Ajker Patrika

মুক্ত বাণিজ্য কোন পথে

অনিক হোসেন
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৭: ২৬
মুক্ত বাণিজ্য কোন পথে

‘দ্য ইকোনমিস্ট’ সংবাদপত্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪৩ সালে। ব্রিটেনের সুরক্ষাধর্মী ভুট্টা আইন বাতিলের প্রচারণায় যুক্ত হয়েছিল পত্রিকাটি। ১৮৪৬ সালে ‘ভুট্টা আইন’ বাতিলের মধ্য দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছিল।

এ ঘটনা যুক্তরাজ্যে মুক্ত বাণিজ্যের পথ তৈরি করেছিল। যদিও এর পরও এই বিতর্ক ছিল যে, সুরক্ষাধর্মী আইন বাণিজ্যের জন্য উপকারী। ১৯৪৫ সালের পর বিশ্বনেতারা এমন বিতর্ক থেকে সরে আসেন এবং মুক্ত বাণিজ্যের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। এই ধারণায় মনে করা হতে থাকে যে উন্মুক্ত বাজার উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা ও ক্রমান্বয়ে উন্নতির জন্য সহায়ক। এমন ভাবনা থেকেই ১৯৪৮ সালে শুল্ক ও বাণিজ্যসংক্রান্ত সাধারণ চুক্তিতে (গ্যাট) বিভিন্ন দেশ স্বাক্ষর করতে শুরু করেছিল। এটি ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) রূপ নেয়।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা একটি অসাধারণ অর্জন। ক্রমে এটি আন্তর্জাতিকভাবে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় একক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এটি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে। এর ফলে নিয়ম ভঙ্গের কারণে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তাঁরা অভিযোগ করতে পারেন সেখানে। এতে বড় দেশগুলো  ছোট দেশগুলোর ওপর প্রভাব খাটাতে পারে না। এমনকি দেরিতে হলেও ২০০১ সালে চীন যখন এতে যোগ দিয়েছিল, তখন পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই আশা করেছিল, এটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একীভূত হবে।

এই সংস্থায় সবকিছুই করা হতো নিয়মের ভিত্তিতে। তার মধ্যে ব্যতিক্রম ব্যবস্থাগুলোও অনুমোদিত ছিল। যদিও সেগুলো নিয়ম মেনেই করা হয়েছিল। খুব সহজেই অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় এর মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি নিয়ম সামান্যভাবে রাখা হয়েছিল। কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ন্যায্যতা হিসেবে পরিবেশ সুরক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কারণ, এর বেশি প্রয়োজনও ছিল না। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক একীভূতকরণকে অন্য লক্ষ্যগুলো অর্জনে সহায়তা করার একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।

কিন্তু এর ফলে শুল্ক কমে গিয়েছিল বেশ। ১৯৯০-২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের অধীন প্রয়োগ করা বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট গড় বৈশ্বিক শুল্ক ৪ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। এ সময় দরিদ্র দেশগুলোয় শুল্ক কমার হার সবচেয়ে বেশি ছিল। একই সময়সীমার মধ্যে চীনের শুল্ক ২৮ পয়েন্ট, ভারতের ৫১ ও ব্রাজিলের ১০ পয়েন্ট কমেছে। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্রায় ৫০ থেকে ২০১৯ সালে ৩০০-তে উন্নীত হয়েছিল। এগুলো বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট শুল্ক কমিয়ে দেয় আরও ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

মুক্ত বাণিজ্য নীতির কারণে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল ব্যাপকভাবে। ১৯৭০ দশকের প্রায় ৩০ শতাংশ থেকে ২০১০-এর দশকে এটি পৌঁছেছিল ৬০ শতাংশে। একই সময়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের মোট সরবরাহ চেইনের পরিমাণ ৩৭ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে পৌঁছায়।

পরিবহন ব্যয় অনেক কমে যাওয়ায় ওই সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে যায়। চীন ডব্লিউটিওতে যোগদানের পর, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাইল হ্যান্ডলি ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুনো লিমাওর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সার্বিক অনিশ্চয়তা কমে যাওয়ায় ২০০০-২০০৫ সালের মধ্যে চীনের রপ্তানি এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে গিয়েছিল।

মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থনকারীদের মত অনুযায়ী, এটি জীবনযাত্রার মান অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থার ফলে বিশ্বব্যাপী মাথাপিছু আয় দীর্ঘ মেয়াদে বেড়েছে। এ ছাড়া ডার্টমাউথ কলেজের ডগলাস আরউইনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব অনুন্নত দেশ বাণিজ্যকে উদারীকরণ করেছে, তারা এক থেকে দেড় শতাংশ হারে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এটি এক দশক পর ১০ থেকে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন মনে করে, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত আয় ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।

বর্তমানে বাণিজ্যের আরও উদারীকরণের কিছু পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব জোরদার করতে ২০২০ সালের নভেম্বরে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ১৫টি দেশ এক হয়েছিল। এটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যগোষ্ঠী। আফ্রিকা মহাদেশের ৩৮টি দেশ চলতি বছরের শুরুতে মুক্ত বাণিজ্য এগিয়ে নিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্য প্রতিবেশী ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক চুক্তির মাধ্যমে তার মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ পূরণ করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রে সাধারণ আন্তর্জাতিক মান নিয়ে আলোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ।

যদিও বিশ্লেষকদের বক্তব্য, অবাধ বাণিজ্যের মূল লক্ষ্য ঠিক এমন ছিল না। ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাণিজ্যের উদারীকরণ কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোয়নি। অন্যান্য চুক্তির কাজও ধীর হয়ে গেছে।

মুক্ত বাণিজ্যের যে প্রতিশ্রুতি, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। উন্নত দেশগুলোর রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান এবং অভিযোগ করে থাকেন, উদারীকরণের কারণে যেমন অনেকে লাভবান হয়, তেমনি অনেকে বেশ ক্ষতির সম্মুখীনও হয়ে থাকে। অর্থাৎ তাদের বক্তব্য হলো, এটি ঠিক অনির্বচনীয় লাভের উৎস নয়।

রাজনীতিবিদদের এমন বিরাগ কিছুদিন আগেও দেখা গেছে মার্কিন মুলুকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়মকানুনভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এখন আর এলোমেলো শুল্ক আরোপের হুমকি দেয় না। তবে আবার ট্রাম্পের মতো কেউ প্রেসিডেন্ট হবেন না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?

এদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মধ্যেও অচলাবস্থা রয়েছে। সমালোচকেরা মনে করেন, চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বেশির ভাগ সুবিধা নিলেও বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ১৬৪ সদস্যের এই সংস্থার নিয়মগুলো হালনাগাদ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ, এ ক্ষেত্রে সব সদস্যের একমত হওয়ার বিধান আছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া বাণিজ্যিক বিরোধ মেটাতে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেটি করাই এখন কঠিন হচ্ছে দিনকে দিন। কোভিড মহামারি দেখিয়েছে, প্রকট জাতীয়তাবাদী ভাবনা কত দ্রুত বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ২০২০ সালে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ২০২১ সালের আগস্টেও ওই বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিল।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যুদ্ধ বা সংঘাত বেশ নিয়মিত ঘটনা। প্রতিটি যুদ্ধের পরই মানুষ মুক্ত বাণিজ্যকে স্বাগত জানায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এটি একটি দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে প্রবৃদ্ধির গতি স্লথ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেই। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের অনিশ্চয়তার কারণে ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ০.৭৫ শতাংশ হতাশাজনকভাবে কমে গিয়েছিল।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্য এখন ক্রমে দর-কষাকষির একটা বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু বাণিজ্যের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং বাণিজ্য দিয়ে অন্যান্য সুবিধা আদায় করে নেওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন, বাণিজ্য দিয়ে হয়তো ভৌগোলিক বা পররাষ্ট্রবিষয়ক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রগুলো।

প্রশ্ন উঠছে: উদ্দেশ্যের এমন পরিবর্তনে কি মুক্ত বাণিজ্যব্যবস্থার গতিপথ বদলে যাচ্ছে? বিশ্লেষকদের মতে, এটি পুরোপুরি বুঝতে প্রয়োজন আরও খানিকটা সময়। এর পরই বোঝা যাবে, মুক্ত বাণিজ্যব্যবস্থা আর আগের রূপে আছে কি না!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাইপলাইনে জ্বালানি পরিবহন: ৩৪ হাজার লিটার ঘাটতি যমুনার প্রথম পার্সেলে

১টা বাজলেই আর স্কুলে থাকে না শিক্ষার্থীরা, ফটকে তালা দিয়েও ঠেকানো গেল না

চিকিৎসক হওয়ার আগেই শীর্ষ সবার শীর্ষে

আসামে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বহাল থাকবে দুর্গাপূজা পর্যন্ত

ভিকারুননিসায় হিজাব বিতর্ক: বরখাস্ত শিক্ষককে পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত