জাহীদ রেজা নূর
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। অনেকের কাছে এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের ওপর আস্থা রেখেছেন। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল এবং নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় সারা রাত বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নানা অভিযোগ এসেছে নানা দিক থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দিক থেকে অনেক অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে, এই নির্বাচনের ফলাফল খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। আর এর কয়েকটি কারণের মধ্যে প্রধানতম হলো, ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় গুপ্তভাবে ক্যাম্পাসে থাকতে পেরেছে এবং হলগুলোতে তারা পরিচিত মুখ। অন্যদিকে যে দলটি ভেবে বসেছিল, ডাকসুতে তারা দোর্দণ্ড দাপটের সঙ্গে জিতে যাবে, সেই ছাত্রদলের প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে খুব পরিচিত মুখ নন। চাইলেই তাঁরা শিক্ষার্থীদের মন জয় করে নিতে পারেন না।
জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন চোরা স্রোত ডাকসু নির্বাচনকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়, আন্দোলনটিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলা হলেও মূলত তা পরিচালনা করা হয়েছে সূক্ষ্মভাবে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দাবি করে পরে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নিজেদের দলকে বড় করে দেখার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই আন্দোলনে ছাত্রদল, শিবির, বামপন্থী ছাত্রদের বিভিন্ন দলসহ বহু ছাত্রসংগঠনই যুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে কারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন ছিল, সেটা এখন খুঁজে বের করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি ছাত্রসংগঠন যে সেই আন্দোলনের সময় গোপনে কাজ করে গেছে, সেটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে যেসব পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান একটি হলো, ক্যাম্পাস হবে সবার। সেখানে কোনো অত্যাচার চলবে না। গেস্টরুম, গণরুম ইত্যাদির নামে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল, তার অবসান দরকার। এই দাবিটি কোন ছাত্রসংগঠন ঠিকভাবে পূরণ করতে পারবে, তা নিয়ে সম্ভবত শিক্ষার্থীরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তারই প্রকাশ দেখা গেছে নির্বাচনে।
স্মৃতি প্রতারিত না করলে অনেকেই এক বছর আগের এই সময়টির কথা মনে করতে পারবেন। সে সময় মনে হচ্ছিল, বিএনপির ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপি যেভাবে লুটপাট আর দখলদারির রাজনীতি করেছে, তাতে বিস্মিত হয়েছে সাধারণ জনগণ। তাদের মনে হতে পারে, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের রাজনীতিই কি ফিরে আসবে? রাজনীতির মাঠে ক্ষমতা ছাড়াই বিএনপি যে দাপট দেখাচ্ছে, তার প্রভাব কি তাদের ছাত্রসংগঠনের ওপর পড়বে না? তারাও কি ক্যাম্পাসে এসে দাপট দেখাবে না? তারাও কি গেস্টরুম সংস্কৃতিকে নতুনভাবে নিয়ে আসবে না? এই রকম ভাবনার উদয় হলে তরুণেরা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে তাদের মন তৈরি করে নিতে পারে। এ রকম একটি বিষয়ও ডাকসু নির্বাচনে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দাবি করা বাগছাসের (বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ) ভরাডুবি হয়েছে। যে ভোট পড়েছে তাদের থলেতে, তাতে বোঝা যায়, তরুণেরা এই নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর পেছনে এনসিপির বিভিন্ন কার্যকলাপ দায়ী কি না, সেটা নিয়েও ভাবছেন কেউ কেউ। বৈষম্যবিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে নতুন করে বৈষম্যের জন্ম দেওয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তো উঠেছে দলটির বিরুদ্ধে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তারা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে নিতে পারে।
তরুণদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে ক্যাম্পাসের হালহকিকত সম্পর্কে কিছু কথা জানা গেল। ক্যাম্পাসে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ক্যাম্পাসের হৃৎকম্পন কেমন, তা জানেন। বাইরে থেকে দেখলে সেটা অনুভব করা যায় না।
ছাত্রলীগ বিগত সময়টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য কায়েম করেছিল। গেস্টরুম সংস্কৃতির কারণে প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা যে নিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাতে ছাত্রলীগের প্রতি শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ছাত্রদলের কোনো নেতার পক্ষে ক্যাম্পাসে এসে নিজ দলের পক্ষে প্রচারণা চালানো সম্ভব ছিল না। ফলে, ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাদের দেখতেই পাননি শিক্ষার্থীরা। ছাত্রশিবির নিয়েছিল কৌশল। যেহেতু তাদের রাজনীতি করা বারণ ছিল, তাই তারা ছাত্রলীগে ঢুকে বিভিন্নভাবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তারা ‘পোপের চেয়েও বড় পোপ’ সেজে অন্যদের মারপিটেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্বের কাছে তারা ছিল আস্থাভাজন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফোরামেও নিজ পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়েছেন। ফলে ৫ আগস্টের পর তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে ক্যাম্পাসেই থাকতে পেরেছেন। হলগুলোতে ছিল তাঁদের সক্রিয় অবস্থান। সাধারণ ছাত্ররা তাঁদের আগে চিনতেন একভাবে, এখন চেনেন আরেকভাবে। এটুকুই শুধু পরিবর্তন হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতার এটাও একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আরও একটি বড় কারণ, ছাত্রশিবিরের নেতারা নির্বাচনের সময় যে প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেও ছাত্রদল ধরাশায়ী হয়েছে। ছাত্রশিবির প্রচার করেছে, যদি ছাত্রদল জয়ী হয়, তাহলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মতোই নিপীড়ন ফিরবে। তাদের এই প্রচারণা তরুণদের প্রভাবিত করেছে।
ছাত্রলীগ আওয়ামী শাসনামলে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে হুমকি বলে মনে করেনি। তাই ক্যাম্পাসে কখনো কখনো বামপন্থীরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হতে পেরেছে। কিন্তু তখনো তাদের ভাগ্যে জুটেছে মার। গত শতকের ষাট বা সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো যে শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পেরেছিল, তা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও তারা যদি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারত, তাহলে তাদের সম্ভাবনা বাড়ত বলে মনে করে তরুণদের একাংশ। বামপন্থীদের মধ্যে উমামা ফাতেমা দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেল, সাতটি বামপন্থী সংগঠন গড়েছে প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল, তিনটি বামপন্থী সংগঠন গড়েছে অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ নামের প্যানেল। ফলে বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট শিক্ষার্থীদের ভোটও ভাগ হয়ে গেছে বিভিন্ন দিকে। বামপন্থীরা এত বেশি বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের ভোট আলাদা হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনে তারা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল ছাত্রশিবির। কারণ, তারা জানত, হলে তাদের অবস্থান সুদৃঢ়, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক সংগঠনেও তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, ফলে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে প্রশ্নাতীতভাবে। অপর পক্ষে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বেশির ভাগ নেতার সঙ্গেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিচয় নেই। ফলে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে ছাত্রশিবিরের আত্মবিশ্বাস ছিল। সেটাই ঘটেছে ভোটের মাঠে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার। তরুণদের চিন্তার জগৎ আলাদা। ১৯৭১ সাল আমাদের প্রজন্মের জন্য বিশাল এক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম সেই ইতিহাস নিয়ে যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, বর্তমান তরুণ তা হন না। বাস্তব অভিজ্ঞতা আবেগের জন্ম দেয়। যারা ইতিহাসের পথপরিক্রমা করেনি, তাদের কাছ থেকে ইতিহাস-সংলগ্নতা দাবি করাটাও ভুল।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মুখে যতটা বলা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যায়নি। বরং বিভিন্নভাবে এই শব্দ দুটির বহুল ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। মুখে এক কথা বলে দুর্নীতি, লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করলে মুক্তিযুদ্ধকেও ভুল বুঝতে পারে জনগণ। তারই প্রকাশ দেখা গেছে আগস্টের অভ্যুত্থানের পর। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকেও এক করা হয়েছে, গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হেয় করা হয়েছে। ইতিহাসে ১৯৭১ কেন অমোচনীয় কালিতে রচিত একটি সংখ্যা, সেটা বুঝতে হলে ইতিহাস-সংলগ্ন হতেই হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে কীভাবে দেশের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা যায়, সে চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। তরুণেরা অতীতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন না। তাঁরা নিজেদের গতিতেই এগিয়ে যান। কিন্তু অতীতের মূল্যায়ন করা জরুরি। তরুণেরা সেই মূল্যায়ন কীভাবে করছেন, সেটা একটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বহু কটু কথা বলা হয়েছে, কিন্তু নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার জন্য তো ছাত্রদেরই তৈরি হতে হবে। কোন প্রত্যয়কে তারা ধারণ করবে, তার ওপর নির্ভর করবে দেশের প্রগতি। তরুণদের পথ খোঁজার জন্য তাই এই সময়টি খুবই জটিল সময়। উত্তরণের পথ তাঁরাই খুঁজে বের করবেন।
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনমুখী রাজনীতির যাত্রা শুরু হলো। এক বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে ডাকসু নেতারা কতটা সফল হন, তা দেখবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে ডাকসু নেতারা সফল হলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন যেন অতীতের মতো জাতীয় রাজনীতির নির্দেশে বন্ধ হয়ে না যায়, সেটাই কাম্য।
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। অনেকের কাছে এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের ওপর আস্থা রেখেছেন। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল এবং নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় সারা রাত বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নানা অভিযোগ এসেছে নানা দিক থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দিক থেকে অনেক অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে, এই নির্বাচনের ফলাফল খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। আর এর কয়েকটি কারণের মধ্যে প্রধানতম হলো, ইসলামী ছাত্রশিবির বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় গুপ্তভাবে ক্যাম্পাসে থাকতে পেরেছে এবং হলগুলোতে তারা পরিচিত মুখ। অন্যদিকে যে দলটি ভেবে বসেছিল, ডাকসুতে তারা দোর্দণ্ড দাপটের সঙ্গে জিতে যাবে, সেই ছাত্রদলের প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে খুব পরিচিত মুখ নন। চাইলেই তাঁরা শিক্ষার্থীদের মন জয় করে নিতে পারেন না।
জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন চোরা স্রোত ডাকসু নির্বাচনকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়, আন্দোলনটিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বলা হলেও মূলত তা পরিচালনা করা হয়েছে সূক্ষ্মভাবে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দাবি করে পরে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নিজেদের দলকে বড় করে দেখার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই আন্দোলনে ছাত্রদল, শিবির, বামপন্থী ছাত্রদের বিভিন্ন দলসহ বহু ছাত্রসংগঠনই যুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে কারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন ছিল, সেটা এখন খুঁজে বের করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি ছাত্রসংগঠন যে সেই আন্দোলনের সময় গোপনে কাজ করে গেছে, সেটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে যেসব পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তার মধ্যে প্রধান একটি হলো, ক্যাম্পাস হবে সবার। সেখানে কোনো অত্যাচার চলবে না। গেস্টরুম, গণরুম ইত্যাদির নামে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল, তার অবসান দরকার। এই দাবিটি কোন ছাত্রসংগঠন ঠিকভাবে পূরণ করতে পারবে, তা নিয়ে সম্ভবত শিক্ষার্থীরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তারই প্রকাশ দেখা গেছে নির্বাচনে।
স্মৃতি প্রতারিত না করলে অনেকেই এক বছর আগের এই সময়টির কথা মনে করতে পারবেন। সে সময় মনে হচ্ছিল, বিএনপির ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপি যেভাবে লুটপাট আর দখলদারির রাজনীতি করেছে, তাতে বিস্মিত হয়েছে সাধারণ জনগণ। তাদের মনে হতে পারে, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের রাজনীতিই কি ফিরে আসবে? রাজনীতির মাঠে ক্ষমতা ছাড়াই বিএনপি যে দাপট দেখাচ্ছে, তার প্রভাব কি তাদের ছাত্রসংগঠনের ওপর পড়বে না? তারাও কি ক্যাম্পাসে এসে দাপট দেখাবে না? তারাও কি গেস্টরুম সংস্কৃতিকে নতুনভাবে নিয়ে আসবে না? এই রকম ভাবনার উদয় হলে তরুণেরা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে তাদের মন তৈরি করে নিতে পারে। এ রকম একটি বিষয়ও ডাকসু নির্বাচনে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দাবি করা বাগছাসের (বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ) ভরাডুবি হয়েছে। যে ভোট পড়েছে তাদের থলেতে, তাতে বোঝা যায়, তরুণেরা এই নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর পেছনে এনসিপির বিভিন্ন কার্যকলাপ দায়ী কি না, সেটা নিয়েও ভাবছেন কেউ কেউ। বৈষম্যবিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে নতুন করে বৈষম্যের জন্ম দেওয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তো উঠেছে দলটির বিরুদ্ধে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তারা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে নিতে পারে।
তরুণদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে ক্যাম্পাসের হালহকিকত সম্পর্কে কিছু কথা জানা গেল। ক্যাম্পাসে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ক্যাম্পাসের হৃৎকম্পন কেমন, তা জানেন। বাইরে থেকে দেখলে সেটা অনুভব করা যায় না।
ছাত্রলীগ বিগত সময়টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য কায়েম করেছিল। গেস্টরুম সংস্কৃতির কারণে প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা যে নিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাতে ছাত্রলীগের প্রতি শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। ছাত্রদলের কোনো নেতার পক্ষে ক্যাম্পাসে এসে নিজ দলের পক্ষে প্রচারণা চালানো সম্ভব ছিল না। ফলে, ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাদের দেখতেই পাননি শিক্ষার্থীরা। ছাত্রশিবির নিয়েছিল কৌশল। যেহেতু তাদের রাজনীতি করা বারণ ছিল, তাই তারা ছাত্রলীগে ঢুকে বিভিন্নভাবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে তারা ‘পোপের চেয়েও বড় পোপ’ সেজে অন্যদের মারপিটেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্বের কাছে তারা ছিল আস্থাভাজন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফোরামেও নিজ পরিচয় গোপন রেখে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা অংশ নিয়েছেন। ফলে ৫ আগস্টের পর তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে ক্যাম্পাসেই থাকতে পেরেছেন। হলগুলোতে ছিল তাঁদের সক্রিয় অবস্থান। সাধারণ ছাত্ররা তাঁদের আগে চিনতেন একভাবে, এখন চেনেন আরেকভাবে। এটুকুই শুধু পরিবর্তন হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতার এটাও একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। আরও একটি বড় কারণ, ছাত্রশিবিরের নেতারা নির্বাচনের সময় যে প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেও ছাত্রদল ধরাশায়ী হয়েছে। ছাত্রশিবির প্রচার করেছে, যদি ছাত্রদল জয়ী হয়, তাহলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মতোই নিপীড়ন ফিরবে। তাদের এই প্রচারণা তরুণদের প্রভাবিত করেছে।
ছাত্রলীগ আওয়ামী শাসনামলে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে হুমকি বলে মনে করেনি। তাই ক্যাম্পাসে কখনো কখনো বামপন্থীরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হতে পেরেছে। কিন্তু তখনো তাদের ভাগ্যে জুটেছে মার। গত শতকের ষাট বা সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো যে শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পেরেছিল, তা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও তারা যদি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে পারত, তাহলে তাদের সম্ভাবনা বাড়ত বলে মনে করে তরুণদের একাংশ। বামপন্থীদের মধ্যে উমামা ফাতেমা দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেল, সাতটি বামপন্থী সংগঠন গড়েছে প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল, তিনটি বামপন্থী সংগঠন গড়েছে অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ নামের প্যানেল। ফলে বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট শিক্ষার্থীদের ভোটও ভাগ হয়ে গেছে বিভিন্ন দিকে। বামপন্থীরা এত বেশি বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের ভোট আলাদা হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনে তারা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল ছাত্রশিবির। কারণ, তারা জানত, হলে তাদের অবস্থান সুদৃঢ়, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আঞ্চলিক সংগঠনেও তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, ফলে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতি রয়েছে প্রশ্নাতীতভাবে। অপর পক্ষে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বেশির ভাগ নেতার সঙ্গেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিচয় নেই। ফলে, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে ছাত্রশিবিরের আত্মবিশ্বাস ছিল। সেটাই ঘটেছে ভোটের মাঠে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা দরকার। তরুণদের চিন্তার জগৎ আলাদা। ১৯৭১ সাল আমাদের প্রজন্মের জন্য বিশাল এক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম সেই ইতিহাস নিয়ে যতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, বর্তমান তরুণ তা হন না। বাস্তব অভিজ্ঞতা আবেগের জন্ম দেয়। যারা ইতিহাসের পথপরিক্রমা করেনি, তাদের কাছ থেকে ইতিহাস-সংলগ্নতা দাবি করাটাও ভুল।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মুখে যতটা বলা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যায়নি। বরং বিভিন্নভাবে এই শব্দ দুটির বহুল ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। মুখে এক কথা বলে দুর্নীতি, লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করলে মুক্তিযুদ্ধকেও ভুল বুঝতে পারে জনগণ। তারই প্রকাশ দেখা গেছে আগস্টের অভ্যুত্থানের পর। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকেও এক করা হয়েছে, গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হেয় করা হয়েছে। ইতিহাসে ১৯৭১ কেন অমোচনীয় কালিতে রচিত একটি সংখ্যা, সেটা বুঝতে হলে ইতিহাস-সংলগ্ন হতেই হয়।
মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে কীভাবে দেশের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা যায়, সে চিন্তা নিয়ে অগ্রসর হওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে। তরুণেরা অতীতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন না। তাঁরা নিজেদের গতিতেই এগিয়ে যান। কিন্তু অতীতের মূল্যায়ন করা জরুরি। তরুণেরা সেই মূল্যায়ন কীভাবে করছেন, সেটা একটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বহু কটু কথা বলা হয়েছে, কিন্তু নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার জন্য তো ছাত্রদেরই তৈরি হতে হবে। কোন প্রত্যয়কে তারা ধারণ করবে, তার ওপর নির্ভর করবে দেশের প্রগতি। তরুণদের পথ খোঁজার জন্য তাই এই সময়টি খুবই জটিল সময়। উত্তরণের পথ তাঁরাই খুঁজে বের করবেন।
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনমুখী রাজনীতির যাত্রা শুরু হলো। এক বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে ডাকসু নেতারা কতটা সফল হন, তা দেখবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে ডাকসু নেতারা সফল হলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন যেন অতীতের মতো জাতীয় রাজনীতির নির্দেশে বন্ধ হয়ে না যায়, সেটাই কাম্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমার, শুধু আমার নয় বরং অনেকেরই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ার সুযোগ পেলাম, তখন প্রথম দিন বড় বোনের কাছ থেকে শাড়ি এনে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম। সেই দিনের শিহরণ, অনুভূতি এখনো শরীর-মনে দোলা দেয়।
৭ ঘণ্টা আগেনির্বাচনের পরে যাঁরা মন্ত্রী হবেন, তাঁদের জন্য ৬০টি গাড়ি কেনার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। প্রস্তাব এসেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। সমালোচনার মুখে সেই পথ থেকে সরে এসেছে সরকার। বাতিল করা হয়েছে গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত। বহু দুঃসংবাদের মধ্যে এটি একটি সুসংবাদ। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল ধরনের এই কেনাকাটার বিষয়টি
৭ ঘণ্টা আগেজাতীয় প্রেসক্লাবে ৭ সেপ্টেম্বর গণশক্তি আয়োজন করে ‘জুলাই সনদ ও নির্বাচন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। সেই সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যে প্রশ্নটি করেছেন, তা কোটি টাকার সঙ্গে তুলনা করাই যায়। তাঁর সহজ জিজ্ঞাসা—‘ভোটের দিন যাঁর যেখানে শক্তি আছে, তাঁর যদি মনে হয় জিততে পারবেন না...
১ দিন আগেহিমালয়কন্যা নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ভূদৃশ্যটি পর্বতমালার মতোই চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। ১০ বছরের মাওবাদী বিদ্রোহের রক্তক্ষরণের পর ২০০৮ সালে উচ্ছেদ হয়েছিল রাজতন্ত্র। সেই থেকে ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে। ক্ষমতার মসনদে ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছিল গুটিকয়েক নেতাকে।
১ দিন আগে