Ajker Patrika

আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়ের কারণ

মিশেল গোইয়া
আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়ের কারণ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’ ঘোষণা করে মার্কিনরা আফগানিস্তানে যে অভিযান চালিয়েছিল, তার শেষটা হলো ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সাইগনে আমেরিকান দূতাবাসের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে পলায়নের মতো।

আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল ন্যায়যুদ্ধ এবং এখনো সেটা সে রকমই আছে। আল-কায়েদার কারণেই আফগানিস্তানে এ রকম বিপর্যয়কর অবস্থার সূচনা হয়েছিল। সামরিক শক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত বিভিন্ন কারণে নেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে শত্রু, জনমত, মিত্র বা কোনো নির্দিষ্ট দেশও এই শক্তি ব্যবহারের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সামরিক অভিযানের একটা বড় সমস্যা হলো, প্রায়ই এ অভিযানে শত্রুরা অগ্রাধিকার পায় না।

অগ্রাধিকার পায় অন্য কিছু। আমেরিকার আদি-পাপ ছিল আফগানিস্তানে চালানো অভিযানে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা পুঁজি করে অতিরিক্ত আবেগের ব্যবহার। তারা স্থানীয় বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করেছিল।

মূলত তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে কেউই যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করেনি। বিভিন্ন কারণে তালেবানকে অপছন্দ করা যেতে পারে; কিন্তু তারা আফগানিস্তানের বাইরে কোনো ধরনের হুমকি হয়ে ওঠেনি কখনো।

তালেবানের সশস্ত্র ছাতা ছিল পাকিস্তান, যারা কখনোই এমন কোনো নিকট প্রতিবেশী চাইবে না, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক হবে শত্রুভাবাপন্ন, অর্থাৎ সে দেশটি ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুক–তা সে চাইবে না।

কৌশলগতভাবে আফগানিস্তান নিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনাটি পরাজিত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মোল্লা ওমরকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। মার্কিন প্রশাসন তাদের জনমতকে আরও বড় সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেছিল এবং আমেরিকার জেনারেলরা এই পথটি ছাড়া ভিন্ন আর কোনো পথের কথা ভেবেও দেখেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, খুব অল্প ক্ষতির বিনিময়ে শত্রুর পতন ঘটাবেন। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, সেভাবে ঘটনাগুলো ঘটেনি।

মনে করা হচ্ছিল, আফগান সীমানার মধ্যে তালেবান শত্রুদের পুরোপুরি ধ্বংস করার মাধ্যমে সামগ্রিক বিজয় লাভ করা যাবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ২০০১ সালে খুব কম ক্ষতির বিনিময়ে মার্কিনরা বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছিল। আফগানিস্তানের মূল কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিল তালেবানকে। কিন্তু আসলে সেটাকে সাফল্য বলা ঠিক হবে না। কারণ, ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর এবং তাঁদের অনুসারীরা সে সময় পাকিস্তান সীমান্তের আশপাশে জায়গা করে নিয়েছিল। এর পর থেকে এই যুদ্ধটা হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি জটিল। কারণ, চাইলেও তখন পাকিস্তানে হামলা চালানো যাচ্ছিল না। যুদ্ধ হচ্ছিল সীমানার কাছাকাছি জায়গাগুলোয়, যেখানে মার্কিনদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আর সে সময় মার্কিনরা তাঁদের পরিকল্পনার জায়গায় আফগানিস্তানের চেয়ে ইরাক সংকটকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে দিয়েছিল। এবং এরই ফাঁকে পাকিস্তানের সহায়তায় তালেবানরা তাদের হারানো শক্তি ফিরে পেতে শুরু করেছিল, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করে জোটবদ্ধ হতে শুরু করেছিল, পশতুন প্রদেশের গ্রামাঞ্চলগুলোয় তারা ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল এবং আল-কায়েদা মরিয়া হয়ে তাদের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছিল।

আফগানিস্তানের ব্যাপারে ফ্রান্সের কোনো কৌশলগত অবস্থান ছিল না। নাইন-ইলেভেনের পর তারা মার্কিন দেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কারণেই আফগানিস্তানের মিত্রবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিষয়ে বুক টান করে দাঁড়ানোর একটা ইচ্ছে থেকেই তারা তা করেছিল। তারা যে বিশ্বের পরাশক্তি, সেটাও প্রমাণ করতে চেয়েছিল ফ্রান্স।

আমেরিকানরা উত্তর আফগানিস্তানের কয়েকটি দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছিল। বনে অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছিল, 
তাদের অনেকেই পরে বিদ্রোহীর কাতারে নাম লিখিয়েছিল। বিদেশি শক্তির ধামাধরা আফগান সরকার যখন নিজেদের দেশের জন্য তেমন কিছুই করে উঠতে পারছিল না, তখন স্বভাবতই এই প্রভাবশালী নেতারা নিজেদের এই আলোচনা থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

আমেরিকান ধাঁচের সংবিধান গ্রহণের কারণে সরকারের ক্ষমতা আরও দৃঢ় হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু হামিদ কারজাই হয়ে উঠেছিলেন ব্যর্থতার প্রতিমূর্তি। যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরা পশতুন প্রদেশে জনপ্রিয় ছিলেন না এবং ক্ষমতায় আসার খুব কাছাকাছি সময়ে তাঁরা সবাই দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গিয়েছিলেন। শুরু থেকেই তাঁদের যে দুর্বলতাগুলো ছিল, সেগুলো তাঁরা কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁরা এই সদ্য গণতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক ভাবনার হাইব্রিড ব্যবস্থাকে সমর্থন করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি।

আফগান সরকারকে ঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একটা সেনাবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। আফগান সরকার যেন পুরো অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সে লক্ষ্যে আইএসকেএফ বা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়তা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনী এতে অংশ নিতে চায়নি।

ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোর্স আফগানিস্তানের ফিল্ড কমান্ডারদের কাছে খুব পছন্দের ছিল না। এই বিদেশি মিত্রবাহিনী নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি উৎসাহী ছিল না। কাবুলে তাদের সংখ্যা ছিল ৪০০০-এর মতো।

অন্যদিকে আফগানিস্তানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের নহর বয়ে যায়। পারস্য উপসাগরের ব্যাংকগুলোয় টাকার পাহাড় জমে ওঠে। সাম্রাজ্যের কবরস্থানে বেড়ে উঠছিল ভ্যাম্পায়ারের স্বর্গ। জঙ্গিরা এ সময় আফিমের ব্যবসা করে লাভবান হতে থাকে। যারা সরকার কায়েম করেছিল বা সরকারে ছিল, তাদের চেয়ে এই তালেবান ছিল কম দুর্নীতিপরায়ণ, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি অস্ত্রের দিক থেকে বিবেচনা করলেও দেখা যাবে, তালেবান ছিল আফগান সরকারের তুলনায় বেশি সৎ এবং পশতুন ঐতিহ্যের কাছাকাছি।

এই অবস্থার কারণেই নারকীয় প্রক্রিয়াটি বহাল থাকতে পেরেছে। আইএসকেএফ যত দিনে তালেবান প্রতিরোধ করতে গেছে, তত দিনে তালেবান তাদের কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারণ করতে পেরেছে এবং দেশের বেশির ভাগ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে। তালেবান প্রতিরোধের জন্য যে বিশাল সেনাবাহিনী এবং জাতীয় পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল, তা-ও হয়ে থাকল একটি ভঙ্গুর কাঠামোর দৃষ্টান্ত। কৃত্রিমভাবেই তা তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

ওবামার শাসনামলে মার্কিনরা এক লাখ সৈন্য সমাবেশ হয়তো করতে পারত; কিন্তু তাতে বিজয় লাভের সম্ভাবনা ছিল কম। শুধু আকস্মিক ঘটনার ওপর নির্ভর করা ছাড়া বিজয়ের স্বপ্ন দেখা সম্ভব হতো না আফগানিস্তানে। ২০০২ সাল থেকেই বিজয়ের বিষয়টি প্রশ্নবোধক হয়ে উঠেছিল। ২০০৬ সাল থেকে শুধু অলৌকিক কিছু ঘটার ওপরই নির্ভর করতে হতো। সেই অলৌকিক ঘটনা আর ঘটেনি।

আফগান শাসন শুধু কোটি কোটি ডলার এবং আমেরিকার বিশেষ বাহিনীর সাহায্যে টিকে ছিল। এই সমর্থন উঠিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ভেঙে চুরমার 
হয়ে গেল।

মার্কিনরা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র উপহার দিতে আসেনি, তারা এসেছিল ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনের সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করতে। কিন্তু তারা ফিরে গেল শূন্য হাতে।

(ফরাসি পত্রিকা ‘লা ফিগারো’তে ১৮-০৮-২০২১ তারিখে প্রকাশিত)
 
লেখক: ফরাসি ইতিহাসবিদ ও সামরিক বিশেষজ্ঞ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডাকসুতে শিবিরের জয়ে উদ্বেগ শশী থারুরের, জবাব দিলেন মেঘমল্লার

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

‘ম্যামের মুখটা দেখলাম, মনে হলো—শুয়ে আছেন, কিছুই হয়নি তাঁর’

তিন ভোটে দায়িত্ব পালনকারীদের ‘যথাসম্ভব’ দূরে রাখতে হবে

৪ বিষয়ে সুরাহা চেয়ে ডাকসুর চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগ দিলেন ৯ পোলিং এজেন্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত