Ajker Patrika

আমার পুডিং…

সেলিম জাহান
আমার পুডিং…

ঈদ এলেই নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়—ঈদের সকাল, সারাদিন, বিকেল, রাত্রি। খুব ভোরে উঠে যেতাম ঈদের দিন। চোখ বন্ধ রেখেই টের পেতাম ঈদের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে পুরো বাড়িতে। দূর থেকে দুধ জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসত। সেমাই বানানো শুরু হয়ে গেছে। বাবা ঝট করে বাজার সেরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, টের পাচ্ছি। রহিমনবু তাঁর ভাষায় ঘর ‘ধোয়া-পাখলা’ শুরু করে দিয়েছেন। আমার ঘরের সামনেটা মুছতে মুছতে বলতেন, ‘উইঠ্যা পড়ো বাজান। ঈদের দিন সক্কাল সক্কাল উঠলে নেকি অনেক বেশি।’ নেকির লোভে নয়, চারদিকে যত কিছু হচ্ছে, তার কিছুই যেন বাদ না যায়, তা নিশ্চিত করতে ঝট করে উঠে পড়তাম। উঠতে উঠতেই দেখতাম, রাতে কখন যেন মা খলিফা চাচার সেলাই করা নতুন কাপড় বালিশের পাশে রেখে দিয়েছেন।

উঠেই রান্নাঘরে মায়ের কাছে যেতাম পুডিং হচ্ছে কি না নিশ্চিত করতে। মা তখন সেমাই সামলাতে ব্যস্ত—আগুনের গনগনে আঁচে ফর্সা মুখ তাঁর তেতে লাল। আমার প্রশ্নে রেগে গিয়ে বলতেন, ‘এ ছেলে তো পুডিং পুডিং করে পাগল হয়ে যাবে।’ বলেই হয়তো তাঁর খারাপ লাগত। গলাটা অদ্ভুত নরম করে মুচকি হেসে বলতেন, ‘হচ্ছে পুডিং। পাউরুটিও দিয়েছি তাতে একটু।’ আমাকে আর পায় কে? তিন লাফে বসার ঘরে, ওটা সাজানোর ভার আমার। দেখতাম, মধ্যটেবিলে রহম আলী ভাইয়ের সাজানো ফুলের তোড়া, তার পাশে বাবা আতরদানি নামিয়ে রেখেছেন।

বসার ঘর সাজানো শেষ করতে করতে শুনতাম, বাবা স্নানের তাড়া দিচ্ছেন। স্নান সেরে নতুন জামা-কাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমরা তিন ভাই তৈরি, তৈরি বাবাও। একটু টুকরো তুলোয় আতর লাগিয়ে কানের ভেতরে গুঁজে দিতেন বাবা, ঘষে দিতেন কবজিতেও। তারপর খাবার টেবিলে গরম সেমাই, যার সোয়াদই অনন্য। তারপর ঈদগাহের দিকে রওনা হওয়া। আমরা বেরোবার মুখে মা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন। আমরা চারজন তাঁকে বলে যাত্রা শুরু করতাম। সে সময়ে এক অদ্ভুত তৃপ্তি মায়ের মুখে খেলা করত।

পথে পথে চেনা-অচেনা কত লোক সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর টুপিতে পরিবৃত। রঙিন পাঞ্জাবির চল তখনো শুরু হয়নি। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পথ চলা। চলতে চলতে চোখে পড়ত, বাবার হাত ধরে আমার বন্ধু নওশাদরা দু ভাই চলছে। ওদের মুখে কোনো হাসি নেই। মনে পড়ত, গত বছরই আসমা খালা চলে গেছেন। ভাবতাম, আজ নওশাদরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কেউ ওদের বিদায় জানায়নি। নামাজ শেষে ওরা যখন ফিরে যাবে, তখন মাকে ওরা সালাম করতে পারবে না। বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠত।

নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে যেতাম যথারীতি। আমার পাশে এসে দাঁড়াত আমার বন্ধু নাজিম। সেজদায় গিয়ে দেখতাম, নাজিম চোখ খোলা রেখে চারপাশ হাতড়াচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষেরই নাকি সেজদার সময়ে পকেট থেকে পয়সা পড়ে যায়—এই ‘নাজিম-তত্ত্বের’ সূত্র ধরে সে সেজদার সময়ে পয়সা খুঁজে বেড়াত। আমার মজার এ বন্ধুটি বহুকাল আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নামাজ শেষে কোলাকুলি যেন শেষ হতেই চায় না। সেই সঙ্গে সবার বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ।

বাড়ি ফিরে আশ্চর্য এক বিস্ময় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করত। আমাদের সদ্যস্নাতা মা ঈদের সুন্দর শাড়ি পরে, হালকা প্রসাধনে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। কি সুন্দর যে লাগত তাঁকে! তাঁকে সালাম করার সময়ে পদ্মের মতো তাঁর সুন্দর পাটাই নজরে পড়ত আমার। সালাম শেষে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলতেন—কী বলতেন, জানি না—কোনো আশীর্বাণীই হবে হয়তো। মনটা ভারী প্রশান্ত হয়ে যেত। ওই সালাম সেরেই ‘পথে এবার নামো সাথি’ বলে পাড়া বেড়ানো। বাড়ি-বাড়ি ঘোরা, ভালো-মন্দ খেয়ে পেট ভরানো, শেষে এমন হতো অনেক সুখাদ্যও বাদ যেত। আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু বরিশালে ‘ঈদি’র প্রচলন দেখিনি। হয়তো ছিল, কিন্তু আমাদের বলয়ে তা ছিল অনুপস্থিত।

সারাদিনে কত মানুষ যে আসত। আসতেন নিরামিশাষী হরিশ কাকা, প্রচণ্ড আমিষী আসলাম ভাই, আসতেন অশ্বিনী দা, জহির চাচাসহ আরও কতজন। তবে একজন মানুষের খাওয়ার সময়ে শত কাজের মধ্যেও মা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলতেন, খাবার তদারকি করতেন।

ভারি সুপুরুষ ছিলেন নারাণ দা; মেহগনির মতো কুচকুচে গায়ের রং, পেটানো শরীর, সুন্দর ধুতি, রঙিন ফতুয়াতে সজ্জিত হয়ে আসনপিঁড়িতে খেতেন তিনি। খাওয়া শেষে গড় হয়ে মাকে প্রণাম করতেন। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝি মা নারাণ দাকে ভিন্নভাবে সমাদর করতেন, যাতে তাঁর কিছুতেই মনে না হয় যে তিনি আলাদা।

তারপর একসময়ে রাত নেমে আসত। মা-বাবা সেজেগুজে পাড়ায় ঈদ বেড়ানোতে বেরোতেন। কি যে সুন্দর লাগত দুজনকে। বাবার হাতে টর্চ, মায়ের হাতে নকশা করা ব্যাগ।

আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে। খাব কী? সারাদিনের বড় রকমের পেট পূজার জের তখনো চলছে। সেইসঙ্গে দিনভর টইটই করে ঘোরার ক্লান্তি। ঘুমে চোখ বুজে আসত। বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমের আচ্ছন্নতায় মনে পড়ে যেত—হায়, হায়, সারাদিনের উত্তেজনায় পুডিংটাই তো খাওয়া হয়নি। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে অস্ফুট স্বরে বলতাম, ‘আমার পুডিং ...!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত