Ajker Patrika

এডিপির ১০ মাসের চিত্র: বাস্তবায়ন মাত্র ৪১ শতাংশ

মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ১২: ১৩
এডিপির ১০ মাসের চিত্র: বাস্তবায়ন মাত্র ৪১ শতাংশ
প্রতীকী ছবি

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বাজেট ঘোষণার মাত্র ৬৫ দিনের মাথায় গণ-আন্দোলনের মুখে সেই সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তী দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সময় যত গড়িয়েছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—গত সরকারের এডিপি পরিকল্পনা বাস্তবতাবিবর্জিত ছিল। উন্নয়ন ব্যয়ের সক্ষমতা, বাস্তবায়নযোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে পর্যালোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার এডিপি পুনর্গঠন করে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত অসংখ্য প্রকল্প বাদ পড়ে। পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক সহায়তার অনিশ্চয়তা এবং অর্থছাড়ের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রমও হয়ে পড়ে জটিল ও ধীরগতির। এতে ফলাফল প্রত্যাশিতই—অর্থবছরের ১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও সংশোধিত এডিপির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশই রয়ে গেছে বাস্তবায়নের বাইরে। এডিপি বাস্তবায়নে এই মারাত্মক পশ্চাদপসরণ অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দেওয়ার পাশাপাশি বাজেটকাঠামোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। যে কারণে আসন্ন বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংযত এডিপি প্রণয়ন করতে হচ্ছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ পুনর্নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তবে বাস্তবায়নের গতি এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস—অর্থাৎ জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৪২৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ফলে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাকি দুই মাসে অতিরিক্ত ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে, যা একপ্রকার অবাস্তব লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। কারণ, দুই মাসে সরকারের যেমন এত টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য নেই, তেমনি খরচেরও সামর্থ্য নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন। যার ফলে অনেক সাইটে কাজ হচ্ছে না, যার কারণে ধস নেমেছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে।

গতকাল সোমবার পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ৪১.৩১ শতাংশ, যা ২০১৮-১৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এ সময়ে অর্থছাড় হয়েছে ৯৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। শুধু এপ্রিল মাসেই অর্থছাড় কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকায়, আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় যা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। এই তথ্যে এডিপি বাস্তবায়নের গতি ও অর্থছাড়ে স্পষ্ট স্থবিরতার চিত্র উঠে এসেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এডিপির অবশিষ্ট দুই মাসে বড়জোর ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় সম্ভব—এর বেশি নয়। ফলে পুরো বরাদ্দের একটি বড় অংশ অপরিব্যয়িত থেকেই যাবে। তাঁদের মতে, শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে ব্যয় বাড়ানোর চাপে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, অনেক প্রকল্পে কাজ শেষ হলেও বিল পরিশোধ আটকে আছে, কারণ সরকার এখন বিলগুলো যাচাই-বাছাই করে তবেই অর্থছাড় দিচ্ছে—যার ফলে ব্যয়ের গতি কম। তাঁর ভাষায়, কোনো বছরই বাজেটের পুরো অর্থ খরচ হয় না, তবে শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে অর্থ ব্যয় করলে অপচয়, দুর্নীতি এবং গুণগত মানহানির ঝুঁকি বাড়ে। তাই তিনি মনে করেন, বিল যাচাই করে ধাপে ধাপে অর্থছাড় করাই হবে সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক পথ।

ধীরগতির বিষয়ে আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঠিকমতো অর্থছাড় না হওয়া। কারণ, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রকৃত চাহিদা না থাকায় এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা ছাঁটাই করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হলেও ইতিহাস বলে এই অর্থ ব্যয় হয় না। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এডিপি বাস্তবায়ন মূল পরিকল্পনার চেয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কম হবে। প্রথম ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ (১৯,৭৬৩ কোটি টাকা), বিদ্যুৎ বিভাগ (১৫,২৭০ কোটি), ও সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ (৮,৬২৫ কোটি)। বিপরীতে সবচেয়ে কম ব্যয় করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (১.২৯%), স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ (২.৩৪%) এবং ভূমি মন্ত্রণালয় (১২%)। এসব খাতের বরাদ্দের বড় অংশই রয়ে গেছে অব্যবহৃত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত