Ajker Patrika

অপ্রিয় কথামালা

অরুণাভ পোদ্দার
আপডেট : ১৬ জুন ২০২১, ১০: ২১
অপ্রিয় কথামালা

নারী ইউএনও কোনো মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম শয়ানে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে পারবেন না—এ রকম একটা সুপারিশ আমাদের জাতীয় সংসদের সর্বোচ্চ কমিটি থেকে এসেছে। এতদিন ধরে চলে আসা রাষ্ট্রীয় বিধান পরিবর্তনের জন্য হেফাজত বা কোনো ইসলামি দল কোনো দাবি বা কর্মসূচি দেয়নি। কোথাও কোনো জ্বালাও-পোড়াও করেনি। সংসদীয় কমিটি নিজ উদ্যোগেই আগ বাড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিটির সভাপতি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এককালের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নেতা শাজাহান খান এমপি, আরও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর বিক্রম) প্রমুখ। যদি ধর্মের কথাই শেষ কথা হয়, তবে বলার কিছু নেই। কিন্তু যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিরোধী দল ও সংসদের স্পিকার একজন নারী, সেখানে কীভাবে এ ধরনের প্রস্তাব সুপারিশ করা হয়? হয় আপনারা ধর্মের কথা পুরোপুরি মেনে চলুন; বলুন, এখন থেকে কোনো ধরনের নারী নেতৃত্ব মেনে নেবেন না বা উচ্চপর্যায়ে কোনো নারী চাকরি করতে পারবেন না। এর মাঝামাঝি কোনো হ্যাঁ...না...কিন্তু থাকতে পারে না।

রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনলে এর ফল পেতেই হবে। শুধু রাজনীতি নয়, একবিংশ শতকে এসে জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে টেনে আনলে এ ধরনের বিপর্যয় বারেবারে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, ’৭১-এ দেশটা স্বাধীন হয়েছিল সব নাগরিকের সমান অধিকার রক্ষার্থে। ’৭২ সালের সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে সবার সমানাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। কোনো মানুষের জানাজা আর রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন এক জিনিস নয়। উদাহরণ হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষাশহীদদের কিন্তু আমরা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি, সেখানে গুটি কয়েক জামায়াতি বাদে কেউ কিন্তু বলে না, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া বেদাতি কাজ। কেউ সেখানে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তা-ও দাবি করে না। যেসব চাটুকার দিনরাত তাদের নেত্রীদের ছবি-পোস্টার লাগিয়ে শহর নোংরা করেন, তারা কি এখন একটা বড়সড় না হোক, ছোটখাটো প্রতিবাদ করবেন? না, সেই আশা করি না।

বিগত মার্চে হেফাজতের তাণ্ডবের পর সরকার যখন কঠোর অবস্থানে, ঠিক তখনই সরকারের ভেতরের একটি অংশ সুকৌশলে অযাচিতভাবে এই বিতর্ক সামনে নিয়ে এসে হেফাজতের মরা গাছের গোড়ায় জল ঢাললেন। ঠিক যেমন ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সেই ঐতিহাসিক কান ধরার মাধ্যমে হেফাজত শেষ হয়ে যেতে পারত; কিন্তু তখনো দলের একটি অংশ ভুল বুঝিয়ে তাদের সঙ্গে আপস করাল। তারপর আমরা দেখেছি, একে একে হেফাজতের অযৌক্তিক দাবি মেনে প্রথমে পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার, সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্য অপসারণ মেনে নেওয়া হলো। ক্রমে মামুনুলরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর ভাস্কর্যই ভেঙে ফেলার আস্পর্ধা দেখাল।

যদি এগুলো বিশ্লেষণ করি, তবে কী দাঁড়াল! হেফাজতের মূল অন্য জায়গায় না খুঁজে নিজ দলে খোঁজা উচিত নয় কি? কারণ হেফাজত ক্রমে আমাদের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। হেফাজত ও জাকির নায়েকের আদর্শ আজ জামায়াতি, বামাতি, অতিবিপ্লবী, বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের এমনকি তথাকথিত প্রগতিশীলদের মধ্যেও। কট্টর ওয়াহাবি চিন্তাচেতনা আমাদের ধমনীতে ছড়িয়ে পড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খোদ সৌদি সরকারই এখন কট্টর ওয়াহাবি মতবাদ থেকে ক্রমে সরে আসতে চাইছে। আজই দেখলাম এতদিনের প্রাচীন প্রথা ভেঙে নারীরা অভিভাবক ছাড়াও (মাহরাম) এ বছর থেকে পবিত্র হজে যেতে পারবেন, সেখানে আমরা মেয়েদের ওপর আরও বেশি বেশি ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপ করছি। তাই এখন আর গুটি কয়েক হেফাজতিকে জেলে ঢুকিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা রোখা যাবে না।

অনুসন্ধিৎসু মন একটা জিনিস জানতে চায়, ধরুন, কোনো জেলা বা উপজেলার প্রধান নির্বাহী যদি অমুসলিম হন, তবে কি তিনি পুরুষ হলেও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে পারবেন? যদি নারী কর্মকর্তা না পারেন, তবে বিধর্মী, কাফের কর্মকর্তা কীভাবে পারবেন? সংসদীয় কমিটিকে এ ব্যাপারে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। কারণ, আমরা চাই, জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় কঠোর বিধানের যেন ব্যত্যয় না ঘটে।

লেখক ∶ চিকিৎসক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত