Ajker Patrika

রক্ষণশীলতাই বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থিতিশীলতায় বড় বাধা

গোলাম ওয়াদুদ
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১০: ৩৪
রক্ষণশীলতাই বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থিতিশীলতায় বড় বাধা

যেকোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস রপ্তানি বাণিজ্য। সমৃদ্ধ অর্থনীতির জন্য এর বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ একমত যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দেশগুলোর সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যখন কোনো সত্তা বা ব্যক্তি অন্য কোনো দেশ থেকে সস্তা পণ্য বা পরিষেবা কেনে, তখন সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক এই লেনদেনে সমৃদ্ধ হয় রপ্তানি করা দেশও। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বা বাধা। 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কী? এ প্রশ্নের উত্তরে একেকজন একেক বিষয় সামনে আনতে পারে। একেকজনের কাছে একেকটা বিষয় হুমকি মনে হতে পারে। শিপিংয়ের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তৈরি হওয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধিকে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপকেরা সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখতে পারেন। আবার অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারেন মহামারির নেতিবাচক প্রভাবের কথা। সামষ্টিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা রপ্তানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় করে দেখছেন চাহিদার পরিবর্তনকে। বিশেষত নতুন করে কোভিড মহামারির ফিরে আসাকে তাঁরা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু যারা একটু বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিশ্চিতভাবে বাণিজ্যনীতির পরিবর্তন, যেখানে বৈষম্য, দমন ও একঘরে করে ফেলার নীতিই মুখ্য হয়ে উঠছে ক্রমে। মোটাদাগে বিভিন্ন দিক থেকেই বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতি আজ সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে। 

এর সঙ্গে জুড়ে আছে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বহু বিষয়, যার সঙ্গে অভিযোজন ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক গতিপথ পাল্টে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কথাই বলা যায়। ৩৮ দেশের অর্থনৈতিক জোট ওইসিডির ভাষ্যমতে, প্রতি টনে ৭৫ ডলারের কার্বন শুল্কের কারণে গড়ে ২ শতাংশ হারে ব্যয় বাড়বে। এতে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কিন্তু যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, মহামারি পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট বাধা কিংবা অন্য দেশের অর্থনৈতিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সুবিধা নেওয়ার বিষয়, তখন এই ব্যয়ের প্রভাব অনেক বেড়ে যায়। এ অবস্থায় এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে বাণিজ্যনীতি ও এ সম্পর্কিত নানা চুক্তিতে বৈচিত্র্য আনা। 

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু দেশ, বিশেষত শক্তিশালী দেশগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এমন অনেক লক্ষ্য নিয়ে এগোয়, যার সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো সম্পর্কই নেই। ফলে অব্যবস্থাপনা বা বিশেষ স্বার্থের বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে নানা ক্ষেত্রে। কখনো কখনো এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে একটি দেশ শুধু নয়, গোটা অঞ্চলই অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়। তখন বাণিজ্যনীতিতে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। নানা ধরনের অভিযোজনের শর্ত তখন সামনে এসে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের নানা উদাহরণও সামনে আছে। যে অজুহাতেই যেকোনো দেশ অন্য এক বা একাধিক দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের নীতি নিক না কেন, তা মূলত বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পায়ে শিকল পরায়। রুদ্ধ করে প্রযুক্তি স্থানান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো। এমনকি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গবেষণা ও উন্নয়নেও। 

আবার ঠিক বিপরীত পদক্ষেপ হলেও একই ধরনের প্রভাব পড়ে এক বা একাধিক দেশে বিশেষ বাণিজ্য-সুবিধা দেওয়ার কারণে। এই বিশেষ সুবিধা নিয়েও রয়েছে নানা সংকট। সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ ও সুবিধাদাতা দেশের মধ্যে কে পণ্য সরবরাহ ব্যয় বহন করবে, তা নিয়ে বিরোধের রেওয়াজ অনেক পুরোনো। এ ক্ষেত্রে চাহিদা সরবরাহের অনুপাত নিয়েও বিরোধ দেখা যায়। ফলে যতই মুক্তবাজার ও সীমানাহীন বিশ্ব বা বিশ্বগ্রামের কথা বলা হোক না কেন, তা আসলে অনেকটা কাগজে কলমেই। বাস্তবে বাণিজ্য, অভিবাসন ইত্যাদি প্রশ্নে সীমান্ত খুব বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যমতে, ভেনেজুয়েলা ২০১৭ সালে ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করেছে এবং ৩১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তবে, ২০০৯ সালের তুলনায় রপ্তানি প্রায় অর্ধেক কমেছে। রপ্তানি কমার নানা কারণ তারা দেখিয়েছে। তার মধ্যে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়া অন্যতম। 

দেশটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। তবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাণিজ্য বিকাশের জন্য ২০১২ সালে মার্কোসুরে যোগদানের পর ভেনেজুয়েলা চুক্তির গণতান্ত্রিক ধারা লঙ্ঘনের জন্য ২০১৪ সালে বাদ পড়েছিলেন। এরপরই মূলত তাদের রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসে। শুধু ভেনেজুয়েলা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রেও এমন চিত্র। এক দেশের সঙ্গে চুক্তি করায় অন্য দেশে বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়। 

ইকোনমিস্ট বলছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছে প্রভাবশালী দেশগুলো। বিশ্বের বাণিজ্য-সংক্রান্ত নীতি প্রবর্তন এবং সদস্য রাষ্ট্র বা পক্ষগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য দূর করতে সাহায্য করার কাজ এই সংস্থার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্থাটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। 

এই যাবতীয় বিষয়কে নতুন এ সময়ে ঠিকমতো মোকাবিলা করতে না পারলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর হবে না। বহুপক্ষীয় চুক্তির বিষয়গুলো এরই মধ্যে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের যে শক্তির কথা বলা হয়েছে এত দিন, তা ক্রমেই লীন হয়ে যেতে পারে। এর ফল ভোগ করতে হবে অন্য সব দেশকে। কারণ, এই যাবতীয় বাধা আদতে সব দেশেরই আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য ব্যয় বাড়ায়।    

এই পর্যায়ে যেসব প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন
যদি বিশ্বনেতারা বাণিজ্য হতাশাবাদীদের ভুল প্রমাণ করতে চান, তাহলে তাঁদের তিনটি বড় প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে। 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা একটা সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের ধরন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে

প্রথমত, বাণিজ্য সরঞ্জামগুলো কোথায় এবং কী অর্জন করতে পারে? ইইউয়ের বাণিজ্য কমিশনার ডমব্রোভস্কিস বলেন, কখনো কখনো ‘নৌকাটিকে কিছুটা ওভারলোড করার’ প্রবণতা থাকে। তিনি বাণিজ্য চুক্তির জন্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা সেগুলো পাসের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে মধ্যে ভারসাম্যের প্রয়োজন রয়েছে বলেও সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদেরা। 

দ্বিতীয়ত, অ-বাণিজ্যিক নানা উদ্দেশ্যের কারণে যে ক্রমবর্ধমান জটিল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটে? ধরা যাক, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা কারণে চীন থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি বন্ধের যে পরামর্শ বিভিন্ন মহল থেকে আসে, তার কথা। কিন্তু এটি আরও অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে যায়। যখন ওই পণ্যটি হয় সোলার প্যানেল, তখন এই আমদানি বন্ধের কারণে ঝুঁকি বাড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা। ফলে এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে যদি প্রযুক্তি স্থানান্তরসহ নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়, তবে তা আরও অনেক বড় সংকটের উৎস হয়ে দেখা দিতে পারে। 

তৃতীয় যে প্রশ্নটি ইকোনমিস্ট উত্থাপন করেছে, তা হলো—নতুন বাণিজ্য বাধার বিষয়গুলো কীভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত? এই কাজটি বেশ কিছু বছর ডব্লিউটিও সম্পন্ন করেছে। একটি রেওয়াজ বা রীতির প্রবর্তন তারা করতে পেরেছিল, যা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও বেশ নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এর অনুপস্থিতিতে সরকারগুলোর বোঝা উচিত যে, রক্ষণশীল নীতি বরং নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল হতে পারে। 

এই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরের ওপর এখন ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধারাটি কেমন হবে, তা নির্ভর করছে। আগের কাঠামোটি অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। একেকর দেশ একেক দেশের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। পণ্য ধরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে নতুন করে একটি বাণিজ্য সম্পর্কের স্থিতিশীলতা পেতে হলে আঞ্চলিক জোটের পরিসর ডিঙিয়ে বিশ্বের দেশগুলোকে এক হয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে, এটি সেই পুরোনো দিনের সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক শাসন ও ক্ষমতাচর্চার হাতিয়ারে পরিণত হবে। 

বিষয়:

বাণিজ্য
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাইপলাইনে জ্বালানি পরিবহন: ৩৪ হাজার লিটার ঘাটতি যমুনার প্রথম পার্সেলে

১টা বাজলেই আর স্কুলে থাকে না শিক্ষার্থীরা, ফটকে তালা দিয়েও ঠেকানো গেল না

চিকিৎসক হওয়ার আগেই শীর্ষ সবার শীর্ষে

আসামে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বহাল থাকবে দুর্গাপূজা পর্যন্ত

ভিকারুননিসায় হিজাব বিতর্ক: বরখাস্ত শিক্ষককে পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত