Ajker Patrika

পুরুষতন্ত্রের অপরাধমূলক আচরণ

ইমতিয়াজ মাহমুদ
পুরুষতন্ত্রের অপরাধমূলক আচরণ

টেলিভিশনে আলোচনা হচ্ছিল একজন নারী লেখক প্রসঙ্গে। একজন সাহিত্য সম্পাদকের রক্ষিতা কথাটির ব্যবহার প্রসঙ্গে। টেলিভিশনের সঞ্চালক এবং একজন আলোচক—তাঁরা নারী। আর তাঁদের সঙ্গে দুজন পুরুষ আলোচক—একজন সাংবাদিক এবং অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পুরুষ দুই আলোচকের আলোচনা আমাকে বেশ আমোদিত করেছে। আমোদিত করেছে কেন? যিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, তাঁর কথা হচ্ছে—নারী প্রসঙ্গে হোক বা পুরুষ—এ ধরনের লিঙ্গবাদী কথা বলা ঠিক নয়। যিনি সাংবাদিক তিনি বেশ বিজ্ঞের মতো বললেন, কিছু লোকের মস্তিষ্কের ভেতর বাস করে একেকটা ধর্ষক মন, এসব হচ্ছে সেই ধর্ষক মনের বহিঃপ্রকাশ।

আমোদ হচ্ছে এই জন্য যে এই দুই আলোচক একদম ঠিক ঠিক পুরুষ হিসেবে পুরুষের সামাজিক দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। তাঁরা কেউই চিহ্নিত করলেন না যে এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। একজন বলছেন, এ ধরনের অশ্লীল গালাগাল বিশেষভাবে নারীকে হেনস্তা করার জন্য ব্যবহার হয় না, এটা নারী–পুরুষ দুই ক্ষেত্রেই হয়। আরেকজন বললেন, এসব আচরণ ব্যক্তিগত প্রবণতামাত্র। এগুলো সেসব ব্যক্তির আচরণ, যাঁদের থাকে ধর্ষক মন।

আসলে এসব কোনো লিঙ্গনিরপেক্ষ আচরণ বা ব্যক্তিগত স্বভাব বা মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ নয়। এই যে নারীকে রক্ষিতা চিহ্নিত করা, এটা করা হয় বিশেষভাবে নারীর ক্ষেত্রে। যখন কোনো নারী তাঁর পেশাগত ক্ষেত্রে, অফিসে বা ব্যবসায় একটু সফলতা পান, তাঁকেই আমাদের সমাজে কেউ না কেউ চরিত্রহীন হিসেবে চিহ্নিত করবে। এর দুটি কারণ। প্রথম কারণ, একজন পুরুষ কখনোই স্বীকার করবে না যে একজন নারী তাঁর চেয়ে বুদ্ধি–প্রজ্ঞা–মেধায় অগ্রসর হতে পারেন। আপনি এ রকম অনেক দেখবেন, স্ত্রী হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ান; কিন্তু তাঁর স্বামীটি, যিনি হয়তো দর্শন পড়েননি কোনো দিন, তিনিও সেই দর্শনের অধ্যাপককে দর্শন বিষয়ে লেকচার দিতে দ্বিধা করেন না।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, পুরুষতন্ত্রের চোখে নারীর অবস্থান। পুরুষতন্ত্রের সূচনালগ্ন থেকেই পুরুষের চোখে নারীর মর্যাদা হচ্ছে—নারী আসলে পুরুষের মালিকানায় থাকা একটি প্রাণী। মালিকানাটাই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রে নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক। নারীর মালিক পুরুষ। প্রতিটি নারীর একজন পুরুষ মালিক থাকতে হবে এবং প্রতিটি নারীকে তাঁর মালিক বা প্রভুর নির্দেশ মেনে চলতে হবে এবং পুরুষের মালিকানাধীন প্রাণী হিসেবে নারীর জন্যে সামাজিকভাবেও কিছু সাধারণ নিয়ম থাকে, যেগুলো নারীকে মানতে হবে। কোনো নারী যদি সেটা না মানেন, তাহলে সেই নারীটি হচ্ছেন বেশ্যা বা রক্ষিতা বা সে রকম কিছু।

আপনি দেখবেন, যে নারীটি গান করেন, অভিনয় করেন বা নাচ করেন বা বিনোদনমূলক একটা কিছু করেন, তাঁকে পুরুষেরা বলবেন বেশ্যা! কেন? কারণ গান করুক বা অভিনয় করুক বা নাচ করুক, নারী সেটা করতে পারেন কেবল তাঁর স্বামীর জন্য। স্বামী মানে হচ্ছে মালিক বা প্রভু। প্রভু ছাড়া অন্য কারও জন্যে তিনি কেন গান করবেন, নাচ করবেন বা অভিনয় করবেন? এর মানে হচ্ছে, এই নারীটি মালিক-দাসী সম্পর্কের মৌলিক নিয়ম মানছেন না। সুতরাং তিনি বেশ্যা!

আর এ জন্যই দেখবেন, ওয়াজ করার সময় ওয়াজকারীরা নারীর মালিককে দোষ দেন—তোমার মেয়েকে গার্মেন্টসে কাজ করতে দাও কেন? তোমার মেয়েকে ক্লাস ফোর–ফাইভের বেশি পড়াবে কেন? তোমার স্ত্রীকে চাকরি করতে পাঠালে কেন, লজ্জা করে না তোমার? তোমার স্ত্রী হাটবাজারে যায়, বাড়ির বাইরে যায়; লজ্জা করে না তোমার? তুমি কেমন পুরুষ? স্পিরিটটা হচ্ছে সেটাই—নারী মানে হচ্ছে, পুরুষের মালিকাধীন একটি প্রাণী বা পণ্য। নারী তাঁর নিজের মালিক নন, নারী তাঁর মর্জির মালিক নন। আর নারী তাঁর শরীরের মালিক হবেন, সেটা তো প্রশ্নই ওঠে না। এই নিয়ম যে নারী মানেন না, তিনি তো তাঁদের চোখে বেশ্যাই হবেন।

এটাই পুরুষতন্ত্রের চোখে নারীর সামাজিক অবস্থান। এই পুরুষতন্ত্র আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে হাজার বছর ধরে। আমাদের শারীরিক অনেক স্বভাব বা প্রবণতা যেমন আমরা জন্ম থেকেই পাই, যেগুলো আমাদের দেহের কোষে কোষে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শরীরের অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। এই পুরুষতান্ত্রিক চেতনা আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়।

এটা হচ্ছে পুরুষের স্বভাবের মতো, ঢিল ছুটে এলে যেমন আপনা থেকেই মানুষের শরীর প্রতিক্রিয়া দেখায়, অনেকটা সে রকম।

বেশ্যা বলেই কেন গালি দিতে হবে? নারীর চরিত্র নিয়েই কেন আক্রমণ করতে হবে? কারণ, এই প্রভু-দাসী সম্পর্কের অন্যতম মূল শর্তই হচ্ছে—নারীর শরীরের ওপর বা নারীর স্পর্শকাতর অঙ্গে তাঁর প্রভুর মনোপলি। নারীর শরীরের মালিক হবেন কেবল তাঁর প্রভু।

প্রভু বদল হতে পারে। নারীকে হস্তান্তর করা যাবে, কেনাবেচাও পুরোপুরি অবৈধ নয়। কিন্তু যে যখন মালিক হবেন, তাঁর মনোপলি থাকতে হবে। নারী হচ্ছে পুরুষের মালিকানায় থাকা শস্যখেতের মতো। যে নারীটি এই মালিক-দাসী সম্পর্ক মানবেন না বা অস্বীকার করবেন, তিনি হয়ে যাবেন নষ্টা কিংবা পতিতা। এটাই পুরুষতন্ত্র।
এটা ঠিক যে অনেক পুরুষ আছেন, যাঁরা চট করে এ রকম গালি দেন না। তাঁরা কি তবে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদার মানুষ বলে মনে করেন? দু–একজন হয়তো করেন, কিন্তু সবাই নন। যেসব ভদ্রলোক গালাগাল করেন না, তাঁদের বেশির ভাগ গালাগাল থেকে বিরত থাকেন নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে। তাঁরা মেহেরবান। তাঁরাও মনে করেন, নারী হচ্ছে ঊনমানুষ, পুরুষের চেয়ে একটু কম, পুরুষের অধীন থাকা ছাড়া নারীর গতি নেই।

কিন্তু মধ্যযুগে শিভালরি বলে একটা জিনিস বিকশিত হয়েছে। নারী অসহায়, নারী দুর্বল, নারী ভঙ্গুর। সুতরাং, সবল পুরুষ তাঁর সঙ্গে মন্দ আচরণ করবেন না। এই মেহেরবানদের মেহেরবানিও নারীকে ঠিক পুরুষের সমান মর্যাদার মানুষ মনে করে না।এটাই হচ্ছে ব্যাখ্যা। কেন নারীর বিরোধ করতে গেলে পুরুষ প্রথমেই তাঁকে চরিত্রহীন দেখাতে চান, কেন তাঁকে বেশ্যা বলে গালাগাল দেন, কেন তাঁকে রক্ষিতা বলে ছোট করতে চান? এটা কেবল একজন ব্যক্তির ‘ধর্ষক মন’-এর অসভ্য আচরণ নয় বা একজন অসংস্কৃত লোকের পুরুষ–নারী নির্বিশেষে করা গালাগাল নয়। এসব আচরণ হচ্ছে, পুরুষতন্ত্রের নির্ধারিত সামাজিক বিধিবিধানের প্রতি নিষ্ঠাবান আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশমাত্র।
ভুল করবেন না, এটা কেবল একজন বা দুজন বা একদল পুরুষের অপরাধমূলক আচরণ নয়, অপরাধ। এটা হচ্ছে, সব পুরুষ তথা পুরুষতন্ত্রের অপরাধমূলক আচরণ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত