অনলাইন ডেস্ক
ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ বাতিল হয়েছে গত এপ্রিলে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে না বলে তখনই মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। গত এক মাসে বন্দরগুলোতে তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। তবে কিছুটা খরচ যে বাড়েনি তা বলা যাবে না।
এখন আবার গত ১৭ মে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে স্থল কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস) বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাবপত্র রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে।
ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহারে বিধিনিষেধ আসায় রপ্তানিকারকদের অনেকটা পথ ঘুরে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে সময় লেগে যাবে ৮ থেকে ১০ দিন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এতে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বেড়ে যাবে। বাড়বে চোরাচালান।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের। অপর দিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিতে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে। আমদানি করেছে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। সে হিসাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। নতুন করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এই বিধিনিষেধের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে তার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:
তৈরি পোশাক (আরএমজি): বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি এই আরএমজি খাত। প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর ৯৩ শতাংশই ঐতিহ্যগতভাবে স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করে। বিধিনিষেধ আরোপের পর বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোতে তৈরি পোশাক বোঝায় বিপুলসংখ্যক ট্রাক আটকা পড়েছে। এই রপ্তানি শুধু কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে করতে বাধ্য করলে পরিবহন খরচ ও সময় বাড়বে। এতে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের রাজস্ব কমতে হতে পারে। আর এতে প্রভাবিত হতে পারে শ্রমঘন পোশাক শিল্পের কর্মসংস্থান।
অন্যান্য ভোগ্যপণ্য: প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাবপত্র ও কার্বোনেটেড পানীয়ের ওপর বিধিনিষেধের ফলে বছরে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি (ভারতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪২ শতাংশ) প্রভাবিত হবে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো কোম্পানি, যারা ভারতে ৬০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, তারা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে।
রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি: ২০২৩ সালে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশে মোট রপ্তানির পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আরএমজি। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানি-নির্ভর। আর এর বড় অংশ তৈরি পোশাক। বাণিজ্য বাধা অব্যাহত থাকলে, বৃহত্তর অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভাবিত হতে পারে।
এ ছাড়া স্থলবন্দরের পরিবর্তে সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি করলে পরিবহন খরচ ও বিলম্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বন্ধ হওয়া ভারত স্থল-বিমান ট্রান্সশিপমেন্ট রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশি পোশাক এক সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিমের বাজারে পৌঁছানো যেত, যেখানে সমুদ্রপথে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। ফলে ভারতের এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পণ্যকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার আশঙ্কাও থাকছে।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হয় গত ৯ এপ্রিল। এই সুবিধা হারানোর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মতো তৃতীয় দেশে ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের রপ্তানি করার সক্ষমতা ইতিমধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে। স্থলবন্দরের ওপর আরও বিধিনিষেধ এটিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এতে বাংলাদেশকে বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক বাণিজ্য নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে নানা ভাবে। উচ্চ ব্যয় ও বাজারে প্রবেশাধিকার কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পে, বিশেষ করে শ্রমঘন আরএমজি খাতে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রভাবিত হলে স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এর আগে অবশ্য বাংলাদেশ ভারতের সুতা ও চালের ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। ভারতের বাণিজ্য বিধিনিষেধকে এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন দেশটির পর্যবেক্ষকেরা। এ ছাড়া সেভেন সিস্টারসে বাণিজ্য সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চীনকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটিকে ভালোভাবে নেয়নি ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে।
বিধিনিষেধে ভারতের ওপর প্রভাব:
ইতিবাচক প্রভাব:
বাংলাদেশি আমদানি, বিশেষ করে আরএমজি, প্লাস্টিক ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর বিধিনিষেধ ভারতের উৎপাদকদের জন্য, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সুযোগ তৈরি করবে—এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের। এটি এই অঞ্চলে আত্মনির্ভরতা ও শিল্প প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করার জন্য আত্মনির্ভর ভারত উদ্যোগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
ভারতীয় বস্ত্র উৎপাদকেরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের দামের সুবিধা (চীন থেকে শুল্কমুক্ত কাপড় আমদানি ও রপ্তানি ভর্তুকির কারণে) নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন, তাঁরা অভ্যন্তরীণ বাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেতে পারেন।
নেতিবাচক প্রভাব:
তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো (আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম) বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য স্থলবন্দরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিধিনিষেধ মাছ, পাথর ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের মতো পণ্যের আমদানি ব্যাহত করবে। এতে এসব রাজ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এতে স্থানীয় ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা প্রভাবিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা, যারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক ও আসবাবপত্র আমদানি করেন, তাঁরা সরবরাহ চেইন সমস্যার সম্মুখীন হবেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১১টি স্থল ট্রানজিট পয়েন্ট (আসামে তিনটি, মেঘালয়ে দুটি, ত্রিপুরায় ছয়টি) সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিধিনিষেধের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ও বন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানও এতে প্রভাবিত হতে পারে।
এ ছাড়া দুই দেশের আরও কিছু বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে অনুমান করা যায়। ভারতের এই বিধিনিষেধ বাংলাদেশের ভারতীয় সুতা (১৩ এপ্রিল থেকে বন্ধ) ও চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা, সেই সঙ্গে উচ্চ ট্রানজিট ফি (টন প্রতি কিলোমিটারে ১.৮ টাকা) ও কঠোর পরিদর্শনের প্রতিক্রিয়া বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে, এই পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা আরও বাড়তে পারে। এতে বাংলাদেশে ভারতের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি আরও সীমিত হবে। যেখানে বাংলাদেশের বস্ত্র রপ্তানির ৩০ শতাংশই হয় ভারতে।
এ ছাড়া ভারতীয় রপ্তানিকারকদের কন্টেইনার শিপিং বা অভ্যন্তরীণ জলপথের মতো ব্যয়বহুল বিকল্প খুঁজতে হতে পারে। এটি তাঁদের জন্য আগের মতো লাভজনক থাকবে না।
বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে আরএমজি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রি হয়। ভারত বিধিনিষেধ আরোপ করায় এই পণ্যগুলোর দাম বাড়তে পারে। এতে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার ভোক্তাদের, যারা আন্তসীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের ভোক্তাব্যয় বেড়ে যাবে।
দুই দেশের মধ্যে এই বাণিজ্য বিরোধের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কখনোই বাণিজ্য ভারসাম্য ছিল না। ২০২৩-২৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ছিল ১২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারত ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং বাংলাদেশ ভারতে ১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিধিনিষেধ এই ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ এতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বেশি বাধার সম্মুখীন হবে।
আর এই বিরোধের আঞ্চলিক প্রভাবও দেখার অপেক্ষা। কারণ উভয় দেশই বিমসটেকের অংশ। বাণিজ্য ব্যাঘাত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণকে দুর্বল করতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি ট্রানজিট হাব হওয়া এবং নেপাল ও ভুটানে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজস্ব রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা এই জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
এই পরিস্থিতিতে দুই দেশই বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনে এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছে। বাংলাদেশ কার্গো বিমানের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওদিকে ভারত মিয়ানমার হয়ে সেভেন সিস্টারসে করিডর নির্মাণের চেষ্টা করছে। তবে শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যয় এতে বেড়ে যাবে। এতে ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বর্তমান বিরোধের প্রভাব সংক্ষেপে বর্ণনা করলে দাঁড়ায়: স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রপ্তানি-ভিত্তিক অর্থনীতি, বিশেষ করে আরএমজি খাতের জন্য একটি বড় হুমকি। ভারতের জন্য, এই নিষেধাজ্ঞা স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করলেও, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাণিজ্যে ব্যাঘাত এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করে। উভয় দেশই অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর ফলাফল নির্ভর করছে তারা বাণিজ্য ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য পারস্পরিক লাভ বিবেচনায় আলোচনার টেবিলে বসতে পারে কিনা তার ওপর।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ বাতিল হয়েছে গত এপ্রিলে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে না বলে তখনই মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। গত এক মাসে বন্দরগুলোতে তেমন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। তবে কিছুটা খরচ যে বাড়েনি তা বলা যাবে না।
এখন আবার গত ১৭ মে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে স্থল কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস) বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাবপত্র রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্দা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে।
ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহারে বিধিনিষেধ আসায় রপ্তানিকারকদের অনেকটা পথ ঘুরে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে সময় লেগে যাবে ৮ থেকে ১০ দিন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এতে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বেড়ে যাবে। বাড়বে চোরাচালান।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের। অপর দিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিতে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে। আমদানি করেছে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। সে হিসাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। নতুন করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধে এই ঘাটতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এই বিধিনিষেধের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে তার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:
তৈরি পোশাক (আরএমজি): বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি এই আরএমজি খাত। প্রতি বছর ভারতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর ৯৩ শতাংশই ঐতিহ্যগতভাবে স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করে। বিধিনিষেধ আরোপের পর বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোতে তৈরি পোশাক বোঝায় বিপুলসংখ্যক ট্রাক আটকা পড়েছে। এই রপ্তানি শুধু কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে করতে বাধ্য করলে পরিবহন খরচ ও সময় বাড়বে। এতে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের রাজস্ব কমতে হতে পারে। আর এতে প্রভাবিত হতে পারে শ্রমঘন পোশাক শিল্পের কর্মসংস্থান।
অন্যান্য ভোগ্যপণ্য: প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাবপত্র ও কার্বোনেটেড পানীয়ের ওপর বিধিনিষেধের ফলে বছরে প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি (ভারতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪২ শতাংশ) প্রভাবিত হবে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো কোম্পানি, যারা ভারতে ৬০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, তারা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে।
রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি: ২০২৩ সালে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশে মোট রপ্তানির পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশ জুড়ে রয়েছে আরএমজি। বলতে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানি-নির্ভর। আর এর বড় অংশ তৈরি পোশাক। বাণিজ্য বাধা অব্যাহত থাকলে, বৃহত্তর অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভাবিত হতে পারে।
এ ছাড়া স্থলবন্দরের পরিবর্তে সমুদ্রবন্দর দিয়ে রপ্তানি করলে পরিবহন খরচ ও বিলম্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বন্ধ হওয়া ভারত স্থল-বিমান ট্রান্সশিপমেন্ট রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশি পোশাক এক সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিমের বাজারে পৌঁছানো যেত, যেখানে সমুদ্রপথে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। ফলে ভারতের এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পণ্যকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলার আশঙ্কাও থাকছে।
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হয় গত ৯ এপ্রিল। এই সুবিধা হারানোর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মতো তৃতীয় দেশে ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের রপ্তানি করার সক্ষমতা ইতিমধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে। স্থলবন্দরের ওপর আরও বিধিনিষেধ এটিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এতে বাংলাদেশকে বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক বাণিজ্য নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে।
এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে নানা ভাবে। উচ্চ ব্যয় ও বাজারে প্রবেশাধিকার কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী শিল্পে, বিশেষ করে শ্রমঘন আরএমজি খাতে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রভাবিত হলে স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এর আগে অবশ্য বাংলাদেশ ভারতের সুতা ও চালের ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। ভারতের বাণিজ্য বিধিনিষেধকে এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন দেশটির পর্যবেক্ষকেরা। এ ছাড়া সেভেন সিস্টারসে বাণিজ্য সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চীনকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটিকে ভালোভাবে নেয়নি ভারত। ফলে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে।
বিধিনিষেধে ভারতের ওপর প্রভাব:
ইতিবাচক প্রভাব:
বাংলাদেশি আমদানি, বিশেষ করে আরএমজি, প্লাস্টিক ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর বিধিনিষেধ ভারতের উৎপাদকদের জন্য, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে সুযোগ তৈরি করবে—এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের। এটি এই অঞ্চলে আত্মনির্ভরতা ও শিল্প প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করার জন্য আত্মনির্ভর ভারত উদ্যোগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
ভারতীয় বস্ত্র উৎপাদকেরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের দামের সুবিধা (চীন থেকে শুল্কমুক্ত কাপড় আমদানি ও রপ্তানি ভর্তুকির কারণে) নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন, তাঁরা অভ্যন্তরীণ বাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেতে পারেন।
নেতিবাচক প্রভাব:
তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো (আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম) বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য স্থলবন্দরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিধিনিষেধ মাছ, পাথর ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের মতো পণ্যের আমদানি ব্যাহত করবে। এতে এসব রাজ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এতে স্থানীয় ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা প্রভাবিত হবেন। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা, যারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক ও আসবাবপত্র আমদানি করেন, তাঁরা সরবরাহ চেইন সমস্যার সম্মুখীন হবেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১১টি স্থল ট্রানজিট পয়েন্ট (আসামে তিনটি, মেঘালয়ে দুটি, ত্রিপুরায় ছয়টি) সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিধিনিষেধের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ও বন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানও এতে প্রভাবিত হতে পারে।
এ ছাড়া দুই দেশের আরও কিছু বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে অনুমান করা যায়। ভারতের এই বিধিনিষেধ বাংলাদেশের ভারতীয় সুতা (১৩ এপ্রিল থেকে বন্ধ) ও চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা, সেই সঙ্গে উচ্চ ট্রানজিট ফি (টন প্রতি কিলোমিটারে ১.৮ টাকা) ও কঠোর পরিদর্শনের প্রতিক্রিয়া বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে, এই পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা আরও বাড়তে পারে। এতে বাংলাদেশে ভারতের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের সুতা রপ্তানি আরও সীমিত হবে। যেখানে বাংলাদেশের বস্ত্র রপ্তানির ৩০ শতাংশই হয় ভারতে।
এ ছাড়া ভারতীয় রপ্তানিকারকদের কন্টেইনার শিপিং বা অভ্যন্তরীণ জলপথের মতো ব্যয়বহুল বিকল্প খুঁজতে হতে পারে। এটি তাঁদের জন্য আগের মতো লাভজনক থাকবে না।
বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে আরএমজি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রি হয়। ভারত বিধিনিষেধ আরোপ করায় এই পণ্যগুলোর দাম বাড়তে পারে। এতে বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার ভোক্তাদের, যারা আন্তসীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের ভোক্তাব্যয় বেড়ে যাবে।
দুই দেশের মধ্যে এই বাণিজ্য বিরোধের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কখনোই বাণিজ্য ভারসাম্য ছিল না। ২০২৩-২৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ছিল ১২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারত ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং বাংলাদেশ ভারতে ১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিধিনিষেধ এই ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ এতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বেশি বাধার সম্মুখীন হবে।
আর এই বিরোধের আঞ্চলিক প্রভাবও দেখার অপেক্ষা। কারণ উভয় দেশই বিমসটেকের অংশ। বাণিজ্য ব্যাঘাত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণকে দুর্বল করতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি ট্রানজিট হাব হওয়া এবং নেপাল ও ভুটানে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজস্ব রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা এই জটিলতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
এই পরিস্থিতিতে দুই দেশই বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনে এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছে। বাংলাদেশ কার্গো বিমানের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওদিকে ভারত মিয়ানমার হয়ে সেভেন সিস্টারসে করিডর নির্মাণের চেষ্টা করছে। তবে শেষ পর্যন্ত উভয় দেশের বাণিজ্য ব্যয় এতে বেড়ে যাবে। এতে ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বর্তমান বিরোধের প্রভাব সংক্ষেপে বর্ণনা করলে দাঁড়ায়: স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রপ্তানি-ভিত্তিক অর্থনীতি, বিশেষ করে আরএমজি খাতের জন্য একটি বড় হুমকি। ভারতের জন্য, এই নিষেধাজ্ঞা স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করলেও, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাণিজ্যে ব্যাঘাত এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করে। উভয় দেশই অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর ফলাফল নির্ভর করছে তারা বাণিজ্য ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য পারস্পরিক লাভ বিবেচনায় আলোচনার টেবিলে বসতে পারে কিনা তার ওপর।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর সম্পন্ন করেছেন। সফরকালে তিনি ওই দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনীতির এক নাটকীয় রূপান্তরের ইঙ্গিত দেন।
১ দিন আগেভারতের প্রস্তাবিত চার লেনের শিলং-শিলচর মহাসড়কটি এনএইচ-৬ (মেঘালয়, আসাম ও মিজোরামকে সংযোগকারী মহাসড়ক) ধরে মওলিনখুং (মেঘালয়) থেকে পঞ্চগ্রাম (আসাম) পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এটিই এই অঞ্চলের প্রথম উচ্চ-গতির করিডর প্রকল্প। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে, শিলং-শিলচর মহাসড়কটি মিয়ানমারের কালাদান...
১ দিন আগেভারত-পাকিস্তান সংকটকে দীর্ঘদিন ধরে কেবল দ্বিপক্ষীয় ইস্যু হিসেবেই দেখা হয়েছে। ঐতিহাসিক ক্ষোভ আর পারমাণবিক প্রতিরোধের (ডিটারেন্ট) মধ্যে এটিকে সীমাবদ্ধ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে, প্রতিটি সংকটই—হোক তা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা বা কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান উত্তেজনা—কিছু না কিছু ধারাবাহিক প্রভাব তৈরি করে...
১ দিন আগেতবে পাকিস্তানের দাবি নিশ্চিত হলেও এটি রাফাল বা অন্যান্য পশ্চিমা বিমানের ওপর চীনা জে-১০ সি’র শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে না। কারণ, পশ্চিমা বিমানগুলো সাধারণত আরও বিভিন্ন ধরনের মিশনে অংশ নিতে সক্ষম। তা সত্ত্বেও, বিশ্বজুড়ে সামরিক কর্মকর্তারা এই ঘটনার বিস্তারিত জানার জন্য তৎপর হয়েছেন। অনেক দেশ নিজেদের যুদ্ধ..
২ দিন আগে