Ajker Patrika

মরণ হতে যেন জাগি

ভজন সরকার
মরণ হতে যেন জাগি

সম্প্রতি একটি ঘটনা গোটা কানাডা তো বটেই, সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। কানাডার সূর্যাস্তের প্রদেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের শৈল শহর কামলুপের একটি গণকবরে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। সভ্য ও আধুনিক কানাডার সঙ্গে ইতিহাসের কলঙ্ক যেন আর কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। ২০০৮ সালের ১১ জুন কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কানাডার আদি অধিবাসীদের কাছে সরকারিভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিলেন প্রায় দেড় শ বছর যাবৎ এই ভূমিপুত্রদের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল তার জন্য। উড়ে এসে জুড়ে বসা  ফরাসি ও ইংরেজ অভিবাসীরা কানাডার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড শুধু দখলই করেনি, হাজার বছর ধরে বাস করা কানাডার আদি ভূমিপুত্রদের প্রতিও চালিয়েছে নির্মম অত্যাচার। এই নিপীড়ন আর অত্যাচারের সর্বশেষ সংস্করণের নাম ছিল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল বা আবাসিক স্কুলব্যবস্থা।

ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যের শৈল শহর কামলুপের তেমন একটি আদিবাসী আবাসিক স্কুলের জমিতে পাওয়া গেছে  ওই গণকবর। জানা যায়, ১৯৭৮ সালে সরকারিভাবে ওই স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৬১ সালেই এক আদেশের মাধ্যমে এই রেসিডেন্সিয়াল বা আবাসিক স্কুলব্যবস্থার অবসান হয়েছিল। তবু বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েক দশক ধরে এ স্কুলগুলো চলেছিল।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ১৮২০ সালে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের সঙ্গে তখনকার শাসকদের চুক্তির ফলে সব আদিবাসী শিশুকে আবাসিক স্কুলে রেখে শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে একে একটি ভালো উদ্যোগ মনে  হলেও এর পেছনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য। আর তা হলো খ্রিষ্টধর্ম প্রচার। প্রকৃতি প্রদত্ত ধর্মের সঙ্গে বাস করা কানাডার আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি থেকে বের করে এনে তথাকথিত ইউরোপীয় সভ্যতা আর ধর্মবিশ্বাস শেখানোও ছিল পেছনের অভিসন্ধি। যদিও ইউরোপের তথাকথিত সভ্য শ্বেত-সন্তানেরা নিজেরাই রয়ে গেছে  তখনো অশিক্ষিত আর কূপমণ্ডূক।

১৮২০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত–এই একটা পুরো শতাব্দীর বেশি সময় কানাডার  ফার্স্ট নেশনস, মেটিস আর ইনুইট আদিবাসীদের শিশুসন্তানকে তাদের বাপ-মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষা ও সভ্যতা শেখানোর নামে শারীরিক ও মানসিক  নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, গুম, বিদেশে পাচারসহ অত্যাচারের সব বর্বরোচিত পন্থাই প্রয়োগ করা হয়েছে। সে সময়ের অত্যাচার থেকে বেঁচে আসা আদিবাসীদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, আবাসিক  স্কুলে শিক্ষার নামে শিশুদের শেখানো হতো শারীরিক পরিশ্রম, ইউরোপের রান্নাবান্না, সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতি আদবকায়দার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে এসব। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের জোর করে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করা হতো।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রায় দীর্ঘ তিন বছর কানাডার আদিবাসী ফার্স্ট নেশনস একটি জনপদে বাস করার। প্রায় সব আদিবাসী জনপদেই  কিছুসংখ্যক আদিবাসী এখনো বেঁচে আছেন, যাঁদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল আবাসিক স্কুলের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার। আবাসিক স্কুল থেকে বেঁচে আসা কিছু মানুষ এখনো প্রতিটি জনপদে দেখা যায়। কানাডিয়ান সরকার তাঁদের আজীবন ভাতাসহ মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারেও নজর দিয়ে থাকে। উদ্দেশ্য, ইতিহাসের এ কলঙ্কময় অধ্যায়ের কিছুটা দায় শোধ। প্রতিটি জনপদ বা আদিবাসী রিজার্ভে গড়া হয়েছে কিছু স্মৃতিস্মারক ও জাদুঘর। দেখেছিলাম, তেমনই একটি জাদুঘরে রক্ষিত আদিবাসী আবাসিক স্কুলের অষ্টম গ্রেডের এক ছাত্রের স্বীকারোক্তি, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এ রকম:

‘আমি আবাসিক স্কুলে বন্দী ছিলাম ২৮ মাস। এ সময় আমি শিখেছি কীভাবে ছেঁড়া মোজা সেলাই করব সুইং মেশিনে। শিখেছি সমস্ত ময়লা কাপড় কীভাবে আলাদা করে রাখব সে সাহেবি কায়দা। একটি ইংরেজি বাক্য কীভাবে ব্যবচ্ছেদ করে বিশ্লেষণ করা যায় তা–ও শিখেছি। আমি অন্যদের থেকে সৌভাগ্যবান। আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে বাইরে নিয়ে গিয়ে গাভির দুধ টানানো, খেতে বীজ লাগানো, ফসল তোলা, কাপড় পরিষ্কার করা, ঘরদোর মোছা–এসবই প্রতিদিন করানো হতো। তা ছাড়া মাঝে মাঝে শরীরে রশি বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে স্কুল কিংবা গির্জার বহুতল জানালার কাচ পরিষ্কার করানো হতো। অমনোযোগী কিংবা অবাধ্যতার শাস্তি শারীরিক কিংবা মানসিক অথবা দুটোই। সেই সঙ্গে পাদ্রিদের যৌন নিপীড়ন তো ছিলই।’

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আজকেও এ ক্ষতচিহ্নগুলো আদিবাসী জনগোষ্ঠী বয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক প্রজন্ম পরেও। কারণ, গোটা  একটি শতাব্দীর সে ক্ষত বা ট্রমা পরিবার থেকে সমাজে সংক্রমিত হয়েছে শেকড়ে–বাঁকড়ে। দেখা যায়, বিংশ শতকের ৫০ আর ৬০ দশকেই সবচেয়ে বেশি হয়েছে এই গোষ্ঠীগত অত্যাচার। তাই সম্প্রতি পাওয়া ২১৫ জন শিশুর দেহাবশেষ এ সময়েরই হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। যদিও এই কঙ্কালগুলোর ফরেনসিক বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞরা এখনো করছেন।

একবার ওন্টারিও পিক রিভার ফার্স্ট নেশনস রিজার্ভের এক শিক্ষিত ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আবাসিক স্কুলব্যবস্থা নিয়ে। বয়সের ভারে শীর্ণ এ ভদ্রলোকের কণ্ঠে বেদনার্ত ক্ষোভ, ‘জানো, সে সময়ে আমার মতো আরও অনেক ছেলেমেয়েকে লুকিয়ে রাখা হতো গহিন জঙ্গলে; কখন সরকারের পুলিশ বাহিনী এসে ধরে নিয়ে যায় সে ভয়ে। তবু  কি রক্ষা ছিল? আমাদের এই এলাকারই অনেক ছেলেমেয়ে আবাসিক স্কুলে আত্মহত্যা করেছে। অনেকে হয়ে গেছে মানসিক ভারসাম্যহীন। শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা গাছের মতোই মরে যেতে বসেছিল কানাডার ভূমিপুত্র এই আদিবাসীদের প্রজন্ম।’

দীর্ঘ এক যুগ পরে ২১৫ জন শিশুর গণকবরের খবর পড়ে  বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল সেদিন। প্রায় দীর্ঘ তিন বছর এই আদিবাসীদের সঙ্গে নানা বৈঠক করেছি  প্রকল্পের স্বার্থে। একেবারে কাছ থেকে দেখেছি বঞ্চনার চিত্রটা। আর এই চিত্রটা যেন সারা পৃথিবীব্যাপী এক ও অভিন্নই। বাংলাদেশ, কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়া কোথাও কোনো ফারাক নেই। যাদের বেড়ে ওঠা ভূমির ‘আদি’ সন্তান হিসেবে, তাদের অভিধা দেওয়া হয় ‘উপজাতি’। অথচ একবারও কেউ ভেবে দেখি না এসব জনগোষ্ঠী কোন জাতির ‘উপ’?

উড়ে এসে জুড়ে বসা তথাকথিত ‘জাতি’-সত্তাগুলো ‘উপ’-দের ওপর নিজেদের ধর্ম-ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত বোঝাতে চেয়েছে এদের সবকিছুই নীচু, সবকিছুই আধুনিকতার বিপরীত। ফলে বদলে দিতে হবে আমূলে।   উৎপাটন করে নতুন করে পুঁতে দিতে হবে শেকড়। আধুনিকতার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে ভূমির সন্তান এ আদিবাসীদের। অথচ এ  চিন্তাভাবনাই সভ্যতা এবং মানবিকতার বিপরীত।

আদিবাসী সেই সব মানুষের কাছে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক সীমানায় অবস্থান করেও যাঁরা এখনো লড়াই–সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব ভূমির ন্যায্য অধিকারের জন্য।  সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই  নির্মমতার শিকার হওয়া এই শিশুদের, যারা  
এত অল্প বয়সে অকালে ঝরে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলি, ‘তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে।’

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত