Ajker Patrika

বিবিসির নিবন্ধ /ফিলিস্তিনের স্বাধীনতায় ইউরোপের স্বীকৃতি নিষ্ফল, চাবিকাঠি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ০৫
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ। ছবি: এএফপি

জাতিসংঘের মঞ্চে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্বীকৃতি শতবর্ষী ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। তবে এটি এক ধরনের কূটনৈতিক ঝুঁকিও। কারণ, বড় ইউরোপীয় শক্তিগুলো মনে করছে—সংঘাত এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের এমন নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

গাজার বর্তমান বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল ও হামাস—দুই পক্ষেরই তীব্র সমালোচনা করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। তিনি বলেছেন, ‘গায়ের জোরের ওপর নয়, ন্যায়ের জয় হতে হবে।’ তাঁর এই পদক্ষেপের সঙ্গে আছে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব। এর লক্ষ্য মূলত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে জীবিত রাখা।

ইউরোপীয় নেতারা বিশ্বাস করেন, বহু বছর ধরে আলোচিত এই আন্তর্জাতিক ফর্মুলাই দুই দেশের সমাজের জন্য ন্যায়সংগত ভবিষ্যতের একমাত্র পথ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিউইয়র্কে এক সম্মেলনে বলেছেন, যদি এই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান কার্যকর না হয়, তাহলে এর বিকল্প হবে তথাকথিত ‘এক রাষ্ট্র সমাধান’। আর এর অর্থ হবে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি আধিপত্য ও নিপীড়ন। তিনি বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই ফিলিস্তিনিদের গণহারে শাস্তি দেওয়া, অনাহার কিংবা জাতিগত নির্মূলকে ন্যায়সংগত বলা যায় না।

এতে ক্ষুব্ধ ইসরায়েল পাল্টা প্রতিক্রিয়ার হুমকি দিচ্ছে। দেশটির মতে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া আসলে হামাসকে পুরস্কৃত করার শামিল। বিশেষ করে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ইসরায়েলে হামলার পর এবং হামাসের জিম্মি ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর এটি আরও বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের মঞ্চেও একই কথা উচ্চারণ করেছেন।

কিছু ইসরায়েলি মন্ত্রী চান—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পশ্চিমাদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম তীরের কিছু অংশ নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হোক। এতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেরা আছেন। তাঁদের ঘোষিত নীতি হলো ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে সেখানে ইহুদি বসতি গড়ে তোলা। তারা চাইছে দুই রাষ্ট্র সমাধানের সব দরজা বন্ধ করে দিতে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আগের মতোই ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। তারা ইউরোপীয়দের পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে শাস্তি দিচ্ছে। এমনকি তাঁকে নিউইয়র্ক সম্মেলনে উপস্থিতও হতে দেওয়া হয়নি ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে। তিনি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বক্তব্য দেন।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিন সম্মেলন ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধান নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর বিভাজনকে সামনে এনেছে। কিন্তু ইউরোপীয়রা বলছেন, মাঠের বাস্তবতা তাঁদের সামনে আর কোনো বিকল্প রাখেনি।

ইসরায়েল গাজা শহরে তিন সেনা ডিভিশন মোতায়েন করছে। প্রতিদিন বহু ফিলিস্তিনি নিহত হচ্ছে। হামাস এখনো প্রায় ৫০ জন জিম্মিকে আটকে রেখেছে, যাদের অনেকেই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ ও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বেড়েই চলেছে।

সবকিছুই চলছে ৭ অক্টোবরের হামলার প্রায় দুই বছর পরও। অথচ এমন কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই যে, ইসরায়েলের সামরিক চাপ হামাসকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারবে। আর তাই মাখোঁর কৌশল হলো কূটনীতিকে বিকল্প সমাধান হিসেবে সামনে আনা।

প্রথমে গাজায় যুদ্ধের কার্যকর সমাপ্তি, তারপর দীর্ঘ মেয়াদে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান—ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র। ইউরোপীয় দেশগুলোর দাবি, ইসরায়েলের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এতে কেবল বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে, জিম্মিদের জীবন আরও ঝুঁকিতে পড়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সৌদি আরব নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘ সম্মেলনে এবং আরব লীগও সমর্থন জানিয়েছে। ফ্রান্স বলছে, এভাবে তারা হামাসের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে। কারণ, সম্মেলনে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশগুলো এখন হামাসকে নিরস্ত্র হতে বলেছে, অস্ত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে বলেছে। একই সঙ্গে তারা স্পষ্ট করেছে, ফিলিস্তিনি নেতৃত্বে হামাসের আর কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না।

মাখোঁ মনে করছেন, এতে ইসরায়েলের জন্যও প্রণোদনা তৈরি হবে। একই সঙ্গে, দেশটির সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দরজা খোলা থাকবে—যেটি দীর্ঘদিন ধরে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া নিঃসন্দেহে বড় কূটনৈতিক ঝুঁকি।

জাতিসংঘে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাখোঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন গাজা-সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে চাইছেন, মহাসচিব যেটিকে বলেছেন ‘দুঃস্বপ্ন।’ একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি ভবিষ্যতের যৌথ পথ খুঁজে পেতে চান।

কিন্তু বাস্তব শক্তির বিচারে তিনি সঠিক ব্যক্তি নন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব না দিলে এমন অর্থবহ চাপ তৈরি করা সম্ভব নয়, যা সব পক্ষকে বাধ্য করতে পারে। আর ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয়দের এ উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করেই চলেছে। ট্রাম্প মঙ্গলবার জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়েছেন। পরে আরব নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো আশার বাণী শোনাননি।

এই সমন্বয়ের অভাব পুরো প্রক্রিয়াকেই অকার্যকর করে তুলছে। আর আগে ইসরায়েল-হামাসের মধ্যস্থতাকারী কাতারও কোনো ভূমিকা নিতে চাইছে না। কারণ, চলতি মাসেই ইসরায়েল কাতারে হামাস নেতাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। মাখোঁ ও স্টারমার দুজনই তাদের দেশের মধ্যপ্রাচ্যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার প্রসঙ্গ টেনেছেন।

তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন থেকে সরে যাওয়ার পরই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন তাঁরা বলছেন, ফিলিস্তিনিদেরও নিজেদের রাষ্ট্রের সমান অধিকার তারা স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ফিলিস্তিনিরা ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বীকৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তারা এটাও জানে, এগুলো অতীতের পরাশক্তি, ঔপনিবেশিক শক্তি। তাদের সিদ্ধান্ত আগের মতো আর প্রভাব রাখে না।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন বাস্তবে সম্ভব তখনই, যখন বর্তমানের সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো অন্য পরিকল্পনায় আছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়েও ফখরুল–আখতাররা ভিভিআইপি সুবিধা পাননি কেন—জানাল প্রেস উইং

এক নারীকে স্ত্রী দাবি করে দুই পুরুষের টানাটানি, শেষে ৩ জনই কারাগারে

স্পিকারের বাসভবনই হবে প্রধানমন্ত্রীর অস্থায়ী আবাস

আ.লীগের ঝটিকা মিছিল: মানিকগঞ্জের প্যানেল মেয়র আরশেদ আলীসহ চারজন কারাগারে

ঘরে সদ্য বিবাহিত বিক্রয় প্রতিনিধির লাশ, চিরকুটে লেখা ‘জীবন খুবই কঠিন’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত