Ajker Patrika

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির নামই কী বাজেট

আমীন আল রশীদ
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির নামই কী বাজেট

প্রতিবছর জুন মাসের শুরুতে যেদিন জাতীয় সংসদে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়, তার আগের দিন থেকেই জনমনে খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায় যে, কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে প্রথম যে জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়, তার আকার ছিল ৭১৯ কোটি টাকা। ৫২ বছর পরে সেই বাজেটের আকার ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। যদিও বাজেটের আকার ৭৮৬ কোটি নাকি ৭ লাখ কোটি, সেটি একজন সাধারণ মানুষের কাছে নিতান্তই একটি সংখ্যা। তার কাছে জরুরি হচ্ছে বাজেট তার জীবনযাপনের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে গত বৃহস্পতিবার নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রথম যে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করলেন, তার বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটরের দাম বাড়বে।

প্রসঙ্গত, দেশে যে ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয়, তার ৯০ শতাংশই এখানে উৎপাদিত। দেশে তৈরি এসির ওপরও সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসির দামও বাড়বে। গত এপ্রিল মাসে সারা দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ গরমে যখন মানুষ নাকাল হয়, তখন এসির বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। অনেক স্বল্প আয়ের মানুষও একটু প্রশান্তির জন্য বাসায় এসি লাগিয়েছে।

একদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করতে গিয়ে লাখ লাখ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে; নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় ভরাট করে পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে লাখ লাখ এসি থেকে বের হওয়া গরম বাতাস পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে এসি ব্যবহারে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে যদি এসির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে এই প্রশ্নও করতে হবে যে পরিবেশ সুরক্ষা ও দেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাষ্ট্র কতটা আন্তরিক?

এত দিন বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো বিশেষ শুল্কছাড়ে চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ পেলেও এবারের বাজেটে ২০০টির বেশি চিকিৎসাযন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসাসেবার মূল্য বাড়িয়ে দিতে পারে বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীর অত্যধিক চাপ এবং তার ওপর নানা রকম অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাব্যয় রাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক মানুষেরই নাগালের বাইরে। তারপরও বাধ্য হয়ে তাদের এই সব হাসপাতালে যেতে হয়। কিন্তু যন্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের দোহাই দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসাব্যয় কতটা বাড়িয়ে দেবে, সেটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

পর্যটন ও বিনোদন যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য বিরাট আয়ের উৎস। এবারের বাজেটে বিনোদনকেন্দ্র তথা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ভ্যাট দ্বিগুণ (১৫ শতাংশ) করা হচ্ছে। ফলে ঘোরাঘুরি ও বিনোদনের খরচ বাড়বে। এই বাড়তি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হলে ভালো। তবে ভ্যাট দ্বিগুণের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা এই সব সেবার মূল্য কী পরিমাণ বাড়িয়ে দেন, সেটিও চিন্তার বিষয়।

বাংলাদেশ একটি অনিন্দ্যসুন্দর দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পর্যটন বিকশিত না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, অতিরিক্ত খরচ। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এবং ঢাকার আশপাশে গাজীপুর বা অন্যান্য এলাকায় হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের ভাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এবারের বাজেট পর্যটন ও বিনোদনের খরচ আরও বাড়িয়ে দিলে সেটি সামগ্রিকভাবে এ খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এবারের বাজেটে বলা হয়েছে, বিয়ে, জন্মদিন, গায়েহলুদ, সুন্নতে খতনাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সভা, সেমিনার, পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করতে কমিউনিটি সেন্টার ও মিলনায়তন ভাড়া করতে চাইলে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না, সেই প্রশ্ন আছে। কেননা যাঁরা কমিউনিটি সেন্টার নানা প্রয়োজনে ভাড়া নেন, তাঁদের বিরাট অংশই ট্যাক্স দেন না। অতএব রিটার্নের রসিদও তাঁরা দিতে পারবেন না।

ফলে তাঁরা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে গেলে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে পারবেন—এমন কারও মাধ্যমে হল ভাড়া নেবেন। অথবা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নেওয়ার পরিমাণ কমে যাবে। মানুষ বিকল্প জায়গায় অনুষ্ঠান করবে। সে ক্ষেত্রে এটি কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এবার সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ তথা কলরেট। বলা হচ্ছে, ১০০ টাকার কথা বলতে হলে রিচার্জ করতে হবে ১৩৯ টাকা। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এখন সারা বিশ্বেই নিত্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যে এখন আর রসিকতার বিষয় নয়, সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এই মোবাইল ফোন। সমাজের প্রান্তিক মানুষও এখন যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। সুতরাং মানুষের কথা বলার ওপর এত বেশি ট্যাক্স আরোপ করা ঠিক হয়নি।

প্রতিবছরের বাজেটে কিছু পণ্যের দাম কমারও ইঙ্গিত থাকে। যেমন এবার আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে গুঁড়ো দুধের দাম কমতে পারে। কিন্তু আদৌ কমবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বাজেট পেশের পরে যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বেড়ে গেলেও যেগুলোর দাম কমার কথা, সেগুলো আর কমে না। বিক্রেতাদের খুব সাধারণ দাবি, এগুলো আগে কিনে রাখা হয়েছে।

বিগত বাজেটগুলোয় কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস সেবার বিভিন্ন উপকরণে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেবামূল্য কমেনি। এবারও ডায়ালাইসিস সেবায় ব্যবহৃত ফিল্টারের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ কিডনি রোগীরা এর সুবিধা পাবেন কি না, সেই প্রশ্নও আছে।

অতএব বাজেট যাতে ৭ কোটি কিংবা ৭ লাখ কোটির সংখ্যায় আটকে না থাকে; বরং বাজেট যাতে সাধারণ মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে; বাজেটের বাস্তবায়ন যাতে ঠিকঠাক মতো হয়—সে জন্য এর মনিটরিং সিস্টেম জোরদার করা জরুরি।

বাজেট মানেই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি—সাধারণ মানুষের এই বদ্ধমূল ধারণায় পরিবর্তন আনা দরকার। সে জন্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্প এবং অন্য সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। তাতে জনজীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে এমন জিনিসপত্রের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ নয়; বরং শুল্ক কমালেও জাতীয় আয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কিন্তু দুর্নীতি বন্ধের জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে যে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দরকার—সেটি কতটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, সে প্রশ্নটি ৫০ বছর আগে যেমন ছিল, এখনো আছে।

সাংবাদিক ও লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত