Ajker Patrika

বাংলাদেশ কি প্রতিবাদ জানাবে না

আবু তাহের খান 
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ০৩
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা  মো. তৌহিদ হোসেন  ভিন্নমত পোষণ করেছেন ইসহাক দারের বক্তব্যের। ছবি: আজকের পত্রিকা
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভিন্নমত পোষণ করেছেন ইসহাক দারের বক্তব্যের। ছবি: আজকের পত্রিকা

পাকিস্তানের দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ক্যাচলাইন’-এর গত ১৬ আগস্ট সংখ্যায় ‘ইস্ট পাকিস্তান মাস্ট রিটার্ন: পাকিস্তানস আওয়ার অব রেকনিং আফটার ফিফটি ফোর ইয়ারস’ নামে তাবাসসুম মোয়াজ্জেম খানের লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানি পত্রিকায় এরূপ ঔদ্ধত্যপূর্ণ মতামতসংবলিত নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে প্রতিবাদমূলক লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা যায়, পাকিস্তানি পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের অনভিপ্রেত মতামত এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভমিশ্রিত প্রতিবাদ ও লেখালেখি দুই-ই ইতিমধ্যে সরকারের চোখে পড়েছে। তবে ওই সংবাদ প্রকাশের পর ইতিমধ্যে প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া কী, তা এখনো জানা যায়নি। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম, এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজনের মুখ থেকেও প্রায়ই এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার তাঁর সাম্প্রতিক (২৩-২৪ আগস্ট, ২০২৫) বাংলাদেশ সফরকালে দুটি খুবই আপত্তিকর কথা বলেছেন। এক. তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয়গুলো এরই মধ্যে দুই-দুইবার মীমাংসা হয়ে গেছে—একবার ১৯৭৪ সালে ও আরেকবার ২০০০ সালে (বোঝাতে চেয়েছেন ২০০২ সালে)। তাঁর এ বক্তব্য শুধু অসত্যই নয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে বিভ্রান্তি সৃষ্টিরও শামিল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর দুই দেশের মধ্যকার নানা অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল চারটি। এগুলো হচ্ছে: হত্যা-ধর্ষণসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার; পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদ বাংলাদেশকে ফেরত দান; আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের সে দেশে প্রত্যাবর্তন এবং ১৯৭১-এর কৃত অপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা। পুরো পৃথিবী সাক্ষী, উল্লিখিত বিষয়গুলোর কোনোটিরই আজ পর্যন্ত কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে, ইতিমধ্যে দুই দফায় বিষয়গুলোর মীমাংসা হয়ে গেছে মর্মে বক্তব্যদানের মাধ্যমে ইসহাক দার বস্তুত পাকিস্তানের ঐতিহ্যিক স্বভাবেরই পুনরাবৃত্তি করলেন মাত্র।

দুই.

অনেকটা শাসানোর ভঙ্গিতে ইসহাক দার বাংলাদেশের জনগণকে তাদের দিল পরিষ্কার করতে বলেছেন, যে ধরনের ভঙ্গিমা ইদানীং বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীকে ক্ষণে ক্ষণে মব সৃষ্টির সময় করতে দেখা যায়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব, ২৩ বছরের (১৯৪৭-৭০) শোষণ ও ৯ মাসের (১৯৭১) গণহত্যার জন্য দীর্ঘ ৫৪ বছরেও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে না পারার কারণে মন তো সর্বাগ্রে আপনাদের পরিষ্কার করা উচিত। নইলে কোন মুখে আপনারা বাংলাদেশের মানুষের বন্ধুত্ব চাইবেন? একটি দেশের জনগণের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব সে দেশের বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরাজমান সুসম্পর্ক দিয়ে হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম সৌজন্য ও শিষ্টাচার রক্ষা করে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসংবলিত কূটনীতি। কিন্তু বাংলাদেশে এসে আপনি যে ধরনের মনগড়া তথ্য দিলেন ও যে ভাষায় মন পরিষ্কারের কথা বললেন, তাতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা কি একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখেছেন? না, দেখেননি এবং তা দেখেননি আপনার পূর্বসূরিরাও। আর জনগণের মন ও অনুভূতি এবং সেই সঙ্গে প্রকৃত বাস্তব অবস্থা আঁচ করতে পারেননি বলেই আপনার পূর্বসূরি জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে নাকচ হয়ে গেলে ভব্যতার সব সীমা লঙ্ঘন করে ওই অধিবেশনকক্ষে বসেই প্রস্তাবনা-দলিলটি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।

সে যাই হোক, পাকিস্তানি পত্রিকা ক্যাচলাইনে ‘গবেষক’ তাবাসসুম মোয়াজ্জেম খান তাঁর উল্লিখিত নিবন্ধে বাংলাদেশের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার যে অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছেন, সেটি ইদানীং বাংলাদেশের একটি মহলও দেখতে শুরু করেছে। ফলে তাবাসসুম মোয়াজ্জেম খান তাদের প্রতিনিধি হয়ে ওই নিবন্ধ লিখেছেন, নাকি পাকিস্তান তাঁকে দিয়ে এটি লিখিয়েছে, নাকি এর সঙ্গে আরও আন্তর্জাতিক কোনো শক্তি জড়িত—আমরা সেসবের কিছুই জানি না। তবে পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাম্প্রতিক সময়কার ধারাবাহিক বাংলাদেশ সফর, ইসহাক দারের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং বাংলাদেশের নবোত্থিত মহলের পাকিস্তানপ্রীতিমূলক আচরণের মধ্যে একধরনের সাযুজ্য খুবই চোখে পড়ছে। অবশ্য সে সাযুজ্যকে আমরা সাধারণ মানুষ যতই একধরনের অবাস্তব চিন্তাভাবনা বলে উড়িয়ে দিই না কেন, এর পেছনে নিশ্চয় তাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা রয়েছে। এবং আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তাদের সে অপ্রকাশিত লক্ষ্য ও পরিকল্পনাই এখন বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ যে, ইসহাক দারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেই তিনি দারের বক্তব্যের ভিন্নমত পোষণ করেছেন এবং পরে তিনি সেটি জনসমক্ষেও বলেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার জনগণের স্বার্থ ও আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রয়োজনে এ ধরনের ভিন্নমত প্রকাশের কোনো বিকল্প নেই। আর সেই সূত্রে জিজ্ঞাসা করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া ক্যাচলাইনের ওই নিবন্ধের বিষয়ে সরকার কি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাবে, নাকি এ বিষয়ে নীরব ভূমিকাই পালন করে যাবে? এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিনীত প্রস্তাব: সরকার পরিচালনায় রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিষয়টি স্থায়ী ও দীর্ঘকালীন। ফলে অস্থায়ী কারও কথায় বা চাপে যেন রাষ্ট্র ও জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ বিপন্ন না হয়, তজ্জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যেতে হবে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয়াদি এখনো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে, যেগুলোর মধ্যে চারটি বিষয়ের কথা প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর নিষ্পত্তির জন্য অবিলম্বে জোর তৎপরতা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানকে এটিও মনে করিয়ে দিতে হবে যে, পাকিস্তান যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্ক চায়, তাহলে যেকোনো ধরনের ধূর্ত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও আচরণ পরিত্যাগ করে তাদেরকে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যে তাদের প্রথমতম কর্তব্য হবে একাত্তরের গণহত্যার জন্য আন্তরিক মনস্তাপ নিয়ে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তদুপরি ক্যাচলাইনে প্রকাশিত প্রবন্ধের মতো আপত্তিকর বক্তব্যসংবলিত প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েও অবিলম্বে পাকিস্তানের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠাতে হবে। নইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরকার একটি মহলের মধ্যে অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতি থাকার যে অভিযোগ রয়েছে, সেটিকে ঘিরে জনমনে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি দুই-ই আরও বাড়বে।

পরিশেষে শুধু এটুকু বলি, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে এ দেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছিল বলেই তাদের সঙ্গে আমরা পুরোনো বৈরিতা টিকিয়ে রাখতে চাই না। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে অন্য সবার মতো তাদের সঙ্গেও আমরা সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক নিয়ে বসবাস করতে চাই। কিন্তু পাকিস্তানকেও মনে রাখতে হবে, শোষণ ও গণহত্যার ক্ষত অত সহজে শুকায় না। তার ওপর ইসহাক দারের মতো দায়িত্বশীল পর্যায়ের মানুষেরা যদি সে ক্ষতের ওপর আবার লবণের প্রলেপ ঢালেন, তাহলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে নাকি?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত