সেলিম জাহান
চলে গিয়েছিলাম অনেকটাই; কিন্তু কী ভেবে আবার ফিরে এলাম ওই একপাটি জুতোর কাছে। পড়ে আছে ফুটপাতের ওপরে কিছুটা আলো-আঁধারিতে। একটু দূরে পড়ে আছে একটি সিগারেটের না-খাওয়া অংশ। কোনো এক শিশুর বাঁ পায়ের জুতো—কালো রঙের, সামনের দিকে আবার দুটো চোখ আছে, জুতোর ভেতরটা হালকা গোলাপি। কত বয়স হবে বাচ্চাটির, যে জুতোটি পরেছিল—বড়জোর তিন বা চার বছর?
কেমন করে জুতোটি এল ওখানে—এই সাতসকাল ৯টায়, জাতিসংঘ ভবনের কাছে? কত আগে পড়ে গেছে জুতোটি? আমি নিশ্চিত যে বেশি আগে হবে না। আন্দাজ করি, যে শিশুটি বসেছিল তার শিশুঠেলুনিতে, তার মা কিংবা বাবা তাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন খুব সম্ভবত কাছের শিশু তত্ত্বাবধান কেন্দ্রে।
কতক্ষণ আগে ঘটনাটি ঘটেছে? কত দূরে চলে গেছে ওরা? শিশুটি সম্ভবত মেয়ে, অন্তত জুতো দেখে তাই মনে হয়। হয়তো শিশুটি খুব দুরন্ত—নিজ হাতে টেনে খুলে ফেলেছে মা-বাবার অজান্তেই। কিংবা বাঁ পায়ের জুতোটি ঢিলে ছিল—আপনিই পড়ে গেছে। শিশুটির মা-বাবা কি টের পেয়েছেন যে, বাচ্চাটির এক পায়ে জুতো নেই? টের পেলে কি শিশুটি বকা খাচ্ছে? বকা খেয়ে কি ওর দু’চোখে জল টলটল করছে অভিমানে?
কত দিন কত জায়গায় কত শহরে শিশুদের কত জিনিস পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি—ছোট্ট টুপি, একপাটি জুতো, এক হাতের দস্তানা, একটি ছোট্ট গাড়ি, একটি ছোট্ট পুতুল। এই সব ফেলে যাওয়া জিনিসের পেছনে কত ইতিহাস থাকে, রয়ে যায় স্মৃতি, থেকে যায় শিশুটির মায়া, ভালোবাসা আর মমতা।
এই সবই তো দেখেছি আমাদের দুই কন্যার শৈশবে—যার একটা অংশ কেটেছে কানাডার মন্ট্রিয়লে। বিকেলের দিকে আমাদের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে শিশুঠেলুনিতে বসিয়ে বেনু আর আমি বেরোতাম। আমি শকটটি ঠেলতাম আর বেনু আমার বাহু ধরে থাকত। মৃদু স্বরে গল্প করতে করতে আমরা চলতাম।
আমাদের এই কন্যাটির স্বভাব ছিল, যেখানেই সে যেত একটি কাঠি বা গাছের ছোট্ট ডাল সে সংগ্রহ করত। তারপর তার বাহনে বসে ওই ডালটিকে সে দোলাত কিংবা কাঠিটির সঙ্গে সে অনবরত কথা বলত। একদিন কেমন করে যেন তার সংগৃহীত কাঠিটি কোথায় যেন পড়ে গেল। প্রথমে সে টের পায়নি, যখন টের পেল তখন সে উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিল। রাস্তার পাশ থেকে আরেকটি কাঠি তাকে দেওয়া গেল। কিন্তু ‘ভবি ভুলিবার নয়’, তার ওই কাঠিটিই চাই। সুতরাং বেনু দাঁড়িয়ে থাকল কন্যার বাহনটি ধরে, আমি পেছনে সিকি মাইল হেঁটে সেই কাঠি উদ্ধার করে মিনিট বিশেক পর তার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পরে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছানো গেল।
ঢাকায় আশির দশকের মাঝামাঝি আমি আমার কনিষ্ঠ কন্যাটিকে প্রতিদিন সকালে রিকশা করে বেইলি রোডের স্কুলে নিয়ে যেতাম। রিকশায় সে আমার পাশে বসত। আমি তাকে শক্ত করে ধরে রাখতাম। আর সে ছোট ছোট দুটি হাতে ধরে ‘নন্টে-ফন্টে’ পড়ত। একদিন ফেরার পথে সে যথারীতি পড়ছিল তার বই। হঠাৎ করে এক দমকা হাওয়া এসে তার বইটিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশের জলভরা নর্দমায় নিয়ে ফেলল। তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। রিকশা ঘুরিয়ে নিউমার্কেট, ‘জিনাত বুক স্টোরে’ গিয়ে ফয়সালের শরণাপন্ন, নতুন একটা বই কেনা এবং বাসায় প্রত্যাবর্তন—রিকশায় আবারও বই পড়তে পড়তে।
রাস্তায় ফেলে যাওয়া শিশুটির জুতোটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বহুদূরের একটা ঝাপসা ছবি যেন ভেসে উঠল। একটি শিশু তার বাবার হাত ধরে চলছে, পায়ে তার সে কালের বড় জনপ্রিয় বাটার ‘নটি-বয়’ জুতো। দু-পা গিয়ে গিয়ে শিশুটি থেমে পড়ছিল—কখনো দোকান দেখে, কখনো পথের ওপর উড়ে আসা পায়রা দেখে, কখনো বা দ্রুতপায়ে রাস্তা পারাপাররত বিড়াল দেখে। ছেলেটির পিতা স্মিতহাস্যে তাঁর শিশুপুত্রটির কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর পুরোটা সময় তাঁর আছে—তাঁর কোনো তাড়া নেই।
ছবিটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে গেল আমার। চমক ভাঙল পথচলতি এক সহকর্মীর ডাকে। আমাকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উদ্বিগ্নভাবে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু কি হারিয়েছ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ সহানুভূতি মেশানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘খুঁজে দেব?’ আমি মৃদু হাসলাম। তারপর ওই ফেলে যাওয়া জুতোটির দিকে একপলক চেয়ে সহকর্মীটির মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে স্মিতহাস্যে জবাব দিলাম, ‘না, লাগবে না। খুঁজে পেয়েছি।’
চলে গিয়েছিলাম অনেকটাই; কিন্তু কী ভেবে আবার ফিরে এলাম ওই একপাটি জুতোর কাছে। পড়ে আছে ফুটপাতের ওপরে কিছুটা আলো-আঁধারিতে। একটু দূরে পড়ে আছে একটি সিগারেটের না-খাওয়া অংশ। কোনো এক শিশুর বাঁ পায়ের জুতো—কালো রঙের, সামনের দিকে আবার দুটো চোখ আছে, জুতোর ভেতরটা হালকা গোলাপি। কত বয়স হবে বাচ্চাটির, যে জুতোটি পরেছিল—বড়জোর তিন বা চার বছর?
কেমন করে জুতোটি এল ওখানে—এই সাতসকাল ৯টায়, জাতিসংঘ ভবনের কাছে? কত আগে পড়ে গেছে জুতোটি? আমি নিশ্চিত যে বেশি আগে হবে না। আন্দাজ করি, যে শিশুটি বসেছিল তার শিশুঠেলুনিতে, তার মা কিংবা বাবা তাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন খুব সম্ভবত কাছের শিশু তত্ত্বাবধান কেন্দ্রে।
কতক্ষণ আগে ঘটনাটি ঘটেছে? কত দূরে চলে গেছে ওরা? শিশুটি সম্ভবত মেয়ে, অন্তত জুতো দেখে তাই মনে হয়। হয়তো শিশুটি খুব দুরন্ত—নিজ হাতে টেনে খুলে ফেলেছে মা-বাবার অজান্তেই। কিংবা বাঁ পায়ের জুতোটি ঢিলে ছিল—আপনিই পড়ে গেছে। শিশুটির মা-বাবা কি টের পেয়েছেন যে, বাচ্চাটির এক পায়ে জুতো নেই? টের পেলে কি শিশুটি বকা খাচ্ছে? বকা খেয়ে কি ওর দু’চোখে জল টলটল করছে অভিমানে?
কত দিন কত জায়গায় কত শহরে শিশুদের কত জিনিস পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি—ছোট্ট টুপি, একপাটি জুতো, এক হাতের দস্তানা, একটি ছোট্ট গাড়ি, একটি ছোট্ট পুতুল। এই সব ফেলে যাওয়া জিনিসের পেছনে কত ইতিহাস থাকে, রয়ে যায় স্মৃতি, থেকে যায় শিশুটির মায়া, ভালোবাসা আর মমতা।
এই সবই তো দেখেছি আমাদের দুই কন্যার শৈশবে—যার একটা অংশ কেটেছে কানাডার মন্ট্রিয়লে। বিকেলের দিকে আমাদের জ্যেষ্ঠ কন্যাকে শিশুঠেলুনিতে বসিয়ে বেনু আর আমি বেরোতাম। আমি শকটটি ঠেলতাম আর বেনু আমার বাহু ধরে থাকত। মৃদু স্বরে গল্প করতে করতে আমরা চলতাম।
আমাদের এই কন্যাটির স্বভাব ছিল, যেখানেই সে যেত একটি কাঠি বা গাছের ছোট্ট ডাল সে সংগ্রহ করত। তারপর তার বাহনে বসে ওই ডালটিকে সে দোলাত কিংবা কাঠিটির সঙ্গে সে অনবরত কথা বলত। একদিন কেমন করে যেন তার সংগৃহীত কাঠিটি কোথায় যেন পড়ে গেল। প্রথমে সে টের পায়নি, যখন টের পেল তখন সে উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিল। রাস্তার পাশ থেকে আরেকটি কাঠি তাকে দেওয়া গেল। কিন্তু ‘ভবি ভুলিবার নয়’, তার ওই কাঠিটিই চাই। সুতরাং বেনু দাঁড়িয়ে থাকল কন্যার বাহনটি ধরে, আমি পেছনে সিকি মাইল হেঁটে সেই কাঠি উদ্ধার করে মিনিট বিশেক পর তার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পরে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছানো গেল।
ঢাকায় আশির দশকের মাঝামাঝি আমি আমার কনিষ্ঠ কন্যাটিকে প্রতিদিন সকালে রিকশা করে বেইলি রোডের স্কুলে নিয়ে যেতাম। রিকশায় সে আমার পাশে বসত। আমি তাকে শক্ত করে ধরে রাখতাম। আর সে ছোট ছোট দুটি হাতে ধরে ‘নন্টে-ফন্টে’ পড়ত। একদিন ফেরার পথে সে যথারীতি পড়ছিল তার বই। হঠাৎ করে এক দমকা হাওয়া এসে তার বইটিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশের জলভরা নর্দমায় নিয়ে ফেলল। তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। রিকশা ঘুরিয়ে নিউমার্কেট, ‘জিনাত বুক স্টোরে’ গিয়ে ফয়সালের শরণাপন্ন, নতুন একটা বই কেনা এবং বাসায় প্রত্যাবর্তন—রিকশায় আবারও বই পড়তে পড়তে।
রাস্তায় ফেলে যাওয়া শিশুটির জুতোটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বহুদূরের একটা ঝাপসা ছবি যেন ভেসে উঠল। একটি শিশু তার বাবার হাত ধরে চলছে, পায়ে তার সে কালের বড় জনপ্রিয় বাটার ‘নটি-বয়’ জুতো। দু-পা গিয়ে গিয়ে শিশুটি থেমে পড়ছিল—কখনো দোকান দেখে, কখনো পথের ওপর উড়ে আসা পায়রা দেখে, কখনো বা দ্রুতপায়ে রাস্তা পারাপাররত বিড়াল দেখে। ছেলেটির পিতা স্মিতহাস্যে তাঁর শিশুপুত্রটির কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর পুরোটা সময় তাঁর আছে—তাঁর কোনো তাড়া নেই।
ছবিটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে গেল আমার। চমক ভাঙল পথচলতি এক সহকর্মীর ডাকে। আমাকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উদ্বিগ্নভাবে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু কি হারিয়েছ?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ সহানুভূতি মেশানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘খুঁজে দেব?’ আমি মৃদু হাসলাম। তারপর ওই ফেলে যাওয়া জুতোটির দিকে একপলক চেয়ে সহকর্মীটির মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে স্মিতহাস্যে জবাব দিলাম, ‘না, লাগবে না। খুঁজে পেয়েছি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন এমন এক আবহে অনুষ্ঠিত হবে যে তা শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটা তাঁর নিজের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে
১ দিন আগেসোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫। আস্থা আছে কি না, স্বপ্রণোদিত হয়ে যাচাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরু। সংসদে ১৯৪ জন সংসদ সদস্য তাঁর ওপর আস্থা জানিয়ে ভোট দিলেও ৩৬৪ জন তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ফ্রান্সের আইনপ্রণেতা হচ্ছেন মোট ৫৭৭ জন। ফলে মাত্র ৯ মাস ক্ষমতায়
১ দিন আগেসময় এখন অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মানুষ তার হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে—কৃষি, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতিটি বিপ্লব আমাদের জীবনধারায় গভীর পরিবর্তন এনেছে, কেউ কেউ পেছনে পড়ে গেছে, কেউ সামনের সারিতে উঠে এসেছে। কিন্তু এইবার যা আসছে, তা হয়তো আর কাউকে কেবল পেছনেই ফেলবে না; বরং মানুষক
১ দিন আগেবাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আজকের পত্রিকায় ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল’ (ক্যাবি) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
১ দিন আগে