি তথ্যসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখা, যেকোনো সময় বিপদের কারণ হতে পারে। এই কালোটাকা তাঁরা কষ্ট করে আয়কর দিয়ে বা কোনো সঠিক পথে উপার্জন করেননি। এই সব টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপার্জিত হয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস ডিউটি ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে।

এখন আসা যাক কোন শ্রেণির মানুষ এ রকম কালোটাকা উপার্জন করতে পারেন, সে বিষয়ে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বড় বড় শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় জমিসংক্রান্ত বিষয়ের যেসব সরকারি কর্মচারী আছেন, তাঁরা অনেকেই মোটা অঙ্কের টাকা দৈনিক উপার্জন করেন। অনেকেই জানেন, যাঁরা নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অনেকের দৈনিক আয় এই ঢাকা শহরে ১০ লাখ টাকার ওপরে। খুব একটা উচ্চপর্যায়ের চাকরি না হলেও ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মচারীরা প্রচুর কালোটাকা উপার্জন করেন। তাঁদের আয়ের সঙ্গে সংগতি না থাকার দরুন এই টাকা তাঁরা ঘরে সিন্দুকে রেখে দেন।

শুধু ভূমি ব্যবস্থাপনা নয়, ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত আছে সরকারের প্রায় সব প্রকৌশল খাত। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেসব প্রকৌশল খাত জড়িত, সেই সব খাতের প্রকৌশলী, সুপারভাইজার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট—প্রায় সবাই প্রতিদিন কালোটাকা উপার্জন করে থাকেন। কালোটাকা উপার্জনের সঙ্গে জড়িত আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ আয়কর বিভাগ, কাস্টমস, ভ্যাট বিভাগের অনেক সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য। এককথায় বললে বলতে হয় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও করপোরেশন, যেখানে গণমানুষের সঙ্গে লেনদেন ও বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, সেই সব খাতেই ঘুষ লেনদেন হয়। এভাবে প্রচুর কালোটাকা প্রতিদিন মানুষের ঘরে সিন্দুকে জমা হচ্ছে।

সরকারের কোনো বিভাগে চাকরি না করেও অনেক সময় চাঁদাবাজি ও দালালির মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা, সমাজের উচ্চপর্যায়ের নামীদামি ব্যক্তি প্রচুর কালোটাকা উপার্জন করেন। এসব টাকাও মূল স্রোতে না এসে ঘরে জমা থাকে। এই টাকা শুধু টাকা হিসেবে নয়, অনেক সময় এই কালোটাকা দিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত কালো বাজার থেকে ডলার কিনে ঘরে জমা রাখে, যার কারণে ব্যাংকে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এই টাকা দিয়ে অনেকে সোনা কিনে ঘরে জমা রাখছে, যার কারণে সোনার দাম ঊর্ধ্বগতি।

এসব টাকা তারা শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করতে পারছে না, শেয়ার মার্কেটে লগ্নি করলে প্রতিবছর কমে বৈকি, বাড়ে না। এ রকম অবস্থা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে অর্থনীতি কিন্তু সোজা পথে আসবে না। মানুষের অভ্যাস এক দিনে পাল্টানো যায় না, তাই আইনগতভাবে বুঝে-শুনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ওপরের অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমে দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। দুর্নীতি শুধু একজনের পকেটের পয়সা অন্যজনের পকেটে যায় না, তারল্যসংকট সৃষ্টি করে, রিজার্ভে ঘাটতি ঘটায়। বিভিন্নভাবে পাচার হয়ে বিদেশে চলে যায়। সোনাসহ জমি ও সম্পদের মূল্য বেড়ে যায়। অতিসাধারণ মানুষ তাদের সম্পদ ধীরে ধীরে হারাতে থাকে, নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের কাছে সব সম্পদ চলে যায়, যা জাতির জন্য আত্মঘাতী।

আপনারা একটা জিনিস হয়তো লক্ষ করেছেন, বর্তমানে বাজারে নতুন টাকার নোট নেই বললেই চলে। অথচ ঈদের আগেও নতুন টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে। গত বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ছেপেছে। এই সব নতুন টাকা, নতুন নোট তাহলে উধাও হলো কোথায়? নিশ্চয়ই এসব নতুন টাকা ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজদের ঘরের সিন্দুকে!

একটি কথা প্রচলিত আছে, হয়তো অনেকেরই জানা, ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস আউট গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন’; অর্থাৎ ভালো টাকাকে হিসাব থেকে তাড়িয়ে দেয় খারাপ টাকা! এ কথাটি বর্তমানে আমাদের সমাজে শতভাগ সত্য।

সর্বশেষ যে কথাটি বলতে চাই, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ না হলে, তারল্যসংকট কমবে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভও বাড়বে না। অতএব আসুন, সবাই একযোগে এখন থেকেই ঘুষ-দুর্নীতি আর চাঁদাবাজিকে ‘না’ বলি। আর সরকারের উচিত, এ ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুর্নীতিবাজ যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন, তাদের নির্মূল করতেই হবে।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলে ২০ লাখ রুশভাষীর বাস, রাশিয়াকে তাঁদের কথা ভাবতে হয়: পুতিন

ইরানের পতন হলে, এরপরই রাশিয়া—অভিমত রুশ বিশ্লেষকদের

হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করে ইউটার্ন নিল দুটি জাহাজ

লাইভ-২ (২৩ জুন, ২০২৫) ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কাঁপল ইসরায়েল, তেহরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি থেকে বিদায় নিচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত