Ajker Patrika

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি

মেডিকেল কলেজ: মানের ঘাটতিতে হবে বন্ধ

  • শিক্ষকের সংখ্যাসহ শর্ত মানছে না অনেক কলেজ।
  • শঙ্কার মধ্যে আছে ২০ টির মতো।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ১৭
মেডিকেল কলেজ: মানের ঘাটতিতে হবে বন্ধ

গত দুই দশকে দেশে ৭০টির বেশি সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এসব কলেজের অধিকাংশই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান পুরোপুরি বজায় রাখতে পারছে না। এ নিয়ে শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। এমন প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলোর যথাযথ মান নিশ্চিত করতে সরকার নতুন মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। চলতি মাসেই মূল্যায়নের ফল প্রকাশ করার পর ২০টির কাছাকাছি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।

চিকিৎসা শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর হাজার হাজার চিকিৎসক তৈরি হলেও সার্বিকভাবে চিকিৎসাসেবার মানের তেমন উন্নয়ন হচ্ছে না। শিক্ষার মান নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। তাঁরা শিক্ষার মান ও প্রশিক্ষণ উন্নয়নের জন্য বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।

স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ ও স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের মেডিকেল কলেজের গ্রহণযোগ্য মান নিশ্চিত করতে একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি (ম্যাট্রিকস) স্থির করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী এবং এ পদ্ধতির মাধ্যমে কলেজগুলোর মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা, নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা না থাকা, শিক্ষায়তন ও হাসপাতালের অবকাঠামো, ব্যাংক হিসাব, শিক্ষার্থী অনুপাতে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, রোগী ভর্তির হার, গবেষণা কার্যক্রম ইত্যাদির ওপর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই আগামী শিক্ষাবর্ষে কলেজগুলোর ভর্তির আসন অনুমোদন দেওয়া হবে।

প্রতি শিক্ষাবর্ষে আসন অনুমোদনের জন্য বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোকে নির্দিষ্ট চেকলিস্ট অনুযায়ী পরিদর্শন করা হয়। সেই পরিদর্শন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় আসনের অনুমোদন দেয়। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন ম্যাট্রিকসের মাধ্যমে কলেজগুলোর সার্বিক মান আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। প্রসঙ্গত, ম্যাট্রিকস হচ্ছে, কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা বা মান মূল্যায়নের একটি কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি। এতে প্রতিটি মানদণ্ডের জন্য নম্বর নির্ধারণ করা হয়। সব ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে মোট স্কোর পাওয়া যায়। মোট স্কোর থেকে বোঝা যাবে কোন প্রতিষ্ঠান কতটা মানসম্পন্ন। আগামীতে এর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমানো বা বাড়ানো হবে এবং কিছু কলেজ বন্ধও করা হতে পারে।

ছবি: আজকের পত্রিকা
ছবি: আজকের পত্রিকা

সংখ্যা ও মানে মেডিকেল শিক্ষা

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০৪টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি এবং ৬৭টি বেসরকারি। শুধু ২০০৫ সালের পর থেকেই ২৪টি সরকারি এবং ৪৫টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। এর বাইরে দেশে একটি সরকারি ডেন্টাল কলেজ চালু আছে এবং আরও দুটি কলেজের অনুমোদন রয়েছে। বেসরকারি ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা ১২টি। আটটি সরকারি এবং ১৫টি বেসরকারি মেডিকেলে ডেন্টাল ইউনিটও আছে। সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য স্বতন্ত্র কোনো আইন নেই। তবে ২০২২ সালে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন কার্যকর করেছে সরকার। ২০২২ সালের আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০১১’ (সংশোধিত) অনুযায়ী চলতে হতো। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ বেসরকারি কলেজে নানা ধরনের ঘাটতি রয়েছে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের শুরুতে ৬টি বেসরকারি কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন বাতিল করা হয়। এর মধ্যে দুটি কলেজের নিবন্ধনও বাতিল করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বেসরকারি কলেজের জন্য নিজস্ব জমি, আলাদা কলেজ ও হাসপাতাল ভবন থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনে কলেজ ও হাসপাতালের ফ্লোর স্পেস, মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক, হাসপাতালের শয্যা, রোগী ভর্তির হারসহ বিভিন্ন অপরিহার্য শর্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা কলেজগুলো অবকাঠামোগত শর্ত পূরণ করছে না। তাদের শিক্ষকের অভাব রয়েছে, নির্ধারিত শিক্ষাক্রম যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না এবং হাসপাতাল প্রয়োজনীয় শর্ত না মেনে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজই শর্ত পূরণে ব্যর্থ।

সরকারি কলেজও সমস্যামুক্ত নয়

বিদ্যমান ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। এখন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকসহ মোট পদের ৪৩ শতাংশ শূন্য। স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সরকারি কলেজগুলোর অনুমোদিত ৬ হাজার ৩৮৪টি পদের মধ্যে ২ হাজার ৭২৫টি খালি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি (৬৪ শতাংশ) অধ্যাপক পদে। নতুন প্রতিষ্ঠিত এবং বড় শহরের বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকসংকট সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অবকাঠামো, শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ সুবিধার ঘাটতির মধ্যেও ২০২৪ সালে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানে আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে।

যেসব মেডিকেল কলেজ কম নম্বর পাবে , তাদের শিক্ষার্থী ভর্তি কমিয়ে দেওয়া হবে এবং নতুন ভর্তি বন্ধ হতে পারে । অধ্যাপক সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো, জনবল ও হাসপাতাল না থাকার কারণে দেশের সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এসব কলেজে স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই, ক্লাস হয় সদর হাসপাতাল বা ভাড়া ভবনে। তাদের যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক ও মানসম্মত ল্যাবেরও অভাব রয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতায় মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

ম্যাট্রিকস দিয়ে যেভাবে মূল্যায়ন

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কলেজগুলোর কাছে আমরা আইন ও বিধি অনুযায়ী কী কী চাই এবং তাদের কী কী আছে, ঘাটতি কিসে তার একটা গাণিতিক প্রকাশ হচ্ছে ম্যাট্রিকস। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য জমি, শিক্ষক অনুপাত, অবকাঠামো, ক্লাসরুম, শিক্ষা, গবেষণা ইত্যাদির ওপর স্কোরিং করা হবে। এখন একটা চেকলিস্টের আলোকে কলেজগুলো ভিজিট করা হয়। ম্যাট্রিকসে সব শর্তের জন্য নির্দিষ্ট নম্বর থাকবে।’

অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন আরও বলেন, কলেজগুলোর মানের পার্থক্য কতখানি তা বোঝা যাবে কোনটি কত নম্বর পায়, তা দেখে। ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই ম্যাট্রিকসের আলোকে মূল্যায়ন করা হবে। এ মাসেই কাজ শেষ হতে পারে। সাধারণত অক্টোবরে মেডিকেলে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

মূল্যায়নের পর কোনো কলেজ বন্ধ হওয়ার বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কোনো কলেজ বন্ধ হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় পরে নেবে। মানসম্মত চিকিৎসক তৈরির বিষয়টি আমাদের অঙ্গীকার। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

চিকিৎসা শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা যেসব দেশের চিকিৎসা শিক্ষার মান ভালো, সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবস্থার পার্থক্য তুলে ধরে একটি গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এ থেকেই বোঝা যাবে দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা।

চিকিৎসা শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আজকের পত্রিকার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ম্যাট্রিকস চালু করা একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এটি কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঠিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ কলেজকে শুধু সতর্কীকরণ নোটিশ দিলে চলবে না। কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থাটি যথাযথভাবে মনিটর এবং প্রয়োজনমতো সংস্কার করতে হবে। গত কয়েক দশকে চিকিৎসা শিক্ষার মান ঠিক রাখার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর আগ্রহ দেখা যায়নি। দেশের বহু সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান গ্রহণযোগ্য নয়।’

বহু বছর আগে ডিগ্রি নেওয়া জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদেরও পেশা-সংক্রান্ত জ্ঞানে হালনাগাদ থাকার ওপর জোর দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চিকিৎসা শিক্ষাজীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এটি ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত রাখতে হবে।’

সরকার যেভাবে ব্যবস্থা নেবে

গত ২৮ আগস্ট অবসরোত্তর ছুটিতে যান স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী। তাঁর সময়েই মেডিকেল কলেজ মূল্যায়নের জন্য ম্যাট্রিকস চূড়ান্ত করা হয়। এ বিষয়ে তিনি ২৯ আগস্ট আজকের পত্রিকাকে বলেন, মেডিকেল কলেজ বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। ম্যাট্রিকসের ভিত্তিতে কলেজগুলোর মূল্যায়ন করা হবে। যেসব কলেজ খুব কম নম্বর পাবে, তাদের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘যেসব মেডিকেল কলেজ কম নম্বর পাবে, তাদের শিক্ষার্থী ভর্তি কমিয়ে দেওয়া হবে এবং নতুন ভর্তি বন্ধ হতে পারে। বড় ঘাটতি থাকলে কলেজ বন্ধও করা হতে পারে। এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট কমিটি। স্বচ্ছতার জন্য ম্যাট্রিকসের ফল সবার জন্য প্রকাশ করা হবে।’

সরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য বর্তমানে কোনো আইন না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন বিষয়ে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আইন তৈরি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে একাডেমিক কার্যক্রমের জন্য সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য যেসব শর্ত অভিন্ন, সেগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও বিবেচনায় আসবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২০৫০ সাল নাগাদ ইনফ্লুয়েন্সারদের চেহারা কেমন হবে, ধারণা দিলেন গবেষকেরা

২৪ ঘণ্টার মধ্যে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও গণঅধিকারকে নিষিদ্ধ করতে হবে: শামীম পাটোয়ারী

গোয়ালন্দে পিরের আস্তানায় হামলায় ১ জন নিহত, আশঙ্কাজনক ৫

ভূমিকম্পে হতাহত নারীদের উদ্ধার করেনি তালেবান কর্মীরা

দেশে প্রথমবারের মতো চালু হলো ভয়েস ওভার ওয়াই-ফাই, সুবিধা কী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত