Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

মব জাস্টিস না বলে এটাকে সংগঠিত সহিংসতা বলাই শ্রেয়

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই বিভাগ থেকেই অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড পিসবিল্ডিংয়ের ওপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। মব কেন রোধ করা যাচ্ছে না এবং এর প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা কেন ঘটছে?

এই প্রশ্নের উত্তর অন্ততপক্ষে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা যেতে পারে, যার একটি আরেকটির পরিপূরক। তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায়, মানুষকেন্দ্রিক দুটি বিপরীতমুখী আলাপ প্রণিধানযোগ্য। প্রথমটি হলো, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু সেই মানুষকেই আবার বলা হয় প্রাণিকুলের সবচেয়ে বড় প্রিডেটর: অর্থাৎ সব প্রাণীর ওপর নৃশংস প্রাধান্য বিস্তার, এমনকি প্রকৃতির ওপর ধ্বংসলীলা স্থাপনকারী প্রাণিকুলটি হচ্ছে এই মানুষ। মানুষ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি লোভ ও ক্ষুধার মতো হিংস্রতাও ধারণ-পোষণ করে। এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতেই সময়ে সময়ে সামাজিক রীতিনীতি, ধর্ম, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন আসে। এমনকি রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় সামাজিক চুক্তি বাস্তবায়ন, মূল্যবোধ চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা, সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বিবেচিত হয় ন্যায়বিচার নির্ধারণের বড় মাপকাঠি। যদি জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশে এসব কাজ নিশ্চিত করা না হয়, তবে সেই সমাজে এই ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।

লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংকট। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি ও এর চর্চা, কর্মসংস্থানের অভাব, অদক্ষ জনগোষ্ঠী ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, সর্বোপরি ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শূন্যতা, পুলিশের মনোবল হ্রাস এসব ঘটনার মূল অনুঘটক। তবে দুঃখের বিষয়, হেফাজতে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ইসলামি দল এই ঘটনার নিন্দা কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, এমনটি দৃষ্টিগোচরে আসেনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন এ ধরনের ঘটনা সময়মতো প্রতিরোধ করতে পারছে না?

ঘটনাটির দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং জনপ্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তাদের নিষ্ক্রিয়তা, অপেশাদারত্ব ও দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাসীনতা এই জঘন্য সহিংসতার সরাসরি কারণ। এই নিষ্ক্রিয়তা ও অনুপস্থিতির পেছনে আছে বিগত সরকার কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যাচ্ছেতাই রাজনৈতিক ব্যবহার। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের আলোকে এটি একটি ‘কাঠামোগত সহিংসতা’ (স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স)-এর বহিঃপ্রকাশ (আউটবার্স্ট)। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ না করে বা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজের বিপথগামী অংশগুলো ঠিক এ রকমই ধর্মান্ধ ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনো রাজনৈতিক চাপ, কখনো অদক্ষতা, আবার কখনো অপ্রতুল জনবল বা সম্পদের কারণে ঘটনাস্থলে যথাসময়ে পৌঁছাতে না পারায় লাশ উত্তোলন ও পুড়িয়ে ফেলার মতো চরম ন্যক্কারজনক ও অমার্জনীয় ঘটনা সময়মতো প্রতিরোধ করতে পারেনি।

বাংলাদেশে কর্মহীন বেকার জনসংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে, কিন্তু তার বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী জনবল সীমিত। মাঠপর্যায়ে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন তাঁদের প্রায় কেউই আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ফলে সংকটের মুহূর্তে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা বেশির ভাগ সময় কঠিন হয়।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের মুখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না।

সাধারণ মানুষ বা মবের হাতে আইন তুলে নেওয়ার পেছনের মূল কারণগুলো কী?

মব জাস্টিস না বলে এটাকে সংগঠিত সহিংসতা বা অর্গানাইজড ভায়োলেন্স বলাই শ্রেয়। এ ক্ষেত্রে জনগণের আস্থাহীনতা অন্যতম প্রধান কারণ। জনগণ যখন দেখে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বল বা পক্ষপাতদুষ্ট, তখন তারা ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ‘বিচার’ করতে উদ্যত হয়।

বিপথগামী জনগণের হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মূলত সমাজে আইনের শাসনের অভাব ও সামাজিক অন্যায্য অসমতা থেকে জন্ম নেয়। দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে ন্যায়বিচার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত না হয়ে বরং তা অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ ‘রাজনীতি ব্যবসায়ী’ এবং তাদের স্থানীয় এজেন্টদের হাতে চলে যায়, তেমনি ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ সমাজে অনুপস্থিত, যার ফলে কর্মসংস্থানহীন অদক্ষ তরুণ হতাশা থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ ধর্মান্ধ হয়ে উঠে বাছবিচারহীন সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। আরও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। যেমন:

১. ন্যায়বিচারহীনতা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দমননীতির কারণে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে মনে

করে যে আদালত বা প্রশাসনের মাধ্যমে দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। ২. রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। এতে জনগণ আস্থাহীন হয়ে নিজস্ব পথে বিচার করতে চায়। ৩. তরুণসমাজের যখন কর্মসংস্থান হয় না, তখন বেকারত্ব ও হতাশা থেকে তাদের মধ্যে সহজেই উগ্র আবেগ ভর করে এবং মব অ্যাকশনে তারা অংশ নেয়। এই ধরনের অবস্থাকে ‘কনফ্লিক্ট ইনডিউসিং ফ্যাক্টর’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। ৪. সামাজিক ও শিক্ষাগত অদক্ষতা জনগণের মধ্যে আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব তৈরি করে। প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক সুশিক্ষার অভাবের কারণে তারা বুঝতে পারে না যে মব সমাজকে আরও অস্থির করে তোলে। ৫. আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ বা চুরির মতো ঘটনায় মানুষ তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকে অপরাধীকে শাস্তি দিতে চায়। এই অনিয়ন্ত্রিত আবেগই মব ভায়োলেন্সকে অনেকাংশে উসকে দেয়।

সরকার কেন মব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে?

সরকারের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা।

বাংলাদেশের সরকারগুলো বেশির ভাগ সময় নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন ব্যবহার করে। এর ফলে জনগণের দৈনন্দিন নিরাপত্তা বা মব নিয়ন্ত্রণে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। রয়েছে আইনের শাসনের অভাব। অপরাধীরা প্রায়ই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যায়। তারা শাস্তি এড়িয়ে গেলে সাধারণ মানুষ মনে করে যে বিচার তাদের নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং তা-ই হচ্ছে। পিস স্টাডিজের দৃষ্টিতে সরকার এখানে নেগেটিভ পিস বজায় রাখার চেষ্টা করে (সহিংসতা এড়ানো মাত্র), কিন্তু পজিটিভ পিস (ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণ, সামাজিক সমতা) নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু হওয়ার কথা উল্টোটা। ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণ, সামাজিক সমতা এই ধরনের স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স (কাঠামোগত সহিংসতা) নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ডিরেক্ট ভায়োলেন্স সমানুপাতিক হারে নিয়ন্ত্রিত হতো। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই সরকার অগ্রাধিকারের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রাখছে না বরং এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন ঢিলেমিকে জায়েজ করার অপকৌশল এর অন্যতম প্রধান কারণ।

এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য প্রশাসন বা সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবার জন্য সমানভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। অপরাধী যেই হোক না কেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব প্রচারমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।

রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ না দিলে এই ধরনের ঘটনা দিনদিন বৃদ্ধি পাবে। জনগণ ও পুলিশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করা প্রয়োজন। এতে জনগণ সহযোগী হিসেবে কাজ করবে।

তবে, মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে এর থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণ সম্ভব নয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নামসর্বস্ব। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকেই আইন সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তরুণসমাজকে দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে বেকারত্ব কমানো গেলে এবং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করলে সমাজকে সহিংসতা থেকে অনেকাংশে দূরে রাখা সম্ভব হবে।

মিডিয়ার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রায় সব মিডিয়াই গোয়েন্দা সংস্থার মতো ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তারা রিপোর্ট করে। কিন্তু আজকাল সতর্কীকরণ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের প্রচণ্ড অভাব। ফলোআপ করতে না দেওয়া কিংবা না

করার কারণে মবের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই মব সন্ত্রাস প্রতিরোধে গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে ঘৃণার চাষ হয়েছে অবিরাম এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক সহিংসতাকে করা হয়েছে স্বাভাবিকীকরণ। এই সমস্যার সমাধান শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপে সম্ভব নয়; বরং রাজনৈতিক সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন—সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত শান্তি কৌশল (কম্প্রিহেনসিভ পিস স্ট্র্যাটেজি) প্রয়োজন। তবেই সমাজে ‘পজিটিভ পিস’ বৃদ্ধি পাবে এবং এ ধরনের নৃশংসতা হ্রাস পাবে। এই ক্ষেত্রে, শান্তি শিক্ষা (পিস এডুকেশন) স্কুল ও কলেজে চালু করে শিক্ষার্থীদের সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও শান্তিপূর্ণ সমস্যা সমাধানের চর্চাকে পরোক্ষ কৌশল হিসেবে শেখানো যেতে পারে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত