Ajker Patrika

এআই যুগের সংকটে ভরসা দিতে পারে যে জাপানি দর্শন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩১
এই ইকিগাই এআই যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ছবি: আইএআই নিউজ
এই ইকিগাই এআই যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ছবি: আইএআই নিউজ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের জীবনের বড় একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছে। অনেকে বলছেন, এআই আমাদের চাকরি নেবে, সৃজনশীল কাজ কেড়ে নেবে, এমনকি জীবনের অর্থবোধও ধ্বংস করে দেবে। তবে জাপানের একজন বিজ্ঞানী কেন মোগি মনে করেন—এই ভয় থেকে বাঁচার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ইকিগাই দর্শনের মধ্যে।

ইকিগাই একটি জাপানি শব্দ, যার সাধারণ অনুবাদ ‘জীবনের উদ্দেশ্য’। তবে কেন মোগির ভাষ্যে, এটি একধরনের ভুল অনুবাদ। ইকিগাই মানে শুধু জীবনের লক্ষ্য নয়, বরং এমন কিছু, যা মানুষকে জীবিত থাকতে অনুপ্রাণিত করে, আনন্দ দেয়, অথচ যেটি সমাজ বা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ না-ও হতে পারে।

কেন মোগি ২০১৭ সালে ইকিগাই নিয়ে একটি বই লেখেন, যা ৩২টি ভাষায় অনূদিত হয়ে ৫৮টি দেশে প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানিতে ২০২৪ সালে আমার ইকিগাই বইটি বছরের সেরা বিক্রীত নন-ফিকশন বই হয়। ইকিগাই বলেন, ইকিগাই শব্দটিকে ভুলভাবে ‘জীবনের উদ্দেশ্য’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়, যা এর প্রকৃত তাৎপর্য নয়।

এই বইয়ের গুরুত্ব এখন আরও বেড়েছে, কারণ প্রযুক্তির জগতে মানুষের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এআই শুধু কাজ কেড়ে নিচ্ছে না, বরং মানুষের সৃষ্টিশীলতা, চিন্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে।

ইকিগাই সাধারণত সুস্থতা এবং জীবনের দীর্ঘায়ুর সঙ্গে জড়িত। জাপানে করা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় ইকিগাই এবং দীর্ঘায়ুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পাওয়া গেছে। বর্তমানে, ইকিগাইকে একটি স্বাস্থ্যবর্ধক নীতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা মূলত জাপান থেকে এসেছে, যেখানে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘায়ু সমাজ রয়েছে এবং এটি সারা বিশ্বে প্রযোজ্য।

২০২৩ সালে ‘চ্যাটজিপিটি’ বাজারে আসার পর এআই উন্নয়নের গতি দেখে মানুষ বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছে। কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) ও অতিবুদ্ধিমত্তা (এএসআই) এখন শুধু কাল্পনিক বিষয় নয়, বাস্তব গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। দ্রুত উন্নতির কারণে ইকিগাই মানবিক মূলনীতি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করতে পারে।

এক পডকাস্টে এআই গবেষক রোমান ইয়াম্পোলস্কি ইকিগাই ঝুঁকি (Ikigai Risk) নামক একটি ধারণার কথা বলেন। তাঁর মতে, এআই যদি মানুষের জীবনের অর্থবোধ বা ইকিগাই কেড়ে নেয়, তবে তা চাকরি হারানোর থেকেও ভয়াবহ হবে। কারণ, মানুষ শুধু রুটি-রুজির জন্য বাঁচে না, বাঁচে কিছু ভালোবাসার জন্য।

বর্তমানে ইন্টারনেটে ইকিগাই বোঝাতে যে ভিন্ন ডায়াগ্রামটি জনপ্রিয়, সেখানে চারটি বিষয়কে প্রধান করা হয়—‘যা তুমি ভালোবাসো’, ‘যা পৃথিবীর প্রয়োজন’, ‘যা তুমি দক্ষ’, এবং ‘যা থেকে তুমি অর্থ উপার্জন করতে পারো’। এই চার বিষয়ের মধ্যমণি হলো ইকিগাই। তবে মোগি বলেন, এটি প্রকৃত ইকিগাই নয়। ইকিগাই শুধু ‘যা তুমি ভালোবাসো’ সেটার সঙ্গে সম্পর্কিত। বাকি তিনটি—বিশ্বের চাহিদা, অর্থ বা দক্ষতা—গুরুত্বপূর্ণ নয়।

একজন মানুষ হয়তো গান গাইতে ভালোবাসেন, যদিও তাঁর গানের গলা ভালো নয়। কেউ হয়তো প্রজাপতির পেছনে দৌড়ান, যা দিয়ে কোনো অর্থ আসবে না। তবু এই কাজগুলোই তাঁর জীবনের ইকিগাই হতে পারে।

কেন মোগি বলেন, এআই দারুণভাবে অপ্টিমাইজেশনে পারদর্শী। যেমন—দাবা খেলার এআই জেতার সম্ভাবনাকে সর্বাধিক করে তুলতে শেখে। বড় ভাষা মডেলগুলো শেখে কীভাবে মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক টেক্সট তৈরি করতে হয়।

তবে মানুষের জীবন শুধু অপ্টিমাইজেশনের ওপর চলে না। অনেক সময় যা মানুষ করে, তাতে সামাজিক স্বীকৃতি নেই, তবু তা তাঁকে আনন্দ দেয়। এই আনন্দই হলো ইকিগাই। এ কারণেই ইকিগাই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

এই ইকিগাই এআই যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেমন—মানুষ হয়তো একঘেয়ে বা মনোযোগহীন কাজ এআইকে দিয়ে করবে, আর নিজের সময় ব্যয় করবে নিজের পছন্দের কাজে, যা তাঁকে মানসিক স্বস্তি ও সৃজনশীল করে তুলবে।

এআই যুগে ইকিগাই হবে সহানুভূতির রক্ষাকবচ

মোগি মনে করেন, ইকিগাই ও মানুষের ‘ফ্লো স্টেট’ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফ্লো স্টেট মানে, মানুষ যখন এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, যেখানে সময়ের হিসাব থাকে না, তখন সে সম্পূর্ণরূপে আনন্দে ডুবে যায়। এই অবস্থাই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

এআইয়ের কারণে কাজ বা সাফল্য হারালে মানুষ জীবনের মানে হারানোর ভয় পেতে পারে। তবে ইকিগাই চর্চা এই মানসিক শূন্যতা পূরণ করবে, কারণ এটি শুধু কাজ বা ফলাফলের ওপর নির্ভর করে না, বরং ব্যক্তিগত আনন্দ ও জীবনের ছোট ছোট মুহূর্ত থেকে আসে।

ইকিগাই মানুষকে বর্তমান মুহূর্তে সুখ খুঁজতে শেখায়, যা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এআই উন্নয়নের কারণে দ্রুত পরিবর্তনের মাঝে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এটি কাজে লাগবে।

ইকিগাই থেকে উৎসারিত কাজগুলোতে অন্তর্নিহিত ভালোবাসা ও গুণগত মান থাকে, যা এআইয়ের স্বয়ংক্রিয় ও মাত্রা সীমিত কাজ থেকে আলাদা। ফলে, এআই যুগেও সত্যিকারের সৃজনশীলতা ও মান রক্ষা পাবে।

এআই কি কখনো ইকিগাই বুঝবে

বর্তমানে এআই দিয়ে তৈরি ছবি, লেখা, ভিডিওর ছড়াছড়ি হলেও প্রশ্ন উঠছে—এসব সৃষ্টিতে ইকিগাই আছে কি না। জিবলি স্টুডিওর স্রষ্টার হায়াও মিয়াজাকি যখন টোটোরো (জনপ্রিয় কার্টন চরিত্র) আঁকেন, তা তিনি করেন আনন্দ থেকে, পুরস্কারের আশায় নয়। সেই ইকিগাই থেকে সৃষ্ট কাজ দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। তবে এআই কি কখনো সেই অনুভূতি তৈরি করতে পারবে!

মোগির মতে, ভবিষ্যতে হয়তো ‘কৃত্রিম ইকিগাই’ নামের কোনো ধারণা আসতে পারে, যা কাজুজো ইশিগুরোর উপন্যাস ‘ক্লারা অ্যান্ড দ্য সান’ এ আভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে আপাতত ইকিগাই একটি মানবিক অভিজ্ঞতা এবং এটিই আমাদের এআই যুগেও মানবিক গুণ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।

তথ্যসূত্র: আইএআই নিউজ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২০৫০ সাল নাগাদ ইনফ্লুয়েন্সারদের চেহারা কেমন হবে, ধারণা দিলেন গবেষকেরা

প্রিজন ভ্যান থামিয়ে ছাগল-কাণ্ডের মতিউরকে অনৈতিক সুবিধা, ১১ পুলিশ সদস্য বরখাস্ত

দেশে প্রথমবারের মতো চালু হলো ভয়েস ওভার ওয়াই-ফাই, সুবিধা কী

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যাচ্ছেন না মোদি, কী বার্তা দিচ্ছে দিল্লি

মেডিকেল কলেজ: মানের ঘাটতিতে হবে বন্ধ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত