Ajker Patrika

আমাদের মা–বোনেরা সব পারেন

কামরুন নাহার
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২১, ১২: ৩২
আমাদের মা–বোনেরা সব পারেন

অনলাইন ব্যবসাটা কয়েক বছর ধরে (২০১২–১৩ থেকে, আমার যত দূর মনে পড়ে) বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমি বলছি মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং আরও নির্দিষ্ট করে ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন ব্যবসার কথা, যেখানে মূল উদ্যোক্তা নারী। আর এই ২০২০-২১-এ করোনা যখন মরণছোবল দিল, তখন অনলাইন কেনাকাটা বা ব্যবসা মোটামুটি একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে আমাদের জীবনে।

আমি অনলাইন ব্যবসার সাফল্যগাথা লিখতে বসিনি। এই ব্যবসা এই দেশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যেদিন উঠল, সেদিন থেকেই সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে আর সেই সাফল্যের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। আমি লিখতে চাইছি এই অনলাইন ব্যবসা সফল করা নারী উদ্যোক্তাদের কথা। হ্যাঁ, এটা সত্যি, যে তরুণ বা তরুণী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন অল্প পুঁজিতে, ৫ হাজার টাকা দামের একটি স্মার্টফোন তাঁর সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মেয়েটিও আজ উদ্যোক্তা এবং সফল অনলাইন ব্যবসায়ী।

করোনাকালে ঘরে বসে থাকার কারণেই হোক বা আর্থিক অনটন থেকেই হোক, নারী উদ্যোক্তারা ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন ব্যবসায় মোটামুটি একটা রেভল্যুশন নিয়ে এসেছেন। একটা কথা তো কিছুটা হলেও সত্যি, করোনাকালে অনেকের বেতন কমেছে, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন; কিন্তু খরচ কমেনি বা জীবন থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি খরচের চাকা। কোথা থেকে আসবে তবে জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম অর্থ! সেই আর্থিক ঘাটতিটা পূরণ করতে, স্বামীর সহযোগী হাত হিসেবে, সংসারের সাপোর্টার হিসেবে অনেক নারীই উদ্যোক্তা হয়েছেন, যাঁর যাঁর জায়গা থেকে যাঁর যাঁর সেরাটা নিয়ে। এতে সবচেয়ে বেশি যে লাভটা হয়েছে তা হলো, যে নারী কখনো কিছু করারই সুযোগ পাননি জীবনে বা যাঁর প্রতিভা পরিবারে অবহেলিতই ছিল সব সময়, সেই নারীও আজ অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন ঘরে বসে।

যে নকশিপিঠা নারী শুধু ঘরে পালা-পার্বণে বানাতেন, তিনি সেটাকে এখন সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিচ্ছেন। যে নকশিকাঁথা বা জামদানি স্টিচের শাড়ি আগে শখের বশে বানাত কলেজের মেয়েটি, আজ সেটা তার শখ থেকে উপার্জনের মাধ্যম হয়েছে। ঘরে খাওয়ার জন্য যে মা যবের ছাতু বা আচার বানাতেন, আজ সেটা তার ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার, পোশাক, বুনন, ঘর সাজানোর সামগ্রী, শীতলপাটি, হাতপাখা, অতিপ্রয়োজনীয় বিছানা ঝাড়ার বিশেষ শলার ঝাড়ু, মুড়ি-মুড়কি, ঘরে বানানো নানা রকম সন্দেশ, কুমড়ো বড়ি, ঢ্যাপের মোয়া—যেসবের কথা নগরবাসী ভুলতে বসেছিল এবং এই প্রজন্ম যেসবের নামই শোনেনি—সেগুলোতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে দেশের আনাচে-কানাচে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন আমাদের শহরের, গ্রামের মায়েরা, বোনেরা। এই প্রজন্ম জানেই না কত সমৃদ্ধ আমাদের পিঠার ভান্ডার। সেই পিঠার ভান্ডার খুলে দিয়েছেন গ্রামের মায়েরা, বোনেরা। হ্যাঁ, পিঠা বেইলি রোডের দোকানেও পাওয়া যায়! কিন্তু কত রকম পিঠা পাওয়া যায় আর স্বাদ কেমন? পিঠা ব্যবসায়ীরা নামও জানেন না এমন অনেক পিঠা আছে গ্রামের আনাচে-কানাচে। আর সেগুলোর স্বাদ, যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা জানেন।

এই প্রজন্ম জানে বিবিখানা নামে একটা পিঠা আছে? জ্বালা পিঠার জাউ নামে একটা খাবার আছে, যা গুড়-মুড়ি দিয়ে খেতে হয়—সেটা কয়জন জানেন শহর, নগরের? এগুলো আমাদের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে সেই সুদূর থেকে আমাদের মা-বোনদের হাত ধরে।

আগে আমরা শুধু রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অনলাইনে অর্ডার করে আনিয়ে খেতাম। এখন রেস্টুরেন্ট ঘরে ঘরে। খুব ভালো রান্নার হাত বলে প্রশংসা পেতেন যে নারী, তাঁর সেই প্রশংসা শুধু খাবারের টেবিলে স্বামী-সন্তানদের মুখে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ সেই স্বাদ জানে দেশ-বিদেশের মানুষ। জন্মদিনে ভাইয়ের ছেলেকে একটা কেক বানিয়ে পাঠাতেন যে ফুফু, তিনি আজ তাঁর সেই ডেলিকেসি পৌঁছে দিচ্ছেন ঘরে ঘরে। কী রান্না করছেন না মা-বোনেরা এই নগরে ঘরে ঘরে কিংবা মফস্বলের রান্নাঘরে বসে! পিৎজা, পাস্তা থেকে গরুর ভুঁড়ি কিংবা অনেক রকম ভর্তা, সঙ্গে খুদের ভাত–সব রান্না করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আপনার, আমার ঘরে। স্বাদ আর স্বাস্থ্যসুরক্ষা সবই আছে এই খাবারে। সবচেয়ে বেশি আছে নারীদের সাবলম্বী হওয়ার গল্পটা, আছে স্বপ্ন দেখার গল্পটা। যে শ্বশুর ছেলের বউ কাজ করলে বংশের ইজ্জত থাকবে না বলে হুংকার দিতেন, তিনি আজ তাঁর ছেলের বউয়ের হাতে বানানো আচারের বয়ামটা পার্সেলের জন্য কুরিয়ারে দিয়ে আসেন। যে স্বামী বলতেন, আমার রোজগার কী কম, যে তোমায় রোজগার করতে হবে! সেই তিনিও আজ এই অতিমারিতে চাকরি হারিয়ে বুঝে গেছেন নারীদেরও উপার্জন করার, স্বাবলম্বী হওয়ার দরকার আছে। নারীর উপার্জন করার সুবিধা পুরুষ এই অতিমারিতে পেয়েছেন।

নারীর কিছু করা মানে শুধু ডাক্তার, শিক্ষক বা পাইলট হওয়া নয়। সেটা তাঁরা হচ্ছে, আরও হবে; কিন্তু যে নারী লেখাপড়া জানা সত্ত্বেও একটু পিছিয়ে সমাজ-সংসারের নিয়মের কারণে, তাঁর জন্য কিছু করা মানে নিজের সেরাটা সবার সামনে এনে দেশ ও জাতির কল্যাণে অর্থনীতিতে অবদান রাখা; তা যেকোনো উপায়েই হোক। আর আজকের এই ডিজিটাল যুগে সেটা যে ঘরে বসে শীতলপাটি বানিয়েও করা যায়, তা আমাদের নারীরা এ সময় দেখিয়ে দিয়েছেন। আর ঘরের রান্নাবান্না—সেটা তো নারী চাকরি, ব্যবসা করার পর সারা জীবন এমনি এমনি বিনা মূল্যেই করেন। আমাদের মায়েরা-বোনেরা সব পারেন, সব। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত