জাহীদ রেজা নূর
ফিওদর দস্তয়েফ্স্কি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন জেন-জি আর নতুন ডানপন্থীদের মধ্যে—এ কথা বলা হলে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন আপনার দিকে। কিন্তু একটু ব্যাখ্যা করলেই তাঁরা বুঝে যাবেন, কিছুই বাড়িয়ে বলছেন না আপনি।
কোন দিকে চলেছে পৃথিবী, সেটা আদৌ কেউ বুঝতে পারছে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। দেশ বা বিশ্ব—সবখানেই অস্থিরতা। কোথাও কোথাও অরাজকতা। এ সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা হলে তা পৃথিবীজুড়ে উগ্র ডানপন্থার উত্থান নিয়েই করতে হবে। কিংবা গ্রামশির আধিপত্যবাদ নিয়ে বিতর্ক তুলেও পক্ষে-বিপক্ষে নরক গুলজার করা সম্ভব। কিন্তু এ মুহূর্তে আদৌ কি তার কোনো প্রয়োজন আছে? বলছি না, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে হবে। বলছি, ইতিবাচক-নেতিবাচক যে ভাবনাগুলো আপনাকে তাড়িত করছে, তা থেকে একটু সরে ভাবনায় স্থির হওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। এ কারণেই দস্তয়েফ্স্কিকে লেখায় টেনে আনা।
আগেও মনীষীদের কণ্ঠে আমরা শুনেছি, রাজনীতি আর সংস্কৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চললেই সে জাতি এগিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশেও সে রকম একটি আবহ তৈরি হয়েছিল একদা—গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে। তখন স্বাধিকারের আগুনে পোড়া মানুষ রাজনৈতিক বক্তৃতায় যেমন খুঁজে পেত নিজেকে, তেমনি সংস্কৃতির সমুদ্রে অবগাহনেও মিলত পরিতৃপ্তি। তারপর একসময় সে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রাজনীতি পথভ্রষ্ট হলো, সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলা হলো আবর্জনায়। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই আলোচনায় সংস্কৃতির এক দারুণ অঙ্গ সাহিত্যকে টেনে আনার একটা নিগূঢ় কারণ আছে। আজকের প্রজন্মকে যদি বুঝতে হয়, তাহলে কেন তাদের মনে দস্তয়েফ্স্কি পেয়ে যাচ্ছেন এক পাকা আসন, সে কথাটাও তো বুঝতে হবে। বিদেশি গবেষণায় পশ্চিমা তরুণদের কথাই স্থান পেয়েছে, সে কথাও এখানে বলে রাখা দরকার। তরুণেরা গভীরতর কিছু লেখাপড়া করে না, তিন মিনিটের বেশি কোনো বিষয়ে ধৈর্য রাখতে পারে না—এ রকম অনেক কিছুই শোনা যায়। কিন্তু সে কথা কি সব তরুণের ক্ষেত্রে খাটে? গোটা তরুণসমাজই কি ভেসে গেছে তথ্যপ্রযুক্তির ঝড়ে? সারাক্ষণই কি তাদের চোখ ছোট্ট একটা স্মার্টফোনে নিবদ্ধ? কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে?
সব যুগেই বিশ্ব এগিয়েছে বর্ষীয়ানের প্রজ্ঞা আর তরুণের গতিতে সমৃদ্ধ হয়ে। একসময়ের তরুণেরা প্রৌঢ় হওয়ার আগে থেকেই নব্য তরুণদের সমালোচনা করে এসেছেন যুগের পর যুগ ধরে। পরে ওই প্রজ্ঞা আর গতির মিলনেই তৈরি হয়েছে নতুন করে চলার পথ। এই কথাগুলো মনে রাখলে, এ সময়ের তরুণদের অবজ্ঞা করাটা অসমীচীন হয়ে উঠবে।
দস্তয়েফ্স্কি রুশ সাহিত্যের সোনালি যুগের প্রতিনিধি। আলেকসান্দর পুশকিন থেকে যে যুগের শুরু, চেখভে তার শেষ। এর মাঝে লেরমন্তভ, গোগল, তুর্গিয়েনেভ, দস্তয়েফ্স্কি, তলস্তয়কে পাওয়া যাবে। দস্তয়েফ্স্কির জীবন যেকোনো নাটক বা সিনেমাকেও হার মানায়। ১৮২১ সালে জন্ম নেওয়া এই সাহিত্যিক মারা গেছেন ১৮৮১ সালে। কিন্তু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছেন। সারা বিশ্বেই রয়েছে তাঁর কদর।
কেন জেনারেশন জের কাছে দস্তয়েফ্স্কি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। তবে এ কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে, এই তরুণেরা মূলত পড়ছে লেখকের ছোট উপন্যাসগুলো। মানে ‘সাদা রাত’ আর ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’। একটি তথ্য দিয়ে রাখি, গত বছর যুক্তরাজ্যে দস্তয়েফ্স্কির ‘সাদা রাত’ চতুর্থ সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের মর্যাদা পেয়েছিল।
তবে শুধু ছোট উপন্যাসই নয়, বড় উপন্যাসগুলোর মূল চরিত্ররা নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয়। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র রাসকোলনিকভ, ইডিয়টের প্রিন্স মিশকিন, কারামোজোভ ব্রাদার্স-এর আলিওশা কারামাজভ এদের খুব প্রিয়। কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেছেন, দস্তয়েফ্স্কির উপন্যাসগুলোর যে তিনজন মূল চরিত্রের কথা বলা হলো, তাদের প্রত্যেকের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। ‘সাদা রাত’ লেখার সময় দস্তয়েফ্স্কির বয়সও ছিল ২৬ বছর। ভূতলবাসী লোকটির কথাই বলা যাক। ২৪ বছরের জীবনকে সে ফিরে দেখে। এদের প্রায় প্রত্যেকেই সমাজের বাইরে থাকা অ্যান্টি হিরো, যারা তার অস্তিত্বগত বেদনায় পীড়িত। এ সময়কার তরুণ-তরুণীদের মতো দস্তয়েফ্স্কির নায়ক-নায়িকারাও একাকিত্ব অনুভব করে। ‘সাদা রাত’-এর কথক প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখেন: ‘হঠাৎ মনে হলো আমি একা, সবাই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে।’
একতরফা প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি সাঙ্কৎ পিতের্বুর্গের রাস্তায় হাঁটেন সাদা রাতের আলোতে আর নিজের অনুভূতি লিখে রাখেন। সেটা কি এ যুগে জেন-জির ফেসবুক স্ট্যাটাস বা টুইটারের বার্তার মতো কিছু?
ব্রিটিশ লেখক ড্যানিয়েল রে লিখেছেন, টিকটকার জ্যাক এডওয়ার্ডস ‘সাদা রাত’-কে বলেছেন ‘প্রেম নিয়ে লেখা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বইগুলোর একটি’।
অস্তিত্ববাদী ছোট উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’ও হচ্ছে একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা-প্রধান। কোভিডের মহামারিকালে এই বইটির বিক্রি চার গুণ বেড়েছিল।
এর জনপ্রিয়তা বেড়েছিল টিকটক-সৃষ্ট আগ্রহের কারণে।
সরাসরি গদ্যরীতি আর ক্রমাগত আত্মসমালোচনা টিকটকের কনটেন্টশৈলীর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে দস্তয়েফ্স্কির রচনাকে। ‘আমি যথেষ্ট শিক্ষিত, কুসংস্কারে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, তারপরও আমি কিন্তু কুসংস্কারে বিশ্বাসী’—এই লাইনটি পড়লে তরুণদের মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আস্থা চলে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার টেইলর রোজেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’-কে বলেছেন, ‘সবচেয়ে ছোট ক্লাসিক উপন্যাসের একটি’। লক্ষ করুন, এখানে মূল শব্দ হচ্ছে ‘ছোট’। ‘সাদা রাত’ আর ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’—দুটো বই-ই আকারে ছোট, তাই তরুণদের কাছে প্রিয়।
জেন-জির মতো আরেকটি গোষ্ঠীও ইদানীং দস্তয়েফ্স্কিকে সম্মান করছে। এরা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইলন মাস্ক ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ নিয়ে টুইট করেছিলেন। উদ্যোক্তা পিটার থিয়েল দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালকে বলেছিলেন: ‘মানব মনের অযৌক্তিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে ভাবতে হলে দস্তয়েফ্স্কির বই পড়াই সবচেয়ে ভলো উপায়।’
কিন্তু নতুন ডানপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুসারী হচ্ছেন জর্ডান পিটারসন। তিনি ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ এবং ‘অপরাধ ও শাস্তি’—এই দুই বইকে তাঁর প্রিয় বইয়ের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রেখেছেন। তাঁর লেকচার ও পডকাস্টে পিটারসন দস্তয়েফ্স্কির বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেন। তিনি মিখাইল বাখতিনের সঙ্গে একমত হয়ে লিখেছেন: ‘দস্তয়েফ্স্কির উপন্যাসগুলোর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো সত্যিকারের বহুস্বর।’
মজার ব্যাপার হলো, দস্তয়েফ্স্কির বহুস্বর নিয়ে যাঁরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরা নিজেরাই সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে কম যান না। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল ও লাইব্রেরিতে টনি মরিসন ও মার্গারেট অ্যাটউডের বই কিন্তু রাখা হয় না। তাঁদের বই সেখানে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। টনি মরিসনের লেখার বিষয়াবলি স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য নৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন নিষিদ্ধ করার পক্ষের লোকেরা। অন্যদিকে যাঁরা নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে, তাঁরা বলেন, মরিসনের বইয়ের সাহিত্যিক মূল্য আছে। ইতিহাস ও সামাজিক সত্য সেখানে প্রকাশিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের চিন্তায় গভীরতা আনে।
এবার এক প্যারাডক্স নিয়ে বলি। ডানপন্থীরা যে দস্তয়েফ্স্কির তারিফ করছেন আজ, সেই দস্তয়েফ্স্কি কিন্তু ছিলেন প্রবলভাবে রুশ জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমা জীবন তাঁর পছন্দ ছিল না। একসময় তিনি পশ্চিমা বিপ্লববাদকে সমর্থন করলেও ১০ বছরের নির্বাসিত জীবনযাপনের পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন রুশ জাতীয়তাবাদী। জর্ডান পিটারসন যেখানে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন, সেখানে দস্তয়েফ্স্কি ছিলেন রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বে অবিচল বিশ্বাসী।
২. আমরা মূলত ঘুরে এলাম পশ্চিমা পাঠকদের কাছ থেকে। আমাদের জেন-জি আর ডানপন্থীরা আসলে কী ভাবছেন? দস্তয়েফ্স্কি তাঁদের কাছে কতটা প্রিয়? আদৌ কি তাঁরা এই মহান লেখককে পড়ে থাকেন? বহুস্বরের (বহুত্ববাদ) যে কথা বলা হয় নানাভাবে, আদতে কি সেই বহুস্বরকে শ্রদ্ধা করছে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ? নাকি পশ্চিমাদের অনুসরণ করে শুধু বয়ান সৃষ্টি করে চলেছে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি।
ফিওদর দস্তয়েফ্স্কি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন জেন-জি আর নতুন ডানপন্থীদের মধ্যে—এ কথা বলা হলে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন আপনার দিকে। কিন্তু একটু ব্যাখ্যা করলেই তাঁরা বুঝে যাবেন, কিছুই বাড়িয়ে বলছেন না আপনি।
কোন দিকে চলেছে পৃথিবী, সেটা আদৌ কেউ বুঝতে পারছে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। দেশ বা বিশ্ব—সবখানেই অস্থিরতা। কোথাও কোথাও অরাজকতা। এ সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা হলে তা পৃথিবীজুড়ে উগ্র ডানপন্থার উত্থান নিয়েই করতে হবে। কিংবা গ্রামশির আধিপত্যবাদ নিয়ে বিতর্ক তুলেও পক্ষে-বিপক্ষে নরক গুলজার করা সম্ভব। কিন্তু এ মুহূর্তে আদৌ কি তার কোনো প্রয়োজন আছে? বলছি না, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে হবে। বলছি, ইতিবাচক-নেতিবাচক যে ভাবনাগুলো আপনাকে তাড়িত করছে, তা থেকে একটু সরে ভাবনায় স্থির হওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। এ কারণেই দস্তয়েফ্স্কিকে লেখায় টেনে আনা।
আগেও মনীষীদের কণ্ঠে আমরা শুনেছি, রাজনীতি আর সংস্কৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চললেই সে জাতি এগিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশেও সে রকম একটি আবহ তৈরি হয়েছিল একদা—গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে। তখন স্বাধিকারের আগুনে পোড়া মানুষ রাজনৈতিক বক্তৃতায় যেমন খুঁজে পেত নিজেকে, তেমনি সংস্কৃতির সমুদ্রে অবগাহনেও মিলত পরিতৃপ্তি। তারপর একসময় সে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রাজনীতি পথভ্রষ্ট হলো, সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলা হলো আবর্জনায়। সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই আলোচনায় সংস্কৃতির এক দারুণ অঙ্গ সাহিত্যকে টেনে আনার একটা নিগূঢ় কারণ আছে। আজকের প্রজন্মকে যদি বুঝতে হয়, তাহলে কেন তাদের মনে দস্তয়েফ্স্কি পেয়ে যাচ্ছেন এক পাকা আসন, সে কথাটাও তো বুঝতে হবে। বিদেশি গবেষণায় পশ্চিমা তরুণদের কথাই স্থান পেয়েছে, সে কথাও এখানে বলে রাখা দরকার। তরুণেরা গভীরতর কিছু লেখাপড়া করে না, তিন মিনিটের বেশি কোনো বিষয়ে ধৈর্য রাখতে পারে না—এ রকম অনেক কিছুই শোনা যায়। কিন্তু সে কথা কি সব তরুণের ক্ষেত্রে খাটে? গোটা তরুণসমাজই কি ভেসে গেছে তথ্যপ্রযুক্তির ঝড়ে? সারাক্ষণই কি তাদের চোখ ছোট্ট একটা স্মার্টফোনে নিবদ্ধ? কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে?
সব যুগেই বিশ্ব এগিয়েছে বর্ষীয়ানের প্রজ্ঞা আর তরুণের গতিতে সমৃদ্ধ হয়ে। একসময়ের তরুণেরা প্রৌঢ় হওয়ার আগে থেকেই নব্য তরুণদের সমালোচনা করে এসেছেন যুগের পর যুগ ধরে। পরে ওই প্রজ্ঞা আর গতির মিলনেই তৈরি হয়েছে নতুন করে চলার পথ। এই কথাগুলো মনে রাখলে, এ সময়ের তরুণদের অবজ্ঞা করাটা অসমীচীন হয়ে উঠবে।
দস্তয়েফ্স্কি রুশ সাহিত্যের সোনালি যুগের প্রতিনিধি। আলেকসান্দর পুশকিন থেকে যে যুগের শুরু, চেখভে তার শেষ। এর মাঝে লেরমন্তভ, গোগল, তুর্গিয়েনেভ, দস্তয়েফ্স্কি, তলস্তয়কে পাওয়া যাবে। দস্তয়েফ্স্কির জীবন যেকোনো নাটক বা সিনেমাকেও হার মানায়। ১৮২১ সালে জন্ম নেওয়া এই সাহিত্যিক মারা গেছেন ১৮৮১ সালে। কিন্তু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছেন। সারা বিশ্বেই রয়েছে তাঁর কদর।
কেন জেনারেশন জের কাছে দস্তয়েফ্স্কি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন, সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়। তবে এ কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে, এই তরুণেরা মূলত পড়ছে লেখকের ছোট উপন্যাসগুলো। মানে ‘সাদা রাত’ আর ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’। একটি তথ্য দিয়ে রাখি, গত বছর যুক্তরাজ্যে দস্তয়েফ্স্কির ‘সাদা রাত’ চতুর্থ সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের মর্যাদা পেয়েছিল।
তবে শুধু ছোট উপন্যাসই নয়, বড় উপন্যাসগুলোর মূল চরিত্ররা নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয়। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র রাসকোলনিকভ, ইডিয়টের প্রিন্স মিশকিন, কারামোজোভ ব্রাদার্স-এর আলিওশা কারামাজভ এদের খুব প্রিয়। কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেছেন, দস্তয়েফ্স্কির উপন্যাসগুলোর যে তিনজন মূল চরিত্রের কথা বলা হলো, তাদের প্রত্যেকের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। ‘সাদা রাত’ লেখার সময় দস্তয়েফ্স্কির বয়সও ছিল ২৬ বছর। ভূতলবাসী লোকটির কথাই বলা যাক। ২৪ বছরের জীবনকে সে ফিরে দেখে। এদের প্রায় প্রত্যেকেই সমাজের বাইরে থাকা অ্যান্টি হিরো, যারা তার অস্তিত্বগত বেদনায় পীড়িত। এ সময়কার তরুণ-তরুণীদের মতো দস্তয়েফ্স্কির নায়ক-নায়িকারাও একাকিত্ব অনুভব করে। ‘সাদা রাত’-এর কথক প্রথম অনুচ্ছেদেই লেখেন: ‘হঠাৎ মনে হলো আমি একা, সবাই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে।’
একতরফা প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি সাঙ্কৎ পিতের্বুর্গের রাস্তায় হাঁটেন সাদা রাতের আলোতে আর নিজের অনুভূতি লিখে রাখেন। সেটা কি এ যুগে জেন-জির ফেসবুক স্ট্যাটাস বা টুইটারের বার্তার মতো কিছু?
ব্রিটিশ লেখক ড্যানিয়েল রে লিখেছেন, টিকটকার জ্যাক এডওয়ার্ডস ‘সাদা রাত’-কে বলেছেন ‘প্রেম নিয়ে লেখা সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বইগুলোর একটি’।
অস্তিত্ববাদী ছোট উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’ও হচ্ছে একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা-প্রধান। কোভিডের মহামারিকালে এই বইটির বিক্রি চার গুণ বেড়েছিল।
এর জনপ্রিয়তা বেড়েছিল টিকটক-সৃষ্ট আগ্রহের কারণে।
সরাসরি গদ্যরীতি আর ক্রমাগত আত্মসমালোচনা টিকটকের কনটেন্টশৈলীর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে দস্তয়েফ্স্কির রচনাকে। ‘আমি যথেষ্ট শিক্ষিত, কুসংস্কারে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই, তারপরও আমি কিন্তু কুসংস্কারে বিশ্বাসী’—এই লাইনটি পড়লে তরুণদের মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আস্থা চলে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার টেইলর রোজেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’-কে বলেছেন, ‘সবচেয়ে ছোট ক্লাসিক উপন্যাসের একটি’। লক্ষ করুন, এখানে মূল শব্দ হচ্ছে ‘ছোট’। ‘সাদা রাত’ আর ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নোটস’—দুটো বই-ই আকারে ছোট, তাই তরুণদের কাছে প্রিয়।
জেন-জির মতো আরেকটি গোষ্ঠীও ইদানীং দস্তয়েফ্স্কিকে সম্মান করছে। এরা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইলন মাস্ক ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ নিয়ে টুইট করেছিলেন। উদ্যোক্তা পিটার থিয়েল দ্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালকে বলেছিলেন: ‘মানব মনের অযৌক্তিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে ভাবতে হলে দস্তয়েফ্স্কির বই পড়াই সবচেয়ে ভলো উপায়।’
কিন্তু নতুন ডানপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুসারী হচ্ছেন জর্ডান পিটারসন। তিনি ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ এবং ‘অপরাধ ও শাস্তি’—এই দুই বইকে তাঁর প্রিয় বইয়ের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রেখেছেন। তাঁর লেকচার ও পডকাস্টে পিটারসন দস্তয়েফ্স্কির বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেন। তিনি মিখাইল বাখতিনের সঙ্গে একমত হয়ে লিখেছেন: ‘দস্তয়েফ্স্কির উপন্যাসগুলোর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো সত্যিকারের বহুস্বর।’
মজার ব্যাপার হলো, দস্তয়েফ্স্কির বহুস্বর নিয়ে যাঁরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরা নিজেরাই সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে কম যান না। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল ও লাইব্রেরিতে টনি মরিসন ও মার্গারেট অ্যাটউডের বই কিন্তু রাখা হয় না। তাঁদের বই সেখানে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। টনি মরিসনের লেখার বিষয়াবলি স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য নৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন নিষিদ্ধ করার পক্ষের লোকেরা। অন্যদিকে যাঁরা নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে, তাঁরা বলেন, মরিসনের বইয়ের সাহিত্যিক মূল্য আছে। ইতিহাস ও সামাজিক সত্য সেখানে প্রকাশিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের চিন্তায় গভীরতা আনে।
এবার এক প্যারাডক্স নিয়ে বলি। ডানপন্থীরা যে দস্তয়েফ্স্কির তারিফ করছেন আজ, সেই দস্তয়েফ্স্কি কিন্তু ছিলেন প্রবলভাবে রুশ জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমা জীবন তাঁর পছন্দ ছিল না। একসময় তিনি পশ্চিমা বিপ্লববাদকে সমর্থন করলেও ১০ বছরের নির্বাসিত জীবনযাপনের পর তিনি হয়ে উঠেছিলেন রুশ জাতীয়তাবাদী। জর্ডান পিটারসন যেখানে পশ্চিমের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন, সেখানে দস্তয়েফ্স্কি ছিলেন রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বে অবিচল বিশ্বাসী।
২. আমরা মূলত ঘুরে এলাম পশ্চিমা পাঠকদের কাছ থেকে। আমাদের জেন-জি আর ডানপন্থীরা আসলে কী ভাবছেন? দস্তয়েফ্স্কি তাঁদের কাছে কতটা প্রিয়? আদৌ কি তাঁরা এই মহান লেখককে পড়ে থাকেন? বহুস্বরের (বহুত্ববাদ) যে কথা বলা হয় নানাভাবে, আদতে কি সেই বহুস্বরকে শ্রদ্ধা করছে আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ? নাকি পশ্চিমাদের অনুসরণ করে শুধু বয়ান সৃষ্টি করে চলেছে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি।
সময়গুলো গোছানো না। চিন্তার দরজা-জানালা, তাও বন্ধ। বাইরে অনিশ্চয়তার দমকা হাওয়া। কী করব, কী বলব কিংবা কী করা দরকার, বলা দরকার ওসব এখন আর চলে না, অচল মুদ্রা। যাকে একদিন সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, সে-ই এখন বড় বিশ্বাসঘাতক। যিনি সত্য কথা বলার মস্ত দাবিদার ছিলেন, সে-ই এখন দেখি প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী। সমাজ
৮ ঘণ্টা আগেশিল্পী এস এম সুলতান জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলার গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে এসে খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে জন্মস্থান চিত্রার পাড়ে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামেই থিতু হয়ে আজীবন শিল্পসাধনা করে গেছেন। গ্রামের শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন শিল্পশিক্ষার স্কুল। গ্রামের
৮ ঘণ্টা আগেএনসিপি দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ রেখেছেন এবং তাঁরা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছেন। সে দলেরই আরেক নেতা সারজিস আলম বলেছেন, পৃথিবীতে সেফ এক্সিট নেওয়ার একটাই জায়গা, সেটা হচ্ছে
৮ ঘণ্টা আগেতিন বছর আগে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ, সরকার পতনের ঘটনা এখনো সবার মনে আছে। কেন সে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেটাও অজানা নয় কারও। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দেশ ছেড়ে পলায়ন, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে তাঁর বিছানায় শুয়ে বিক্ষোভকারীদের ছবি তোলা...
১ দিন আগে